প্রত্নচর্চার পাঠশালা / শেখর দেব
কাব্যগ্রন্থঃ প্রত্নচর্চার পাঠশালা
লেখকের নামঃ শেখর দেব
প্রকাশনীঃ পাঠসূত্র প্রকাশন,
প্রচ্ছদঃ মোবাশ্বির আলম মজুমদার,
নিপাট ভদ্রলোক চট্টগ্রামের কবি শেখর দেবের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল এবারের
বই মেলায়, শিবঠাকুর শ্মশানে-শ্মশানে তুমি কজন পার্বতীর বুকে দিয়েছ আগুন` এমন কিছু অনায়াসে লিখে ফেলতে
পারেন। তাঁর সাথে কিছু কথোপকথনঃ
বিভুঁইঃ কবিতা কেন লেখেন?
শেখর দেবঃ কবিতা লিখি মনের পীড়ন থেকে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতকে শিল্পিত অবয়ব দেয়ার চেষ্টা থেকে লিখি। এমনও যে, কবিতার কাছে আশ্রিত হয়ে নিজেকে নির্ভার মনে হয় তাই।
বিভুঁইঃ আপনিতো পেশায় ব্যাঙ্কার তাইনা?
শেখর দেবঃ পেট চালানোর জন্য একটি পেশা রাখতে হয়। যে পেশায় আছি সেটা আমার কাছে কবিতা লেখার বিরুদ্ধ মনে হয়,কারণ অখণ্ড অবসর না পেলে পড়াশুনা ও কবিতা কিছুই হয় না। তাই এটা পরিবর্তন হতে পারে। তাছাড়া আমি এটা উল্লেখ করতে চাই না।
বিভুঁইঃ আপনার লেখা কোন কবিতা আপনাকে কবি হিসেবে প্রথম খ্যাতি এনে দিয়েছিল? প্রেক্ষিতটাও একটু
শেখর দেবঃ এভাবে specific কোন কবিতার কথা বলা কঠিন, তবে লিখতে লিখতে পরিচিত হয়ে ওঠে একজন কবি। খ্যাতি পেয়েছি কিনা জানি না তবে কবিতা লিখি বলে কিছু কবিরা চেনে। তবে আমার `ত্রিভুজ`, `লাখবাতি` ও `পিতা ও পৃথিবী` কবিতাগুলো অনেকবার ছাপানো হয়েছে এমন কি একই পত্রিকায় ২ বার করেও।,
বিভুঁইঃ ছোট বেলায় কখনো ভেবেছিলেন আপনি কবিতা লিখবেন?
শেখর দেবঃ ছোট বেলায় স্কুলে পড়া অবস্তায় কবিতা নয় ছড়া লিখতে চেষ্টা করেছিলাম কলাপাতার উপর বৃষ্টির ফোটা পড়তে দেখে, যে দৃশ্যটি আমি জানালায় বসে দেখেছি। বর্ষার দিনে জানালা ছিল আমার প্রিয় বস্তু, এর ভেতর দিয়ে প্রকৃতিকে দেখেছি নিবিড়ভাবে।
,
বিভুঁইঃ ঠিক কখন ভাবলেন যে কবিতা লেখাটাকে সিরিয়াসলি নেয়া যায়?
শেখর দেবঃ এইচএসসি পড়া অবস্তায় যখন জীবনানন্দকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম এবং যখন পত্রিকায় কবিতা ছাপানো শুরু করল তখন থেকেই কবিতাকে সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম।
বিভুঁইঃ আপনি কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
শেখর দেবঃ সামাজিক দায়বদ্ধতা বলতে আমারা কি বুঝি সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে, সমাজের উন্নয়নে নিজের কাজকে সম্পৃক্ত করা? সমাজের নানা সংস্কার আর কু সংস্কারকে ভেঙে প্রত্যাশার মতো গড়ে তোলা? নাকি অন্য কিছু। এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কবিতা দেবে। তবে একজন কবিকে অবশ্যই তার মা ও মাটির কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। কবি মানে সমাজ বিচ্ছিন্ন বস্তু নয়। একজন কবিকে তার নৈতিকতার জায়গায় অটল থাকতে হয়। আমি কবিকে ধ্যানি সাধুর সাথে তুলনা করি যে কিনা সমাজের নানা রহস্যের সারকে তুলে আনবে সুন্দর করে। মানুষকে সমাজ-সংলগ্ন বিভিন্ন বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। সমাজে প্রবাহিত বিভিন্ন চিন্তার পরিশীলন ঘটিয়ে নতুন সত্যের উন্মোচন ঘটাবে।
প্রত্নচর্চার পাঠশালা কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি শেখর দেব-এর তিনটি কবিতাঃ
লাখবাতি
কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল ডাকে ধানের গোলায়। পরিপাটি ধুতির ভাঁজ; জ্বলে হাসি সুখের বাতি। রঙিন আঁচলে দেখা দীঘির দীঘল ঘাট সব জানে।
শিমুলতলায় ঝরাপাতা করবন্দি করে পেয়েছি সুদীর্ঘ আয়ু। গন্ধরাজের বাগানে প্রজাপতি-চোখে খুঁজেছি তৃষ্ণাবিনাশী নদী। অবশেষে সেই নদীতেই হারিয়েছি সব।
শুভ্র বসনা দিদির সন্তানেরা নিয়ম ভেঙে গড়েছে দিনরাত। আঁধার সিন্দুকে জমা আছে দাদার শোক, দিদির দীর্ঘশ্বাস।
মা-মাটির দলিল
চারদিক আঁধার ঝিমঝিম, কেড়ে নেয় আলোর রঙ। মাটির মর্ত্যলোকে চোখ মেলে পেয়েছি মা-মাটির দলিল; টেনেছে সুনিবিড়। পৈত্রিক ভিটে, হেসে ওঠে কান্নার রোল। গোশালার ধবল ধেনু হাম্বা শব্দে জানিয়েছে অভ্যর্থনা। উঠোনের কোলে শিমুল ঝরেছে নিরবে। পণ্ডিত মহাশয় ঠিকুজি এঁকে মীন জাতকের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও ভালোবাসার দিল বিবরণ। কোষ্ঠীর অবয়বে হাতে দিল বইয়ের স্বর্গ, পকেটে কলম। পৌষের কুয়াশা ছোঁয়নি তেমন।
বুদ্ধির শাণিত আলো কোমল শেকলে বাঁধা হলো মাটি, প্রকৃতি, গোশালার গরু ও পুকুরের মাছ। শিমুল তলায় ঠাকুরদিদি ফোটিয়েছে বেঙমা-বেঙমীর সংসার। প্রবল শীতে গো-বাছুরের গায়ে জড়িয়েছি র্শাট; গলায় গলা জড়িয়ে গিয়েছি মাঠে। ছঁই এর গিলে অপলক তাকিয়েছি টুনটুনির লেজ নাড়া। পুকুরে মাছের খেলা শেষে ছুটেছি ছড়ার জমে থাকা জলে। দুরন্ত শৈশবে।
সুবাসিত ফুলের বাগান উজাড় হলে হারিয়েছি মাটি। মায়ের অশ্র“সিক্ত চোখে দেখিনা মাটির গল্প।
শ্মশানসাধু
শ্মশান রাতে চণ্ডালের হাতে নিথর শরীর সঁপে শিশির সিক্ত ঘাসে চলেছে আড্ডা। শিবঠাকুর চলেছে মাতাল মমতায়। কৃষ্ণের বাঁশিতে ডাকে রাধা রাধা চলো অশ্বত্থকুন্জে।
পতিত পবিত্রতায় উদ্বাস্তু সাধু বানিয়েছে মনগড়া পৃথিবী। দীক্ষা নয়, যাপনের শিক্ষায় সে মাতাল। আধখানা চাঁদ জোছনার ধবধবে শাড়ি বিছিয়ে দিলে সাধু প্রশ্নের প্রত্যাশায় বসে থাকে আর হাতে হাতে তুলে দেয় তালুতে ঘষা আনন্দ ধোঁয়া।
যাপনের যবনিকা টানার আগে লাশ-পোড়া আগুন গায়ে মেখে চণ্ডাল সাধুকে বলে: শিবঠাকুর শ্মশানে-শ্মশানে তুমি কজন পার্বতীর বুকে দিয়েছ আগুন। সাধু মৃদু হেসে পাশ ফিরে শোয় পরম মমতায়।
অনুলিখন ও ফিচার ভাবনা ঃ দেবাশীষ (অন্যদিন)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন