শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

গল্প : তনুতে চপল মন

তনুতে চপল মন
শেখর দেব
একা হবার মাঝে মজা আছে। কেমন মজা সেটা? পৃথিবীর সবকিছুই একা। এ গ্রহটিকে সঙ্গ দেয়ার জন্য অন্য কোনো গ্রহ কি তার বুকে এসেছিল? সবাই তফাতে তফাতে চলছে যে যার মতো। পৃথিবীর মতো সবকিছুই ভীষণ একা। তনুর ইদানীং খুব একা লাগছে। এখন সে একাকিত্বের মজা খুঁজতে ব্যাকুল। জনমানবশূন্য কোনো স্থানে একা নয় বরং অপরিচিত মুখের ভিড়ে একা। তনুকে কেউ চিনে না, সেও কাউকে চিনে না। ছোটবেলায় মা-বাবার বকা খেয়ে এরকম কোন স্থানে চলে আসতে ইচ্ছে হতো তার। আজ মা-বাবাই তাকে আদর করে এরকম জায়গায় পাঠিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত ও ব্যর্থ মানুষরা একা হতে চায়। তবে এটাও ঠিক, ব্যর্থতা বা সফলতা দুটুই হতাশা আনায়নের বাহক হতে পারে। মন বলে কথা! মনের মৌনতা কিংবা সরবতা দেখে মনকে বোধগম্য করা কঠিন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠীকে বক রূপি যম প্রশ্ন করেছিল পৃথিবীতে কোনো জিনিসের গতি সবচেয়ে বেশি? যুধিষ্ঠীর উত্তর ছিল মন। প্রশ্নের সঠিক উত্তরে খুশি হয়ে যমরাজ মৃত্যুপথযাত্রী ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহাভারতের গল্প এটি। মনের গতি সত্যিই অকল্পনীয়। তনু চাইলেই সে তার তরুছায়া সুনিবিড় গ্রাম ঘুরে আসতে পারে নিমেষে, তনু চোখ বন্ধ করলো, এই সেই মাটির দু'তলা বাড়ি, সামনে উঠোন, শান বাঁধানো ঘাট, উঠোনের কোনায় গন্ধরাজের বাগান, দাওয়ায় বসে গন্ধরাজের ঘ্রাণে মন মাতাল হয়ে আসে। উঠোনজুড়ে নানান খেলা। তনুর মন তার গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে। তনু ভাবলো আমিতো ছোট নই। এই বয়সে গ্রামে গেলে আমি কি ঠিক আগের মতো মাতাল হবো? মিশে যেতে পারবো মাটির সাথে? মনে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তনু একজনকে খুব ভালোবাসে। অনেকদিন সে ফোন করে না। তনু হয়তো তাই একা অনুভব করছে খুব, একাকিত্ব নিয়ে মোটামুটি একটি থিসিস রেডি করছে যেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে করা থিসিসের চেয়েও যেন এটা কঠিন।

তনু কিছুদিন হলো চাকরিসূত্রে ঢাকা এসেছে। জীবনের প্রথম চাকরি বলে কথা। চারদিকে অপরিচিত মুখ। পরিচিত মুখগুলো ফেলে জীবিকার টানে চলে আসা। এ দেশে চাকরির যে হাল : ব্যাংকের চাকরি বলে কথা। ঢাকা অদ্ভুত শহর তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার কথা মনে হলো তার 'শহর শহর ঢাকা শহর/আজব শহর ঢাকা'। মানুষ আর মানুষ। আসলেই আজব। শুধু মাথা আর মাথা কারো মুখ কেউ দেখার ফুরসত নেই। তনু মাঝে মাঝে চুপ মেরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর ছুটে চলা দেখে। কি নিরন্তন ছুটে চলা। মৃত্যু হয়তো এর শেষ গন্তব্য। ফুটপাতে দিনাতিপাতে রত হাজারো মানুষ। কেউ ছুটছে কোটি টাকার পেছনে আবার কেউ শুধু একা থালা ভাত। ফুটপাতে কি দুর্বিষহ জীবন মানুষের। মৌলিক চাহিদার ছিটে ফোঁটাও তারা পায় না। বাংলাদেশ। এই দেশটির কি কোনো পরিবর্তন হবে না? রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে তনুর ঘেন্না হয়। নেতানেত্রীরা নোংরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। হাসিনা আর খালেদা নামের দুটি পথে জনগণ শুধু চলছে তো চলছে। কখনো খালেদার কাছে আবার কখনো হাসিনার কাছে কিন্তু দেশ সেই একই হালে যেই লাউ সেই কদু্। বাঙালির বুক ভরা আবেগ। জাতির পিতা হতে উত্তরাধিকার সূত্রে এ আবেগ পেয়েছে। কখন বাঙালি ভালো থাকে বা মন্দে থাকে তাদের নিজেদের কাছেও বোধগম্য নয়। চারদিকের মানুষগুলো যেন মুখোশ। মুখোশের এক রূপ, খুলে দিলে অন্য রূপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি সব চিন্তা করে যাচ্ছে তনু। চারদিকে প্রচুর হট্টগোলের মাঝেও যেন তার মাঝে অনাবিল নীরবতা। এতোক্ষণ পর তার কানে লাগলো এসব হট্টগোল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো মানিব্যাগটি আছে কিনা। এ শহরে কখন পকেট থেকে মানিব্যাগ চলে যাবে তার ইয়ত্তা নাই। বেমালুম দাঁড়িয়ে থাকার পরে পকেটে মানিব্যাগটা আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তনু। কি যানজট! গাড়িগুলো কেমন বেপরোয়া কখন কার গায়ে তুলে দেয় ঠিক নাই। মাঝে মাঝে তনুর গাছ হতে ইচ্ছে করে। ঠাই দাঁড়িয়ে ব্যস্ত মানুষের দৌড় ঝাঁপ দেখে যেন মজাই লাগবে।

দুই. মন এক চঞ্চল মেয়ে। তনু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। চাকরি পাবার পর তার সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির পর মেয়েটা তনুকে ফোন দেয় না। প্যান্টের পকেটে বারবার হাত দেয় তনু। ভাবে হয়তো মোবাইলটা ভাইভ্রেট হচ্ছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। মোবাইলটা বের করে দেখে আসলেই কোনো কল আসেনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তনু। চারদিক উজ্জ্বল নিয়ন আলোতে আলেকিত হয়ে আছে শহর। তনু উঠেছে বন্ধুর কাছে। এসেই বাসা পাওয়া শক্ত ব্যাপার। ঢাকা শহর বলে কথা। বন্ধু পুলিশের চাকরি করে, তার ব্যারাকে উঠেছে। ব্যারাক বললে কেমন তাঁবু তাঁবু লাগে। এদের তো সুরম্য ভবন। পুলিশ টেলিকম ভবন। সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে বন্ধুর টেবিলে বসেছে। মোবাইলটায় যে মায়ের কল ছাড়া আর কোনো কল আসার চান্স নেই সেটা বুঝতে পেরে ডেস্কে রেখে দিল। তনুর কবিতা লেখার শখ অনেকদিনের। একটা কাগজ ও কলম নিয়ে বসেছে কিন্তু কোনো লাইনই তার কলম দিয়ে বের হচ্ছে না। বিরহে থাকলে নাকি কবিতা হয়। কোথায় কিছুইতো আসছে না তনুর কলমে। অবশ্য কবিতা এমন এক ব্যাপার। লিখতে চাইলেই ধুম করে লেখা যায় না। কলম হাতে নিলে শব্দের পর শব্দ আসে। আসে বাক্যের পর বাক্য কিন্তু কবিতা হয় না। চিন্তা কবিতার মোক্ষম শক্তি। চিন্তার সুষম বণ্টন তনুর অনেকদিন হচ্ছে না। চিন্তাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন যেন মৌলিকতা হারাচ্ছে। কবিতা না হলেও আজ তনুর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই সে লিখবে। গদ্য অন্তত হচ্ছে। অবশ্য গদ্যের মধ্যেও চিন্তার সুবণ্টন থাকা জরুরি। এতক্ষণ ধরে যা সে লিখলো তাতে নিজেই অসন্তুষ্ট। লেখাতে চিন্তার সুষম বণ্টন লন্ঠন জ্বালিয়েও খুঁজতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিন্তা করলো কেনইবা লিখছি? আমি না লিখলেও বাংলায় লেখার মানুষ কম নাই। কাগজটা হাতে মুচড়ে হাতের তালুতে গুঁজে নিল। ছোটবেলার মতো এই মোছড়ানো কাগজটা নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে ইচ্ছে করছে খুব। না তা করলো না, জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে কলমের দিকে চোখ রেখে সে বসে রইল। এভাবে থাকতেই হয়তো ভালো লাগছে। চিন্তা করছে জীবনে সে কতো কলম শেষ করেছে লিখতে লিখতে। স্কুলে থাকা অবস্থায় পরীক্ষার সময় গুনে গুনে শেষ হওয়া কলমগুলো জমিয়ে রাখতো। দেখতো কয়টা কলম শেষ করেছে এ পরীক্ষায়। লিখতে লিখতে হাতের মধ্যমাতে কলমের ভারে দাগ বসে যেত। আর এ কলমটি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। অবশ্য এখনতো আর পরীক্ষা দিতে হয় না। তবু এ কলমটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি তার চাকরি জীবনের প্রথম কলম। এটি দিয়ে কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে প্রতিদিন কিন্তু একটা কবিতা হয় না। এটাই তার কাছে দুঃখের। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। তনু বুঝতে পারলো মা-ই হবে। মন ফোন করবে না । মন মেয়েটার মন কঠিন শক্ত। ফোন করবেই না। ঝগড়া হবার পর তনু কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু মন রিসিভ করেনি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো মা-ই ফোন করেছে। মা শব্দটা সন্তানের জন্য কতোটা আশীর্বাদের তা বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক মতো খাচ্ছি কিনা? শরীর খারাপ করেনি তো? সারাদিন একটা ফোন দিসনি? এসব প্রশ্নের ধীরে ধীরে উত্তর দিতে লাগলো তনু। তনু নিচু স্বরে কথা বলছে শুনেও মায়ের উৎকন্ঠা। কি হয়েছে তোর এভাবে কথা বলছিস কেন? কোনো সমস্যা হয়নিতো? পৃথিবীতে এই একজন মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসে।

মা হারালেই পৃথিবীতে সন্তান যেন সব হারায়। তনু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার মায়ের মৃত্যু যেন সে না দেখে। তার আগেই যেন সে চলে যায়। তনুর এক বিবাহিত বন্ধুর বলা স্ত্রী ও মা নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার। বন্ধুটি ঢাকা থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গ্রামে ফেরার পর প্রথম দেখাতে মা বলেছিল। 'পথে কোনো সমস্যা হয়নিতো? হাত মুখ ধুয়ে আয় কিছু খেয়ে নেয় আর অন্যদিকে স্ত্রী প্রথম দেখাতে বললো_ঢাকা থেকে আসছ আমার জন্য কি এনেছ? এ হলো মা ও স্ত্রীর পার্থক্য। দুজনই কিন্তু বন্ধুটিকে খুব ভালোবাসে এটাই স্বাভাবিক। কার ভালোবাসা কিসে সেটা বলা যায় না। অবশ্য সবাইতো এক না। মানুষভেদে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তনু চিন্তা করলো বিয়েই করবে না কোনোদিন। সে নিজেকে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা তার খুব মনে পড়ছে- 'জীবনে হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও । সুখী হতে চাইলে বিয়ে করো আর বিয়ে না করলে মহৎ হবার পথ খোলা।' মায়ের ফোনটা রাখার পর তার আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। রাতের ঢাকার ফুটপাত বেয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো তনুর। তার পুলিশ বন্ধু এখনো ডিউটিতে আছে। রাতও হয়ে আসছে বেশ।

ব্যারাকের খাবার, সিদ্ধ চালের ভাত একদম ভালো লাগে না। বের হলে একেবারে হোটেল থেকে খেয়ে আসতে পারবে।

ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকার বাহারি বাতি ভালোই লাগে। রাজারবাগ টেলিকম ভবন হতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল, ফুটপাতে কিছু মহিলা তাঁবুতে রুটি ছেঁকে বিক্রি করছে। রিকশাওয়ালা এসে জঠরাগি্ন নিভিয়ে আবার কাজে নেমে পড়ছে। রুটিগুলো বড় বড় দেখতে ভালোই লাগছে। তনু ভাবলো একদিন এখানে বসে রুটি খেতে হবে, ভাজি দিয়ে। ঘর্মাক্ত এক রিকশাওয়ালা কি মজা করেই না খাচ্ছে। আর মহিলাটি পান চিবুতে চিবুতে একটার পর একাটা গরম রুটি নামিয়েই যাচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিশাল প্রশস্ত মাঠটি দেখতে ভালোই লাগছে। ফুটপাতের পাশেই একটি সুদৃশ্য মন্যুমেন্ট। নিয়ন আলোতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এটি একটি স্মৃতির ফলক, একাত্তরের ১৭ মার্চ এখানে সশস্ত্র বিদ্রোহে অনেক বাঙালি সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে এ মন্যুমেন্ট নির্মিত। তনু ভাবলো ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ গিয়ে ডিনারটা সেরে নেবে। ফুটপাতে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত। মরণ ফাঁদ যেন। পরিকল্পিত কোনো কিছুই যেন বাংলাদেশে হওয়ার নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাইবা কে করে? লুটেপুটে খাওয়ার তালে সবাই। আর একটু হলে তনু হয়তো গর্তে পড়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে কখন মালিবাগ মোড়ে চলে এসেছে তনু বুঝতেই পরেনি, ঢাকা শহরে একটাই জ্বালা। সব রাস্তা প্রায় একই ধরনের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো এটা মালিবাগ। একটা ছোট হোটেলে আগে খেয়েছিল সে। ওঠাতে যেতে হলে রাস্তাটা পার হতে হবে। যেই পার হতে যাবে হঠাৎ একটা ট্রাক এসে তনুর গা ঘেঁষে ব্র্যাক করলো। তনু যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো। কোনো মতে রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে চিন্তা করলো মরে গেলেই ভালো হতো। মনের কথা মনে পড়ল। মানুষ একা থাকা ভালো। প্রেম করে একা হবার মতো জ্বালা যেন আর কিছুই নেই। হয়তো সে কথা মাথায় আসতে সে এরকমটি ভাবছে। তনুর ভাবতে ভালো লাগছে।

সত্যিই যদি মরে যেতাম তাইলে কি কি হতো। মায়ের জন্যই তার বেশি খারাপ লাগতো। মা কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিত। মন মেয়েটা হয়তো একটু আফসোস করতো। পত্রিকায় খবর ছাপা হতো। মানিব্যাগে সুন্দর ছবি আছে পত্রিকায় ছাপাতো। পরিচিত জন আফসোস করতো। আমি মরে গেলে খুশি হতো এমন কেউকি পৃথিবীতে আছে? কারো ক্ষতি করার চিন্তা করিনি কোনোদিন। এসব চিন্তা করতে করতে একটা লোক গায়ে প্রায় ধাক্কা দিয়েই হেঁটে গেল। তনুর সম্বিৎ ফিরে আসলো। হোটেলে ডুকে তনুর ভাত আর খেতে ইচ্ছে হলো না। দুটি রুটি খেয়েই চলে আসলো পুলিশ বন্ধুর কোয়ার্টারে।

তিন.

আজ শনিবার। ব্যাংক বন্ধ। সকাল হতেই তনুর সবকিছু অন্যরকম লাগছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘুম ভাঙালো । শীত আসি আসি করে এখনো আসছে না। তবে শীতের একটি আমেজ যেন এ মিষ্টি রোদে। তনুর মনের সকল অনুভূতিতে গ্রাম খেলা করে। গ্রামে কাটানো শীতের দিনগুলো খুব মনে পড়ছে তনুর। এখন হয়তো গ্রামে শীত পড়ছে বেশ। শুধু ঢাকা শহরে শীত ঘেঁষতে পারছে না নাগরিক চাপে। তবুও আজকের সকালটা তনুকে বেশ আমোদ দিল। মনটা বেশ ফুরফুরে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মনকে একটা ফোন দিতে। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছেও করছে না আবার। আজ সারাদিন শহরে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে তনু। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরে সকালেই বেরিয়ে গেল। মনের সাথে তনুর প্রেমের প্রথম দিকের সময়গুলোর কথা মনে পড়ছে আজ। পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতেও তার খুব ভালো লাগছে। আকাশে নিবিড় তুলো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ফয়ে'স লেকের পাহাড়গুলোতে ঝিরিঝিরি হাওয়া। মনকে তনুর সেই প্রথম কিস্- অন্যরকম অনুভূতি খেলে যাচ্ছে দুজনার মাঝে। সেই প্রথম মন তনুর বুকে মাথা রেখে ভালবাসার গান শুনেছিল। অনেকক্ষণ কাটিয়েছে। ঐ দিনের অনুভূতি হয়তো কাউকে প্রকাশ করতে পারবে না। এসব চিন্তা করতে করতে তনু রাজারবাগ থেকে শান্তিনগর চলে এসেছে।

সে চিন্তা করলো আজ বেইলি রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পর্যন্ত চলে যাবে, আরো হাঁটতে ইচ্ছে করলে শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে ফুটপাতে বসে চা খেয়ে আসবে। এত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলল তনু। মন মেয়েটির মন কতো শক্ত কে জানে। একটা ফোনও কি দিতে পারে না। আবার তনুর মন খারাপ হয়ে গেল। যখন ঝগড়া হয় দুপক্ষেরই দোষ থাকে কম বেশি। শুধু তনুর দোষ তাতো নয়। তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মনেরও খুব কষ্ট হচ্ছে তার মতো। তনু পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে একটি এসএমএস দিল। 'কেমন আছে। তুমি অনেক নিষ্ঠুর। একটুও কি আমার খবর নিতে পারো না? ঢাকা এতো বড় শহর। কি করছি। কোথায় আছি। কেমন আছি। কিছুই কি জানতে ইচ্ছে করে না? ভালো থেকো।'

হাঁটতে হাঁটতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ফেলে, মিনিস্টারদের বাসভবন ফেলে একটা ব্যস্ততম রোডের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাটি পার হলেই ওপাশে রমনা পার্কের গেট। রাস্তাটি পার হতে গিয়ে যেই রাস্তার মাঝখানে, তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মন এর ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে গিয়ে হঠাৎ পা আগাতে ভুলে যায় তনু। রিসিভ বাটনে ক্লিক করতেই একটি কার সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। তনু রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। মন একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো । মন হ্যালো হ্যালো করতেই ফোনটা কেটে গেলো।

শান্তি শোভাময়

শান্তি শোভাময়

শেখর দেব
মনের অনিশ্চিত উতলজলে ভাসালে খেলার ভেলা। জলের গভীরে হারালে কে
তোমায় দেখাবে সৌন্দর্যের শোভা। তুমি যদি চাও হৃদয় নিংড়ে বানিয়ে দেব সঞ্জীবনী শুধা।
ভালোবাসার স্কুলে তোমার একলব্য হয়ে দিতে পারি আঙুলের বদলে হৃদয়-দক্ষিণা। 
আঙুল-জাদুর তুষ্টি নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিতে পারবে নির্বাণের নিঃশ্বাস।
 
কথার ছুঁতো ঝলঝলে করে কষ্ট নিও না মনে। অপার আকাশের নিচে সুখের নিঃশ্বাস নিয়ে
চলে যেতে পারো বিস্তৃত সবুজের ভেতর। খুঁজে পাবে শান্তির সুরায় আকাশ কীভাবে
থাকে নির্মল মেঘহীন। বৃক্ষের বোধ না বুঝে বোধির পাবে না সন্ধান। জানো-সেদিন
বোধিবৃক্ষের নিচে পেয়েছিলাম ভালোবাসার নির্বাণ। শান্তি শান্তি শান্তি শোভাময়।

সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

অনুবাদ কবিতা : শ্যারন ল্যামপার্ট-এর কবিতা






শ্যারন ল্যামপার্ট-এর কবিতা

সমগ্র দিবস একটি নতুন গানের


অনুবাদ : শেখর দেব
সমগ্র দিবস একটি নতুন গানের শ্যারন ল্যামপার্ট-এর কবিতা
অসম্ভব

বিষাক্ত দূষিত কিছু নিঃশ্বাসে টেনে নেয়া ছাড়া
বাতাসে বাঁচা অসম্ভব।

বিচিত্র রাসায়নিক আর ফরমালিন না খেলে
পুষ্টিকর খাবার গলাধঃকরণ অসম্ভব।

প্রিয়ার মানসিক জটিলতায় সজোরে ঝাঁকুনি না দিলে
ভালোবাসার সম্পর্ক টিকানো অসম্ভব।

এবং এটাও অসম্ভব শ্বাস-প্রশ্বাস, খাবার ও ভালোবাসাহীন।


অবিরাম সূর্যোদয়

সোনালি রোদের স্রোত
ঢুকে পড়ে জানালার নিচে

অবিরাম নিদ্রারত কেউ
কোন নতুন সূচনায় ওঠে জেগে

সূর্যোদয় শোভা উপভোগে
আলোর বিস্ফোরণে জেগে ওঠে স্বাপ্নিক

সূর্যালোকিত আকাশের উপরে
একটি পৃথিবীর পূর্বাভাস।

যা এখনো সৃষ্টি হয় নি।


মনের মানুষ

সমস্ত দিন আর সমস্ত রাতের ভালোবাসা আমার

প্রবল আবেগী ও দৃঢ় প্রিয় আমার, সমস্ত রাত্রির
মাঝে উপভোগ করি আবেগপ্রবণ, আত্মিক
এবং দৈহিক অস্থিত্ব; অনুভব করি
তার পৌরুষের উদারতা ও তীব্রতা।

সমগ্র রাতের ভেতর প্রিয় দৃঢ় বাহুবন্ধনে
ধরে রাখে: উষ্ণ, কচি ও ফুটফুটে শিশুসুলভ আমি
সব সময় বুঝি কোথায় আছি, অনন্ত আজীবন নিশ্চয়তায়।

প্রিয়ার ছোঁয়া দির্ঘস্থায়ী হয়,
সমগ্র রাত আরামের ঘুমে
ভালোবাসা বহমান
সুন্দর স্বপ্নের প্রণয়ে।

ভোরে প্রিয়ার নরম চুমুতে উঠি জেগে,
হৃদয় সকালের কুয়াশায় অবিকল ভাসে,
পূর্ণ হয়েছে প্রেমের প্রতিশ্রুতি আমার।
সমগ্র দিবস একটি নতুন গানের
সুরের গুঞ্জনে থাকে হৃদয় আমার।


কাব্যবৃক্ষ

কলমের প্রয়োজন কালি
কাগজের যেমন কলম
কাগজের প্রয়োজন কবিতা
কবিতার যেমন কবি
কবির প্রয়োজন ধ্যান
ধ্যানের যেমন কবি
কবির প্রয়োজন স্বর্গীয় প্রেরণা
স্বর্গীয় প্রেরণার ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন
ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ঐশ্বরিক করুণা
ঐশ্বরিক করুণার যেমন অমরত্ব
অমরত্বের  প্রয়োজন অনন্তকালের
অনন্তকালের প্রয়োজন অজস্র কবিতার পাঠক


সমাপিকা

দিনগুলো বাঁচে এবং মরে।
সূর্য ওঠে আর ডোবে।
ফুল ফোটে আর বিবর্ণ হয়।
ফল পাকে এবং নষ্ট হয়।
আইসক্রিম জমে এবং গলে।
মোমবাতি আলোকপাত করে এবং আনে আঁধার।
শক্তি উৎপন্ন হয় এবং হ্রাস পায়।
টাকা বানাই আর ব্যয় হয়।
সময় ব্যবহৃত ও ব্যয়িত হয়।
ভালোবাসা পোড়ায় শাশ্বত এবং অনুরাগ ক্ষীণ হয়।
জীবন চলে নিঃশ্বাসে এবং অবশেষে রুদ্ধশ্বাস।


একুশ শতকের সফলতা

ভূমিষ্ট হউন।
হয়ে উঠুন শিক্ষিত।
নিজের কাজে রাখুন ভালোবাসা।
নিজের জন্য রাখুন অর্থপূর্ণ অবদান,
পরিবার এবং মানবতার জন্যেও।
প্রিয়ার সাথে মিলিত হউন রতিসুখে।
সময় বের করুণ মজাদার ও ব্যঙ্গার্থক কিছু পড়ার।
পর্যাপ্ত অর্থ জমা করুণ জনপ্রিয় স্থান পরিদর্শনের,
পৃথিবীর চমৎকার ও শান্তিপূর্ণ  জায়গাগুলো।
সুন্দর সাহিত্যে ডুবে থাকুন, সুন্দর গানে থাকুন মজে,
ভালো শিল্পকলা দেখুন, ভালো ছবি দেখুন,
খেলুন মজার সব খেলা, নাচুন সন্ধ্যা পর্যন্ত,
পৃথিবীর মজাদার রান্নার নিন স্বাদ -
ধীরে ধীরে খান, প্রতি গ্রাসে নিন আনন্দ এবং থাকুন সুষম আকারে।
সাহসিক কোন পরিকল্পনায় রাখুন দৃঢ়তা।
উপভোগ করুণ প্রিয়ার নিঃশর্ত ভালোবাসা।
প্রথমে নিজে হউন নিজের সর্বোত্তম বন্ধু, ভালোবাসুন সম্পূর্ণ
উদ্দামতায়, কাউকে আপনার অর্থ দান করে দিন
ভালোবাসুন তাকে যে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে।
ঘুমের মাঝে হারিয়ে যান।

[কবি শ্যারন ল্যামপার্ট আমেরিকার নিউইয়র্ক-এ বাস করেন। তার পুরো নাম শ্যারন ইসথার ল্যামপার্ট। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক ও শিক্ষক।]

কিশোর গল্প : তিন নম্বর টিচার ও সিম্মি

কিশোর গল্প

তিন নম্বর টিচার ও সিম্মি


শেখর দেব
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
তিন নম্বর টিচার ও সিম্মি কিশোর গল্প
১.
দুর্জয় কিছু জানার আগেই তার তিন নম্বর স্যারটি বাসায় হাজির। বাবাও না পারে!  দু’ দুটো স্যার থাকা সত্ত্বেও কেন যে বাবা তিন নম্বর স্যারটা নিয়োগ দিলেন কিছুই বুঝতে পারছি না।
আজ দুর্জয়ের বাবা নতুন টিউটর নিয়ে এসেছে বাসায়। দুর্জয় দশম শ্রেণির ছাত্র। সায়েন্স নিয়েছে। দুটো টিচার মোটামুটি সব বিষয় পড়ায়। নতুন টিচারটা যে কি পড়াবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। দুর্জয় টিচারের কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে। নতুন টিচার বাসায় এলে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে হয় সেটাই ভুলে গেছে। অবশ্য মা মনে করিয়ে দিলেন যা টিচারকে প্রণাম করে আয়। প্রণাম করতে গিয়ে একটু ভুলই করে বসল, পা ছুঁয়ে প্রণাম না করে হাত জোড় করেই প্রণাম জানালো। টিচারের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হলো আশা করেছিলেন দুর্জয় পা ছুঁয়েই প্রণাম জানাবে। দুর্জয়ের ইচ্ছে করছিল ফিক করে একটা হাসি দেবে। পরিচয়ের শুরুতেই যেন টিচারকে একটা ডস খাইয়ে দিল। মনে মনে ভাবলো টিচারটা তাকে খারাপ ভেবে বসল নাতো? টিচার খারাপ ভাবলো কিনা সেটার চেয়ে বড়ো কথা হলো মা তো আজ ছাড়বে না। হাত জোড় করে প্রণাম করতে দেখে মা কিন্তু অলরেডি চোখ রাঙিয়ে তার দিকে একটি কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফেলেছে। মায়ের এ দৃষ্টির পর কি হতে পারে তা খুব ভালো করেই জানা আছে। জ্ঞান দান, তার সাথে চড়-থাপ্পড়।

টিচার আমাকে হাত ধরে বসতে বললেন। টিচারের মুখ দেখে মনে হলো তেমন মাইন্ড করেননি। জিজ্ঞেস করলো তুমি কোন ক্লাসে? দুর্জয় চাপা কণ্ঠে উত্তর দিল –ক্লাস টেনে। দুর্জয় মনে মনে ভাবলো আমি কোন ক্লাসে পড়ি সেটা তো টিচারের জানার কথা, স্যার হয়তো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না তাই এটা দিয়েই শুরু করলো। বাবার সাথে প্রাথমিক আলাপ সেরে সরাসরি পড়ার টেবিলে। তবে স্যার আজ পড়ালো না। নাম আর সিলেবাস সম্পর্কে কথা বলেই উঠে পড়লো। স্যার উঠে পড়লো দেখে দুর্জয় শান্তির নিশ্বাস ফেলে।

পড়া জিনিসটা ইদানীং দুর্জয়ের খুব বিরক্ত লাগছে। তিন তিনটে স্যার। তাছাড়া নতুন স্যারটি কেমন হবে, কি পড়াবে কিছুই জানে না। শুনেছে স্যার নাকি চাকরি করে। কীভাবে ইচ্ছে করে মানুষের চাকরি করে আবার বাসায় এসে মাস্টারি করার। অবশ্য স্যার শুক্র, শনি ও সপ্তাহের অন্য যে কোনো এক দিন পড়াবে বললেন। শুক্রবারটা ছিল ছুটির, কোন স্যার আসত না, এখন একদিনও শান্তি নাই। এসব চিন্তা ঘ‍ুরপাক খাচ্ছে দুর্জয়ের মাথায়। শুধু পড়ো পড়ো আর পড়ো, মা বাবার কাছে এটা ছাড়া কোনো কথা নেই। দুর্জয় বই নিয়ে বসে থাকে। কয়েক লাইন পড়ে সে অন্য চিন্তায় হারিয়ে যায়। খেলাটাও মনে হয় বন্ধ করে দিতে হবে। ইদানীং স্কুলে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে ভালো থাকে। সিম্মি নামের এক ক্লাসমেটকে দুর্জয়ের খুব ভালো লাগে। ক্লাসের ফাঁকে আড় চোখে তার দিকে তাকায়।
শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সিম্মি আজকাল খুব সুন্দর হয়ে  যাচ্ছে। তার কোঁকড়ানো চুলগুলো দুর্জয়ের খুব পছন্দ। সিম্মির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। অবশ্য দুর্জয় পড়ালেখায় ভালো হওয়ার কারণে সিম্মি মাঝে মাঝে তার কাছে এসে কেমন আছো এ জাতীয় প্রশ্ন করে। দুর্জয় কথা বাড়াতে পারে না। সে চলে যায়। কতো কথা মনে আসে কিন্তু সে কাছে আসলে দুর্জয় সব ভুলে যায়। কিছুই বলা হয় না। সিম্মি তাকে দুজী নামে ডাকে। দুর্জয়ের এ নামটি শুনলে বিরক্ত লাগে। কি সুন্দর তার নাম দুর্জয়, আর সে কিনা ডাকে দুজী।
বিরক্ত লাগলেও কিছু বলতে পারে না বা বলতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে বাট্টু বলেও ডাকে, তখন খুব রাগ হয়। দুর্জয়ের হাইট একটু কম। অবশ্য সিম্মির চেয়ে কম না। বাট্টু নামটা শুনলে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। আজকে সিম্মি তাকে বাট্টু নামে ডাকার কারণে গরম হয়ে বলে দিয়েছে তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না। সে চিন্তা করছে কাল স্কুলে গেলে সিম্মির সাথে একদম কথা বলবে না।

পিঠের উপর একটা থাপ্পড় খেয়ে দুর্জয়ের সম্বিৎ ফিরে আসল। পড়ালেখা না করে মানুষের ছবি আঁকছিস বলতে বলতে মা পিঠের উপর থাপ্পড়টা দিল। তাড়াতাড়ি দুর্জয় গোঁ গোঁ করে পড়া শুরু করলো। মা চলে যাবার পর দেখল সত্যিইতো সে ছবি আঁকছে। সিম্মির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে এই ছবিটা আঁকলো বুঝতেই পারলো না। টানা টানা দুটো চোখ, মাথা থেকে কোঁকড়ানো চুল কানের পেছন হতে মুখে এসে পড়েছে। হায় হায় একি করেছে সে! ভাগ্যিস মা খেয়াল করেনি আমি যে মেয়ের ছবি আঁকছি। তাড়াতাড়ি খাতার পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। নিউটনের গতির সূত্রটি পড়ছিল সে। স্যার বলেছিল বেশ মজার সূত্র। দুর্জয়ের তেমন মজা লাগে না।
তবে একদম মুখস্থ বলতে পারে। গতির তৃতীয় সূত্রটি খুব সহজ। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। ক্লাসে স্যার ভালো করে বুঝিয়েছেন। আমরা যদি দেয়ালে একটা ঘুষি মারি আমরা ব্যথা পাবো। কতো উদাহরণ দেওয়া যেতো কিন্তু স্যার ঘুষি মারার উদাহরণ দিল কেন বুঝলো না।

সিম্মিকে আমি বলে দিলাম তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। এটাতো একটা উদাহরণ হতে পারে। সে আমাকে বাট্টু ডেকেছে তাই আমি তাকে কথা না বলতে বললাম। এখানে সে যে আমাকে বাট্টু ডেকেছে এটা ক্রিয়া আর আমি তাকে আমার সাথে কথা না বলার জন্য বললাম এটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া। অবশ্য নিউটনের সূত্রে সমান ও বিপরীত কথাটা আছে। বাট্টু ডাকা ও কথা না বলতে বলা কি সমান হলো? মোটেই সমান মনে হচ্ছে না দুর্জয়ের কাছে। তাহলে সে কি একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া করে ফেললো? দুর্জয় আবার ভাবলো, বেশি হলে বেশিই হয়েছে, সে বাট্টু কেন ডাকবে? আমিতো দুজী ডাকতে নিষেধ করিনি। দুর্জয় বুঝতে পারলো সে পড়ালেখা ছেড়ে সেই আগের চিন্তায় ফিরে গেছে। না, পড়া লেখা করতে হবে নইলে হঠাৎ আবার একটা থাপ্পড় এসে পিঠে পড়বে। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে মায়ের গতিবিধি খেয়াল করে সে আবার পড়তে শুরু করলো।
২.
তিন নম্বর স্যারটা আজ আসবেন পড়াতে। আসার কথা সাতটায় কিন্তু সাতটা দশ বাজে এখনো আসছে না কেন কে জানে। বই নিয়ে বসে আছে দুর্জয়, পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এখন স্যার এসেতো পড়া শুরু করে দেবে, না আসা পর্যন্ত পড়ব না। তবে মাকে দেখানোর জন্য বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সে। স্যার এসেছে সাতটা বিশে। প্রথম দিন লেইট, এ কেমন স্যার। দুর্জয় আবার হাত জোড় করে প্রণাম জানালো। স্যারকে দেখে খুব কম বয়সী মনে হচ্ছিল। অন্য দু’টা স্যারতো এখনো পড়ালেখা করেন, দেখতে এই স্যারের চেয়েও বয়সী মনে হয়। উনি নাকি আবার চাকরিও করে। এত অল্প বয়সে পড়ালেখা শেষ করলো কীভাবে। আজ যদি স্যারকে ভালো না লাগে সরাসরি বাবাকে বলে দিব এ স্যারের কাছে পড়ব না, ভালো করে পড়াতে জানে না। গতদিন তিনি এসে বেশিক্ষণ ছিলো না। শুধু কোন ক্লাসে পড়ি জিজ্ঞেস করেছিল। দুর্জয়ের প্রথমেই স্যারকে ভালো লাগলো না। চেয়ারে বসেই সিলেবাস নিতে বললো, কোথায় নাম-দাম জিজ্ঞেস করবে, নিজের পরিচয় দিবে। অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই নাম জিজ্ঞেস করলো। দুর্জয় খুব ট্যালেন্ট স্টুডেন্টের মতো ভাব নিয়ে বললো দুর্জয়। দুর্জয় মোটা ফ্রেমের চশমা পরে, যা তাকে ব্রিলিয়ান্ট ব্রিলিয়ান্ট ভাব এনে দিয়েছে চেহারায়। বন্ধুরাও তাই বলে। স্যার নিজের নাম বললো। অনিক। নাম খারাপ না র্স্মাট আছে দুর্জয় ভাবলো কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললো না। স্যার বললো তোমার নামটা সুন্দর কিন্তু কমন নেইম। দুর্জয় অর্থ কি জানো? দুর্জয়ের সোজা উত্তর যা জয় করা যায় না। তাই নাকি কেউ তাহলে এখনো তোমাকে জয় করতে পারেনি। স্যার এটা কি বললো, আমাকে আবার জয় করবে কে? অবশ্য আপনি এখনো জয় করতে পারেননি, সিম্মি হয়তো জয় করেছে আমাকে। মনে মনে বললো দুর্জয়। স্যার আবার জিজ্ঞেস করলো এক শব্দে বলতো তোমার নামের অর্থ। দুর্জয়ের  ততক্ষণে রাগ উঠছিল খুব। মনে মনে ভাবছে আমার নাম নিয়ে এতো টানাটানি কেন? পড়াতে আসছ পড়াও না ব্যাটা। স্যারকে ব্যাটা বলা ঠিক হলো! অবশ্য মনে মনে বলেছে। তবুও ঠিক হয়নি। সরাসরি উত্তর জানিনা স্যার। অজেয়, অদম্য। মনে রাখবে। ভবিষ্যতে কাজ দিবে। দুর্জয় মনে মনে আবার বললো আপনি কি আমাকে বাংলা পড়াবেন। বাংলার স্যার। মধু স্যারের মতো। মধু স্যার হলো দুর্জয়ের স্কুলের বাংলার স্যার। যেমন নাম মধু তেমন কাজেও। যে সহে সে রহে ভাবসম্প্রসারণ নিয়েই একটি ক্লাস শেষ। অবশ্য ওনার নামতো অনিক। দুর্জয়ের ইচ্ছে হলো স্যারকে জিজ্ঞেস করতে  অনিক অর্থ কি? কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না, প্রথম দিন বলে কথা, পাছে বেয়াদবি হয়ে যায়। মানুষ মনে মনে আনেক কিছু চিন্তা করতে পারে, অন্য কেউ কিছু বুঝতে পারে না। এটা খুব মজার, স্যারও বুঝতে পারলো না, আমি কত কিছু ভাবলাম। ভেবে দুর্জয়ের ভালো লাগলো। স্যার সিলেবাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
তোমার অংক বইটা নাও, অংক দিয়ে শুরু করি। নাইনে অংকে কোনদিন এ প্লাস পেয়েছ? দুর্জয়ের সোজা উত্তর না, স্কুলের টিচাররা নম্বর দেয় না স্যার। ফুল উত্তর করলেও দেয় না। স্যার অবাক হয়ে বললো কেন, নম্বর দেয় না কেন?  আমি স্যার অংক সংক্ষেপে করিতো তাই।
অংক আবার সংক্ষেপে কীভাবে করো? দুর্জয় আবার বললো মাঝখান থেকে কিছু লাইন বাদ চলে যায় আরকি। তার মানে তোমার অংক হয় না, তাই নম্বর পাও না, স্যারের দোষ দিচ্ছ কেন? দেখি বলতো সেট কি? স্যার সেট কি কখনো তো পরিনি, তবে কাপ, কেপ পড়েছি। দুর্জয়ের সোজা উত্তর।
কেন তোমার অন্য দুই টিচারকি কোনোদিন বলেনি সেট কি? না স্যার। আজ স্যার দুই ঘণ্টা পড়ালো কোনো বই খুললো না। অবশ্য দুই ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা ছিল উপদেশ। দুর্জয়ের খারাপ লাগলো না। এটা বুঝতে পারলো অন্য দুই টিচারের চেয়ে ওনি ভালো পড়াতে পারেন। দুই ঘণ্টা চলে গেল দুর্জয় বুঝতেই পারলো না। অন্য টিচারগুলোর এক ঘণ্টাও পার হতে চায় না।
৩.
মায়ের অবিরাম পড় পড় ভালো লাগেনা দুর্জয়ের। সামনের বছর এসএসসি, খেলাও বন্ধ, টিভি দেখাও বন্ধ। অবশ্য ইদানীং খেলা আর টিভির চেয়ে সিম্মির কথা ভাবতেই খুব ভালো লাগে তার। ক্লাসের তারেক ছেলেটা একদমই গুণ্ডা। সিম্মির দিকে নজর দিয়েছে। তারেক ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের চেয়ে বয়সে ও সাইজে দুটাতেই বড়ো। তার সাথে তর্কে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তবে দুর্জয়ের খুব খারাপ লাগে। সিম্মিতো ক্লাসে শুধু আমার সাথেই কথা বলে। তারেক একদমই গুণ্ডা, সিম্মির সাথে গায়ে পড়ে কথা বলে। দুর্জয়কে হুমকি দেয় তুই ওর সাথে কথা বলবি না। সিম্মি আমার। দুর্জয়ের খুব রাগ হয়। তুই কি ব্যাটা তাকে কিনে  এনেছিস যে তোর জিনিস। বেয়াদব কোথাকার মেয়েরা কি জিনিস? ওরাতো তোর আমার মতো মানুষ। এসব কথা দুর্জয় মনে মনে বললো। কেন যে দুর্জয় মুখ ফুটে এসব কথা বলতে পারে না। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল তার। স্যারের পড়া পড়তে হবে। মায়ের বকুনিতো সবসময় লেগেই আছে। যতো বড়ো হচ্ছি ততো নাকি ডামিশ হয়ে যাচ্ছি।

সিম্মি আর দুর্জয় একসাথে হাটঁছে, তবে কোন জায়গায় হাঁটছে ঠিক বুঝতে পারছে না। জায়গাটা খুব সুন্দর। কেউ নেই আশে-পাশে। এটাতো স্কুলও না। খুব ভালো লাগছে দুর্জয়ের এভাবে সিম্মিকে কোনো দিন একা পায়নি। সিম্মিকে যে তার খুব ভালো লাগে আজই তো বলার সময়। মনে মনে ঠিক করলো একটু পরেই বলে দিবে ভালো লাগার কথা। সিম্মিকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। তার কোঁকড়ানো চুলগুলো বাতাসে দুলছে। তার হাসিটি দেখলে মনে হয় শুধু তাকিয়ে থাকি। অদ্ভুত মায়া। সিম্মি তোমাকে একটা কথা বলবো। সিম্মি বললো বলো। উল্টা কোনো প্রশ্ন না করেই সিম্মি বলার অনুমতি দিয়ে দিল। সিম্মিতো কথা বললেই উল্টো আর একটা কথা জুড়ে দেয়। আজ তার মন হয়তো ভালো। সিম্মি তোমাকে আমার...। চুপ হয়ে গেলে কেন? তোমাকে আমার...। যেই দুর্জয় মনের কথাটা বলতে যাবে। পিঠের উপর পড়লো এক থাপ্পড়। হারামজাদা পড়ার টেবিলে বসে না পড়ে ঘুমাস। দুর্জয়ের ঘুম ভেঙে গেল। সিম্মি উধাও। হায় আমি পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে গেছি।

সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০১৩

পরিষ্কার আঁধার

পরিষ্কার আঁধার

আঁধার মানে আলোর চেয়ে বেশি কিছু
আলোকিত চারপাশ - পরিষ্কার নয় সবকিছু
আঁধারে হারানো হলো অদৃশ্য আলোর ভেতর ডুবে যাওয়া
দৃশ্যমান দুনিয়ায় কতোটা ধরে চোখে
আঁধারে যতোটা ধরে অফুরান
তার ভেতর অনাবিল সুন্দর - পরিষ্কার আঁধার
আঁধারে যতো আনন্দ তার কিছুই নেই আলোতে
চলো আঁধারে বাধিঁবো ঘর - আঁধারে আদর

এটি কবিতা নয় শান্তি

এটি কবিতা নয় শান্তি

কিছু কথা একদম কবিতা হয় না
অথবা কিছু খুব কবিতা
মোক্ষলাভের একটি ব্যাপার নিয়ে হয় না কবিতা
তখন নির্বাণের কথা বলে দেখি কি হয়
কোন কিছুতে ফিদা হবার অমোঘ ঘটনা ফাঁস করে দিলে
কবিতা হয়ে যাবে
আজকাল নিজেকে বড়ো বেশি কবিতা কবিতা মনে হয়
জাগতিক স্রোতের প্রতিকূলে হেঁটে লাগে বেশ
তোমাকে বোঝার চেষ্টা কবিতার থিসিস
অর্থহীন তুমি ঘোর মায়াময় গুহা
গুহার ভেতরে কবিতা নয় বরং মদের দেহ দরিয়া
মোক্ষলাভ বা নির্বাণ কোনটাই হবে না বাকি জীবনে
হতে পারে কবিতা - কবিতা জীবন অথবা জীবন কবিতা
কোন কিছুই কবিতা মনে হয় না
অথবা সবকিছুই কবিতা
মানুষ কবিতা নয় বড়ো বেশি শান্তি খোঁজে
এটি কবিতা নয় শান্তি
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি...

ঘুমকাব্য

ঘুমকাব্য

ভোর  হলেই ঘুম ভাঙানোর অপেক্ষায় শুয়ে থাকো অনাবিল আনন্দের ভেতর
বালিশের অবিকল একটা স্বপ্ন মাথায় গুঁজে নড়ে চড়ে ওঠো
হাসির বিস্তার ঘটে নীরবে - জেগে জেগে চুষে নাও স্বপ্নের মধু।

তোমার দেহে জাগরণের সৌরভ নেবো বলে একবার
ঘুম ভাঙনিয়া পাখি স্বপ্ন চুরি করে পালালো
সমূহ সমর্পন জ্বালা নিয়ে শেষে
খুঁজেছো ঘুমের আমোদ বালিশে বালিশে অবিরাম
এখন সারারাত জেগে জেগে কাটে - ঘুম আসে ভোরে শিশিরের অবিকল।

নিস্বার্থ প্রয়াস

নিস্বার্থ প্রয়াস

কতোটা রিক্ত করে তোমাকে দিলে
মন
বলবে করেছি কিছু তবে
প্রাধান্যের মাত্রা কতোটা গভীর হলে
একবার
বলবে তবে করেছি
হাতের মুঠোয় গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে
যেই তোমাকে দেখাই
বায়বীয় হয় সমস্ত প্রয়াস।

স্বার্থের  সুতো তোমার হাতে দিয়ে
বলেছি:
বড়ো বেশি তুমি আমার
আলিঙ্গনের ভেতর
ফুলের মতো ফুটে থাকা নরোম যুগলে
ঠোঁটের নিস্বার্থ প্রয়াসে তুমি আন্দোলিত হলে
নিবিড় নীরবতায় খুঁজে পাও অনিন্দ্য আমেজ
বলো: ভালোবাসি ভালোবাসি প্রাণনাথ।

রাহুশনিময়

রাহুশনিময়

নতুন জীবনের কথা শুনেছি কতো
রহস্যের ধারাপাতে
জন্মাবধি দৈহিক সুখে লেগেছে শনি
কিংবা রাহুর রাত্রি
অথবা
দুইয়ের মিলনে হয়েছে শুভাশুভ সব ভণ্ডুল
ছোটবেলায় ছাগশিশুর বদলে
শনির কাছে ভিক্ষে চেয়েছে অনন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যত
তীব্র কাঁপন দিয়ে জ্বর এলে
মাকে দেখেছি দিশেহারা
মনের মানসে।

সেদিন মশার পিঠে চড়ে এলো রাহু
শনিসমেত শুরু হলো তাণ্ডব
মা কালি তার লকলকে জিবে চেটে নিবে সব...
সেদিন জোড়া কবুতরের বিনিময়ে
মা  ভিক্ষে নিয়ে এলো
নতুন জীবন।

অদৃশ্য শূন্যতায় চলে রাহুশনিময় সংসার
এসবের কিছুই বুঝিনা সাংসারিক কারবার।

শুকানো শিহরণ

শুকানো শিহরণ

শিউলি ফুলের আবেগ পকেটে রেখে এসেছি মুগ্ধতালয়ে
ইঙ্গিত-কলা বোঝাবার ভাষা বোঝনি তেমন
হিসেবের খাতায় এঁকেছি ব্যর্থতার ফুল
পকেটেই শুকালো শিউলি
বেলা যেতে যেতে উঁকি দেয় বাড়ন্ত বুক - শিহরণ জ্বালা
তবু ছিলাম কাছে তার গাঁথা হলো না কোন মালা।

এতদিন পর কেন তবে ডাকো
শিউলি আর ফোটেনা তেমন
পকেটে নীরবে শুকালো যৌবন...

এখন কেন কথার ঝুড়ি উছলে ওঠে বুকের বাঁকে
ঠোঁটের মায়া নিয়ে গেছে অন্য বুকের কোমল গানে
ডেকোনা আর নষ্ট নীড়ের সুখের মোড়ে
আছিতো বেশ প্রিয়ার বুকে কারণে বা অকারণে।