তনুতে চপল মন
শেখর দেব
একা
হবার মাঝে মজা আছে। কেমন মজা সেটা? পৃথিবীর সবকিছুই একা। এ গ্রহটিকে সঙ্গ
দেয়ার জন্য অন্য কোনো গ্রহ কি তার বুকে এসেছিল? সবাই তফাতে তফাতে চলছে যে
যার মতো। পৃথিবীর মতো সবকিছুই ভীষণ একা। তনুর ইদানীং খুব একা লাগছে। এখন
সে একাকিত্বের মজা খুঁজতে ব্যাকুল। জনমানবশূন্য কোনো স্থানে একা নয় বরং
অপরিচিত মুখের ভিড়ে একা। তনুকে কেউ চিনে না, সেও কাউকে চিনে না। ছোটবেলায়
মা-বাবার বকা খেয়ে এরকম কোন স্থানে চলে আসতে ইচ্ছে হতো তার। আজ মা-বাবাই
তাকে আদর করে এরকম জায়গায় পাঠিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত ও ব্যর্থ মানুষরা একা হতে
চায়। তবে এটাও ঠিক, ব্যর্থতা বা সফলতা দুটুই হতাশা আনায়নের বাহক হতে পারে।
মন বলে কথা! মনের মৌনতা কিংবা সরবতা দেখে মনকে বোধগম্য করা কঠিন।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠীকে বক রূপি যম প্রশ্ন করেছিল পৃথিবীতে কোনো জিনিসের
গতি সবচেয়ে বেশি? যুধিষ্ঠীর উত্তর ছিল মন। প্রশ্নের সঠিক উত্তরে খুশি হয়ে
যমরাজ মৃত্যুপথযাত্রী ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহাভারতের গল্প এটি। মনের
গতি সত্যিই অকল্পনীয়। তনু চাইলেই সে তার তরুছায়া সুনিবিড় গ্রাম ঘুরে আসতে
পারে নিমেষে, তনু চোখ বন্ধ করলো, এই সেই মাটির দু'তলা বাড়ি, সামনে উঠোন,
শান বাঁধানো ঘাট, উঠোনের কোনায় গন্ধরাজের বাগান, দাওয়ায় বসে গন্ধরাজের
ঘ্রাণে মন মাতাল হয়ে আসে। উঠোনজুড়ে নানান খেলা। তনুর মন তার গ্রামের
বাড়িতে ফিরেছে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে। তনু ভাবলো আমিতো ছোট নই। এই বয়সে
গ্রামে গেলে আমি কি ঠিক আগের মতো মাতাল হবো? মিশে যেতে পারবো মাটির
সাথে? মনে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তনু একজনকে খুব ভালোবাসে। অনেকদিন সে
ফোন করে না। তনু হয়তো তাই একা অনুভব করছে খুব, একাকিত্ব নিয়ে মোটামুটি
একটি থিসিস রেডি করছে যেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে করা থিসিসের চেয়েও যেন এটা
কঠিন।
তনু কিছুদিন হলো চাকরিসূত্রে ঢাকা এসেছে। জীবনের প্রথম চাকরি বলে কথা। চারদিকে অপরিচিত মুখ। পরিচিত মুখগুলো ফেলে জীবিকার টানে চলে আসা। এ দেশে চাকরির যে হাল : ব্যাংকের চাকরি বলে কথা। ঢাকা অদ্ভুত শহর তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার কথা মনে হলো তার 'শহর শহর ঢাকা শহর/আজব শহর ঢাকা'। মানুষ আর মানুষ। আসলেই আজব। শুধু মাথা আর মাথা কারো মুখ কেউ দেখার ফুরসত নেই। তনু মাঝে মাঝে চুপ মেরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর ছুটে চলা দেখে। কি নিরন্তন ছুটে চলা। মৃত্যু হয়তো এর শেষ গন্তব্য। ফুটপাতে দিনাতিপাতে রত হাজারো মানুষ। কেউ ছুটছে কোটি টাকার পেছনে আবার কেউ শুধু একা থালা ভাত। ফুটপাতে কি দুর্বিষহ জীবন মানুষের। মৌলিক চাহিদার ছিটে ফোঁটাও তারা পায় না। বাংলাদেশ। এই দেশটির কি কোনো পরিবর্তন হবে না? রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে তনুর ঘেন্না হয়। নেতানেত্রীরা নোংরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। হাসিনা আর খালেদা নামের দুটি পথে জনগণ শুধু চলছে তো চলছে। কখনো খালেদার কাছে আবার কখনো হাসিনার কাছে কিন্তু দেশ সেই একই হালে যেই লাউ সেই কদু্। বাঙালির বুক ভরা আবেগ। জাতির পিতা হতে উত্তরাধিকার সূত্রে এ আবেগ পেয়েছে। কখন বাঙালি ভালো থাকে বা মন্দে থাকে তাদের নিজেদের কাছেও বোধগম্য নয়। চারদিকের মানুষগুলো যেন মুখোশ। মুখোশের এক রূপ, খুলে দিলে অন্য রূপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি সব চিন্তা করে যাচ্ছে তনু। চারদিকে প্রচুর হট্টগোলের মাঝেও যেন তার মাঝে অনাবিল নীরবতা। এতোক্ষণ পর তার কানে লাগলো এসব হট্টগোল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো মানিব্যাগটি আছে কিনা। এ শহরে কখন পকেট থেকে মানিব্যাগ চলে যাবে তার ইয়ত্তা নাই। বেমালুম দাঁড়িয়ে থাকার পরে পকেটে মানিব্যাগটা আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তনু। কি যানজট! গাড়িগুলো কেমন বেপরোয়া কখন কার গায়ে তুলে দেয় ঠিক নাই। মাঝে মাঝে তনুর গাছ হতে ইচ্ছে করে। ঠাই দাঁড়িয়ে ব্যস্ত মানুষের দৌড় ঝাঁপ দেখে যেন মজাই লাগবে।
দুই. মন এক চঞ্চল মেয়ে। তনু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। চাকরি পাবার পর তার সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির পর মেয়েটা তনুকে ফোন দেয় না। প্যান্টের পকেটে বারবার হাত দেয় তনু। ভাবে হয়তো মোবাইলটা ভাইভ্রেট হচ্ছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। মোবাইলটা বের করে দেখে আসলেই কোনো কল আসেনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তনু। চারদিক উজ্জ্বল নিয়ন আলোতে আলেকিত হয়ে আছে শহর। তনু উঠেছে বন্ধুর কাছে। এসেই বাসা পাওয়া শক্ত ব্যাপার। ঢাকা শহর বলে কথা। বন্ধু পুলিশের চাকরি করে, তার ব্যারাকে উঠেছে। ব্যারাক বললে কেমন তাঁবু তাঁবু লাগে। এদের তো সুরম্য ভবন। পুলিশ টেলিকম ভবন। সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে বন্ধুর টেবিলে বসেছে। মোবাইলটায় যে মায়ের কল ছাড়া আর কোনো কল আসার চান্স নেই সেটা বুঝতে পেরে ডেস্কে রেখে দিল। তনুর কবিতা লেখার শখ অনেকদিনের। একটা কাগজ ও কলম নিয়ে বসেছে কিন্তু কোনো লাইনই তার কলম দিয়ে বের হচ্ছে না। বিরহে থাকলে নাকি কবিতা হয়। কোথায় কিছুইতো আসছে না তনুর কলমে। অবশ্য কবিতা এমন এক ব্যাপার। লিখতে চাইলেই ধুম করে লেখা যায় না। কলম হাতে নিলে শব্দের পর শব্দ আসে। আসে বাক্যের পর বাক্য কিন্তু কবিতা হয় না। চিন্তা কবিতার মোক্ষম শক্তি। চিন্তার সুষম বণ্টন তনুর অনেকদিন হচ্ছে না। চিন্তাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন যেন মৌলিকতা হারাচ্ছে। কবিতা না হলেও আজ তনুর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই সে লিখবে। গদ্য অন্তত হচ্ছে। অবশ্য গদ্যের মধ্যেও চিন্তার সুবণ্টন থাকা জরুরি। এতক্ষণ ধরে যা সে লিখলো তাতে নিজেই অসন্তুষ্ট। লেখাতে চিন্তার সুষম বণ্টন লন্ঠন জ্বালিয়েও খুঁজতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিন্তা করলো কেনইবা লিখছি? আমি না লিখলেও বাংলায় লেখার মানুষ কম নাই। কাগজটা হাতে মুচড়ে হাতের তালুতে গুঁজে নিল। ছোটবেলার মতো এই মোছড়ানো কাগজটা নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে ইচ্ছে করছে খুব। না তা করলো না, জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে কলমের দিকে চোখ রেখে সে বসে রইল। এভাবে থাকতেই হয়তো ভালো লাগছে। চিন্তা করছে জীবনে সে কতো কলম শেষ করেছে লিখতে লিখতে। স্কুলে থাকা অবস্থায় পরীক্ষার সময় গুনে গুনে শেষ হওয়া কলমগুলো জমিয়ে রাখতো। দেখতো কয়টা কলম শেষ করেছে এ পরীক্ষায়। লিখতে লিখতে হাতের মধ্যমাতে কলমের ভারে দাগ বসে যেত। আর এ কলমটি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। অবশ্য এখনতো আর পরীক্ষা দিতে হয় না। তবু এ কলমটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি তার চাকরি জীবনের প্রথম কলম। এটি দিয়ে কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে প্রতিদিন কিন্তু একটা কবিতা হয় না। এটাই তার কাছে দুঃখের। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। তনু বুঝতে পারলো মা-ই হবে। মন ফোন করবে না । মন মেয়েটার মন কঠিন শক্ত। ফোন করবেই না। ঝগড়া হবার পর তনু কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু মন রিসিভ করেনি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো মা-ই ফোন করেছে। মা শব্দটা সন্তানের জন্য কতোটা আশীর্বাদের তা বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক মতো খাচ্ছি কিনা? শরীর খারাপ করেনি তো? সারাদিন একটা ফোন দিসনি? এসব প্রশ্নের ধীরে ধীরে উত্তর দিতে লাগলো তনু। তনু নিচু স্বরে কথা বলছে শুনেও মায়ের উৎকন্ঠা। কি হয়েছে তোর এভাবে কথা বলছিস কেন? কোনো সমস্যা হয়নিতো? পৃথিবীতে এই একজন মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসে।
মা হারালেই পৃথিবীতে সন্তান যেন সব হারায়। তনু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার মায়ের মৃত্যু যেন সে না দেখে। তার আগেই যেন সে চলে যায়। তনুর এক বিবাহিত বন্ধুর বলা স্ত্রী ও মা নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার। বন্ধুটি ঢাকা থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গ্রামে ফেরার পর প্রথম দেখাতে মা বলেছিল। 'পথে কোনো সমস্যা হয়নিতো? হাত মুখ ধুয়ে আয় কিছু খেয়ে নেয় আর অন্যদিকে স্ত্রী প্রথম দেখাতে বললো_ঢাকা থেকে আসছ আমার জন্য কি এনেছ? এ হলো মা ও স্ত্রীর পার্থক্য। দুজনই কিন্তু বন্ধুটিকে খুব ভালোবাসে এটাই স্বাভাবিক। কার ভালোবাসা কিসে সেটা বলা যায় না। অবশ্য সবাইতো এক না। মানুষভেদে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তনু চিন্তা করলো বিয়েই করবে না কোনোদিন। সে নিজেকে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা তার খুব মনে পড়ছে- 'জীবনে হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও । সুখী হতে চাইলে বিয়ে করো আর বিয়ে না করলে মহৎ হবার পথ খোলা।' মায়ের ফোনটা রাখার পর তার আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। রাতের ঢাকার ফুটপাত বেয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো তনুর। তার পুলিশ বন্ধু এখনো ডিউটিতে আছে। রাতও হয়ে আসছে বেশ।
ব্যারাকের খাবার, সিদ্ধ চালের ভাত একদম ভালো লাগে না। বের হলে একেবারে হোটেল থেকে খেয়ে আসতে পারবে।
ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকার বাহারি বাতি ভালোই লাগে। রাজারবাগ টেলিকম ভবন হতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল, ফুটপাতে কিছু মহিলা তাঁবুতে রুটি ছেঁকে বিক্রি করছে। রিকশাওয়ালা এসে জঠরাগি্ন নিভিয়ে আবার কাজে নেমে পড়ছে। রুটিগুলো বড় বড় দেখতে ভালোই লাগছে। তনু ভাবলো একদিন এখানে বসে রুটি খেতে হবে, ভাজি দিয়ে। ঘর্মাক্ত এক রিকশাওয়ালা কি মজা করেই না খাচ্ছে। আর মহিলাটি পান চিবুতে চিবুতে একটার পর একাটা গরম রুটি নামিয়েই যাচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিশাল প্রশস্ত মাঠটি দেখতে ভালোই লাগছে। ফুটপাতের পাশেই একটি সুদৃশ্য মন্যুমেন্ট। নিয়ন আলোতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এটি একটি স্মৃতির ফলক, একাত্তরের ১৭ মার্চ এখানে সশস্ত্র বিদ্রোহে অনেক বাঙালি সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে এ মন্যুমেন্ট নির্মিত। তনু ভাবলো ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ গিয়ে ডিনারটা সেরে নেবে। ফুটপাতে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত। মরণ ফাঁদ যেন। পরিকল্পিত কোনো কিছুই যেন বাংলাদেশে হওয়ার নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাইবা কে করে? লুটেপুটে খাওয়ার তালে সবাই। আর একটু হলে তনু হয়তো গর্তে পড়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে কখন মালিবাগ মোড়ে চলে এসেছে তনু বুঝতেই পরেনি, ঢাকা শহরে একটাই জ্বালা। সব রাস্তা প্রায় একই ধরনের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো এটা মালিবাগ। একটা ছোট হোটেলে আগে খেয়েছিল সে। ওঠাতে যেতে হলে রাস্তাটা পার হতে হবে। যেই পার হতে যাবে হঠাৎ একটা ট্রাক এসে তনুর গা ঘেঁষে ব্র্যাক করলো। তনু যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো। কোনো মতে রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে চিন্তা করলো মরে গেলেই ভালো হতো। মনের কথা মনে পড়ল। মানুষ একা থাকা ভালো। প্রেম করে একা হবার মতো জ্বালা যেন আর কিছুই নেই। হয়তো সে কথা মাথায় আসতে সে এরকমটি ভাবছে। তনুর ভাবতে ভালো লাগছে।
সত্যিই যদি মরে যেতাম তাইলে কি কি হতো। মায়ের জন্যই তার বেশি খারাপ লাগতো। মা কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিত। মন মেয়েটা হয়তো একটু আফসোস করতো। পত্রিকায় খবর ছাপা হতো। মানিব্যাগে সুন্দর ছবি আছে পত্রিকায় ছাপাতো। পরিচিত জন আফসোস করতো। আমি মরে গেলে খুশি হতো এমন কেউকি পৃথিবীতে আছে? কারো ক্ষতি করার চিন্তা করিনি কোনোদিন। এসব চিন্তা করতে করতে একটা লোক গায়ে প্রায় ধাক্কা দিয়েই হেঁটে গেল। তনুর সম্বিৎ ফিরে আসলো। হোটেলে ডুকে তনুর ভাত আর খেতে ইচ্ছে হলো না। দুটি রুটি খেয়েই চলে আসলো পুলিশ বন্ধুর কোয়ার্টারে।
তিন.
আজ শনিবার। ব্যাংক বন্ধ। সকাল হতেই তনুর সবকিছু অন্যরকম লাগছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘুম ভাঙালো । শীত আসি আসি করে এখনো আসছে না। তবে শীতের একটি আমেজ যেন এ মিষ্টি রোদে। তনুর মনের সকল অনুভূতিতে গ্রাম খেলা করে। গ্রামে কাটানো শীতের দিনগুলো খুব মনে পড়ছে তনুর। এখন হয়তো গ্রামে শীত পড়ছে বেশ। শুধু ঢাকা শহরে শীত ঘেঁষতে পারছে না নাগরিক চাপে। তবুও আজকের সকালটা তনুকে বেশ আমোদ দিল। মনটা বেশ ফুরফুরে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মনকে একটা ফোন দিতে। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছেও করছে না আবার। আজ সারাদিন শহরে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে তনু। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরে সকালেই বেরিয়ে গেল। মনের সাথে তনুর প্রেমের প্রথম দিকের সময়গুলোর কথা মনে পড়ছে আজ। পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতেও তার খুব ভালো লাগছে। আকাশে নিবিড় তুলো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ফয়ে'স লেকের পাহাড়গুলোতে ঝিরিঝিরি হাওয়া। মনকে তনুর সেই প্রথম কিস্- অন্যরকম অনুভূতি খেলে যাচ্ছে দুজনার মাঝে। সেই প্রথম মন তনুর বুকে মাথা রেখে ভালবাসার গান শুনেছিল। অনেকক্ষণ কাটিয়েছে। ঐ দিনের অনুভূতি হয়তো কাউকে প্রকাশ করতে পারবে না। এসব চিন্তা করতে করতে তনু রাজারবাগ থেকে শান্তিনগর চলে এসেছে।
সে চিন্তা করলো আজ বেইলি রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পর্যন্ত চলে যাবে, আরো হাঁটতে ইচ্ছে করলে শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে ফুটপাতে বসে চা খেয়ে আসবে। এত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলল তনু। মন মেয়েটির মন কতো শক্ত কে জানে। একটা ফোনও কি দিতে পারে না। আবার তনুর মন খারাপ হয়ে গেল। যখন ঝগড়া হয় দুপক্ষেরই দোষ থাকে কম বেশি। শুধু তনুর দোষ তাতো নয়। তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মনেরও খুব কষ্ট হচ্ছে তার মতো। তনু পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে একটি এসএমএস দিল। 'কেমন আছে। তুমি অনেক নিষ্ঠুর। একটুও কি আমার খবর নিতে পারো না? ঢাকা এতো বড় শহর। কি করছি। কোথায় আছি। কেমন আছি। কিছুই কি জানতে ইচ্ছে করে না? ভালো থেকো।'
হাঁটতে হাঁটতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ফেলে, মিনিস্টারদের বাসভবন ফেলে একটা ব্যস্ততম রোডের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাটি পার হলেই ওপাশে রমনা পার্কের গেট। রাস্তাটি পার হতে গিয়ে যেই রাস্তার মাঝখানে, তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মন এর ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে গিয়ে হঠাৎ পা আগাতে ভুলে যায় তনু। রিসিভ বাটনে ক্লিক করতেই একটি কার সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। তনু রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। মন একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো । মন হ্যালো হ্যালো করতেই ফোনটা কেটে গেলো।
তনু কিছুদিন হলো চাকরিসূত্রে ঢাকা এসেছে। জীবনের প্রথম চাকরি বলে কথা। চারদিকে অপরিচিত মুখ। পরিচিত মুখগুলো ফেলে জীবিকার টানে চলে আসা। এ দেশে চাকরির যে হাল : ব্যাংকের চাকরি বলে কথা। ঢাকা অদ্ভুত শহর তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার কথা মনে হলো তার 'শহর শহর ঢাকা শহর/আজব শহর ঢাকা'। মানুষ আর মানুষ। আসলেই আজব। শুধু মাথা আর মাথা কারো মুখ কেউ দেখার ফুরসত নেই। তনু মাঝে মাঝে চুপ মেরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর ছুটে চলা দেখে। কি নিরন্তন ছুটে চলা। মৃত্যু হয়তো এর শেষ গন্তব্য। ফুটপাতে দিনাতিপাতে রত হাজারো মানুষ। কেউ ছুটছে কোটি টাকার পেছনে আবার কেউ শুধু একা থালা ভাত। ফুটপাতে কি দুর্বিষহ জীবন মানুষের। মৌলিক চাহিদার ছিটে ফোঁটাও তারা পায় না। বাংলাদেশ। এই দেশটির কি কোনো পরিবর্তন হবে না? রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে তনুর ঘেন্না হয়। নেতানেত্রীরা নোংরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। হাসিনা আর খালেদা নামের দুটি পথে জনগণ শুধু চলছে তো চলছে। কখনো খালেদার কাছে আবার কখনো হাসিনার কাছে কিন্তু দেশ সেই একই হালে যেই লাউ সেই কদু্। বাঙালির বুক ভরা আবেগ। জাতির পিতা হতে উত্তরাধিকার সূত্রে এ আবেগ পেয়েছে। কখন বাঙালি ভালো থাকে বা মন্দে থাকে তাদের নিজেদের কাছেও বোধগম্য নয়। চারদিকের মানুষগুলো যেন মুখোশ। মুখোশের এক রূপ, খুলে দিলে অন্য রূপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি সব চিন্তা করে যাচ্ছে তনু। চারদিকে প্রচুর হট্টগোলের মাঝেও যেন তার মাঝে অনাবিল নীরবতা। এতোক্ষণ পর তার কানে লাগলো এসব হট্টগোল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো মানিব্যাগটি আছে কিনা। এ শহরে কখন পকেট থেকে মানিব্যাগ চলে যাবে তার ইয়ত্তা নাই। বেমালুম দাঁড়িয়ে থাকার পরে পকেটে মানিব্যাগটা আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তনু। কি যানজট! গাড়িগুলো কেমন বেপরোয়া কখন কার গায়ে তুলে দেয় ঠিক নাই। মাঝে মাঝে তনুর গাছ হতে ইচ্ছে করে। ঠাই দাঁড়িয়ে ব্যস্ত মানুষের দৌড় ঝাঁপ দেখে যেন মজাই লাগবে।
দুই. মন এক চঞ্চল মেয়ে। তনু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। চাকরি পাবার পর তার সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির পর মেয়েটা তনুকে ফোন দেয় না। প্যান্টের পকেটে বারবার হাত দেয় তনু। ভাবে হয়তো মোবাইলটা ভাইভ্রেট হচ্ছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। মোবাইলটা বের করে দেখে আসলেই কোনো কল আসেনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তনু। চারদিক উজ্জ্বল নিয়ন আলোতে আলেকিত হয়ে আছে শহর। তনু উঠেছে বন্ধুর কাছে। এসেই বাসা পাওয়া শক্ত ব্যাপার। ঢাকা শহর বলে কথা। বন্ধু পুলিশের চাকরি করে, তার ব্যারাকে উঠেছে। ব্যারাক বললে কেমন তাঁবু তাঁবু লাগে। এদের তো সুরম্য ভবন। পুলিশ টেলিকম ভবন। সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে বন্ধুর টেবিলে বসেছে। মোবাইলটায় যে মায়ের কল ছাড়া আর কোনো কল আসার চান্স নেই সেটা বুঝতে পেরে ডেস্কে রেখে দিল। তনুর কবিতা লেখার শখ অনেকদিনের। একটা কাগজ ও কলম নিয়ে বসেছে কিন্তু কোনো লাইনই তার কলম দিয়ে বের হচ্ছে না। বিরহে থাকলে নাকি কবিতা হয়। কোথায় কিছুইতো আসছে না তনুর কলমে। অবশ্য কবিতা এমন এক ব্যাপার। লিখতে চাইলেই ধুম করে লেখা যায় না। কলম হাতে নিলে শব্দের পর শব্দ আসে। আসে বাক্যের পর বাক্য কিন্তু কবিতা হয় না। চিন্তা কবিতার মোক্ষম শক্তি। চিন্তার সুষম বণ্টন তনুর অনেকদিন হচ্ছে না। চিন্তাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন যেন মৌলিকতা হারাচ্ছে। কবিতা না হলেও আজ তনুর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই সে লিখবে। গদ্য অন্তত হচ্ছে। অবশ্য গদ্যের মধ্যেও চিন্তার সুবণ্টন থাকা জরুরি। এতক্ষণ ধরে যা সে লিখলো তাতে নিজেই অসন্তুষ্ট। লেখাতে চিন্তার সুষম বণ্টন লন্ঠন জ্বালিয়েও খুঁজতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিন্তা করলো কেনইবা লিখছি? আমি না লিখলেও বাংলায় লেখার মানুষ কম নাই। কাগজটা হাতে মুচড়ে হাতের তালুতে গুঁজে নিল। ছোটবেলার মতো এই মোছড়ানো কাগজটা নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে ইচ্ছে করছে খুব। না তা করলো না, জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে কলমের দিকে চোখ রেখে সে বসে রইল। এভাবে থাকতেই হয়তো ভালো লাগছে। চিন্তা করছে জীবনে সে কতো কলম শেষ করেছে লিখতে লিখতে। স্কুলে থাকা অবস্থায় পরীক্ষার সময় গুনে গুনে শেষ হওয়া কলমগুলো জমিয়ে রাখতো। দেখতো কয়টা কলম শেষ করেছে এ পরীক্ষায়। লিখতে লিখতে হাতের মধ্যমাতে কলমের ভারে দাগ বসে যেত। আর এ কলমটি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। অবশ্য এখনতো আর পরীক্ষা দিতে হয় না। তবু এ কলমটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি তার চাকরি জীবনের প্রথম কলম। এটি দিয়ে কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে প্রতিদিন কিন্তু একটা কবিতা হয় না। এটাই তার কাছে দুঃখের। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। তনু বুঝতে পারলো মা-ই হবে। মন ফোন করবে না । মন মেয়েটার মন কঠিন শক্ত। ফোন করবেই না। ঝগড়া হবার পর তনু কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু মন রিসিভ করেনি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো মা-ই ফোন করেছে। মা শব্দটা সন্তানের জন্য কতোটা আশীর্বাদের তা বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক মতো খাচ্ছি কিনা? শরীর খারাপ করেনি তো? সারাদিন একটা ফোন দিসনি? এসব প্রশ্নের ধীরে ধীরে উত্তর দিতে লাগলো তনু। তনু নিচু স্বরে কথা বলছে শুনেও মায়ের উৎকন্ঠা। কি হয়েছে তোর এভাবে কথা বলছিস কেন? কোনো সমস্যা হয়নিতো? পৃথিবীতে এই একজন মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসে।
মা হারালেই পৃথিবীতে সন্তান যেন সব হারায়। তনু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার মায়ের মৃত্যু যেন সে না দেখে। তার আগেই যেন সে চলে যায়। তনুর এক বিবাহিত বন্ধুর বলা স্ত্রী ও মা নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার। বন্ধুটি ঢাকা থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গ্রামে ফেরার পর প্রথম দেখাতে মা বলেছিল। 'পথে কোনো সমস্যা হয়নিতো? হাত মুখ ধুয়ে আয় কিছু খেয়ে নেয় আর অন্যদিকে স্ত্রী প্রথম দেখাতে বললো_ঢাকা থেকে আসছ আমার জন্য কি এনেছ? এ হলো মা ও স্ত্রীর পার্থক্য। দুজনই কিন্তু বন্ধুটিকে খুব ভালোবাসে এটাই স্বাভাবিক। কার ভালোবাসা কিসে সেটা বলা যায় না। অবশ্য সবাইতো এক না। মানুষভেদে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তনু চিন্তা করলো বিয়েই করবে না কোনোদিন। সে নিজেকে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা তার খুব মনে পড়ছে- 'জীবনে হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও । সুখী হতে চাইলে বিয়ে করো আর বিয়ে না করলে মহৎ হবার পথ খোলা।' মায়ের ফোনটা রাখার পর তার আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। রাতের ঢাকার ফুটপাত বেয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো তনুর। তার পুলিশ বন্ধু এখনো ডিউটিতে আছে। রাতও হয়ে আসছে বেশ।
ব্যারাকের খাবার, সিদ্ধ চালের ভাত একদম ভালো লাগে না। বের হলে একেবারে হোটেল থেকে খেয়ে আসতে পারবে।
ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকার বাহারি বাতি ভালোই লাগে। রাজারবাগ টেলিকম ভবন হতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল, ফুটপাতে কিছু মহিলা তাঁবুতে রুটি ছেঁকে বিক্রি করছে। রিকশাওয়ালা এসে জঠরাগি্ন নিভিয়ে আবার কাজে নেমে পড়ছে। রুটিগুলো বড় বড় দেখতে ভালোই লাগছে। তনু ভাবলো একদিন এখানে বসে রুটি খেতে হবে, ভাজি দিয়ে। ঘর্মাক্ত এক রিকশাওয়ালা কি মজা করেই না খাচ্ছে। আর মহিলাটি পান চিবুতে চিবুতে একটার পর একাটা গরম রুটি নামিয়েই যাচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিশাল প্রশস্ত মাঠটি দেখতে ভালোই লাগছে। ফুটপাতের পাশেই একটি সুদৃশ্য মন্যুমেন্ট। নিয়ন আলোতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এটি একটি স্মৃতির ফলক, একাত্তরের ১৭ মার্চ এখানে সশস্ত্র বিদ্রোহে অনেক বাঙালি সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে এ মন্যুমেন্ট নির্মিত। তনু ভাবলো ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ গিয়ে ডিনারটা সেরে নেবে। ফুটপাতে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত। মরণ ফাঁদ যেন। পরিকল্পিত কোনো কিছুই যেন বাংলাদেশে হওয়ার নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাইবা কে করে? লুটেপুটে খাওয়ার তালে সবাই। আর একটু হলে তনু হয়তো গর্তে পড়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে কখন মালিবাগ মোড়ে চলে এসেছে তনু বুঝতেই পরেনি, ঢাকা শহরে একটাই জ্বালা। সব রাস্তা প্রায় একই ধরনের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো এটা মালিবাগ। একটা ছোট হোটেলে আগে খেয়েছিল সে। ওঠাতে যেতে হলে রাস্তাটা পার হতে হবে। যেই পার হতে যাবে হঠাৎ একটা ট্রাক এসে তনুর গা ঘেঁষে ব্র্যাক করলো। তনু যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো। কোনো মতে রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে চিন্তা করলো মরে গেলেই ভালো হতো। মনের কথা মনে পড়ল। মানুষ একা থাকা ভালো। প্রেম করে একা হবার মতো জ্বালা যেন আর কিছুই নেই। হয়তো সে কথা মাথায় আসতে সে এরকমটি ভাবছে। তনুর ভাবতে ভালো লাগছে।
সত্যিই যদি মরে যেতাম তাইলে কি কি হতো। মায়ের জন্যই তার বেশি খারাপ লাগতো। মা কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিত। মন মেয়েটা হয়তো একটু আফসোস করতো। পত্রিকায় খবর ছাপা হতো। মানিব্যাগে সুন্দর ছবি আছে পত্রিকায় ছাপাতো। পরিচিত জন আফসোস করতো। আমি মরে গেলে খুশি হতো এমন কেউকি পৃথিবীতে আছে? কারো ক্ষতি করার চিন্তা করিনি কোনোদিন। এসব চিন্তা করতে করতে একটা লোক গায়ে প্রায় ধাক্কা দিয়েই হেঁটে গেল। তনুর সম্বিৎ ফিরে আসলো। হোটেলে ডুকে তনুর ভাত আর খেতে ইচ্ছে হলো না। দুটি রুটি খেয়েই চলে আসলো পুলিশ বন্ধুর কোয়ার্টারে।
তিন.
আজ শনিবার। ব্যাংক বন্ধ। সকাল হতেই তনুর সবকিছু অন্যরকম লাগছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘুম ভাঙালো । শীত আসি আসি করে এখনো আসছে না। তবে শীতের একটি আমেজ যেন এ মিষ্টি রোদে। তনুর মনের সকল অনুভূতিতে গ্রাম খেলা করে। গ্রামে কাটানো শীতের দিনগুলো খুব মনে পড়ছে তনুর। এখন হয়তো গ্রামে শীত পড়ছে বেশ। শুধু ঢাকা শহরে শীত ঘেঁষতে পারছে না নাগরিক চাপে। তবুও আজকের সকালটা তনুকে বেশ আমোদ দিল। মনটা বেশ ফুরফুরে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মনকে একটা ফোন দিতে। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছেও করছে না আবার। আজ সারাদিন শহরে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে তনু। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরে সকালেই বেরিয়ে গেল। মনের সাথে তনুর প্রেমের প্রথম দিকের সময়গুলোর কথা মনে পড়ছে আজ। পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতেও তার খুব ভালো লাগছে। আকাশে নিবিড় তুলো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ফয়ে'স লেকের পাহাড়গুলোতে ঝিরিঝিরি হাওয়া। মনকে তনুর সেই প্রথম কিস্- অন্যরকম অনুভূতি খেলে যাচ্ছে দুজনার মাঝে। সেই প্রথম মন তনুর বুকে মাথা রেখে ভালবাসার গান শুনেছিল। অনেকক্ষণ কাটিয়েছে। ঐ দিনের অনুভূতি হয়তো কাউকে প্রকাশ করতে পারবে না। এসব চিন্তা করতে করতে তনু রাজারবাগ থেকে শান্তিনগর চলে এসেছে।
সে চিন্তা করলো আজ বেইলি রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পর্যন্ত চলে যাবে, আরো হাঁটতে ইচ্ছে করলে শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে ফুটপাতে বসে চা খেয়ে আসবে। এত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলল তনু। মন মেয়েটির মন কতো শক্ত কে জানে। একটা ফোনও কি দিতে পারে না। আবার তনুর মন খারাপ হয়ে গেল। যখন ঝগড়া হয় দুপক্ষেরই দোষ থাকে কম বেশি। শুধু তনুর দোষ তাতো নয়। তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মনেরও খুব কষ্ট হচ্ছে তার মতো। তনু পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে একটি এসএমএস দিল। 'কেমন আছে। তুমি অনেক নিষ্ঠুর। একটুও কি আমার খবর নিতে পারো না? ঢাকা এতো বড় শহর। কি করছি। কোথায় আছি। কেমন আছি। কিছুই কি জানতে ইচ্ছে করে না? ভালো থেকো।'
হাঁটতে হাঁটতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ফেলে, মিনিস্টারদের বাসভবন ফেলে একটা ব্যস্ততম রোডের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাটি পার হলেই ওপাশে রমনা পার্কের গেট। রাস্তাটি পার হতে গিয়ে যেই রাস্তার মাঝখানে, তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মন এর ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে গিয়ে হঠাৎ পা আগাতে ভুলে যায় তনু। রিসিভ বাটনে ক্লিক করতেই একটি কার সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। তনু রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। মন একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো । মন হ্যালো হ্যালো করতেই ফোনটা কেটে গেলো।