বাঞ্চাকল্পতরু
যেখানে নিবিড় আরাম ডাকে প্রাণের মায়ায়
ক্ষণকাল আকাল পেরিয়ে গড়েছি নিয়মের সংসার
ধ্যানের সুরভি মেখে হাঁটি তরুণ তীর্থের পথে
খুঁজে পাই পঞ্চবটির বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা- বিবেকানন্দ প্রেম!
আমি ব্রহ্মচারী নই- শুধু বিবিধ বেদনায় হয়েছি আকুল নরোম
আশ্রমের প্রতিটি দেয়ালে লিখে যাই জীবনের নিবিষ্ট সূত্রমালা
জপমালায় ভরসা নেই- শুধু বিধানের নিয়ম ভেঙে গড়ি বিপুল পৃথিবী।
সূত্রের বিন্যাসে লাগে অসীমের ঢেউ
দুলে ওঠে পাল হয়ে বেসামাল নমিত নৌকায় লাগে দোলা
মানে-অপমানে, শত্রু-মিত্রে, শোকে আর সুখে গুছে যায় ব্যবধান ।
বাঞ্চাকল্পতরু-২
পাহাড়ের আনত বাধা পেরিয়ে মেঘের কাছাকাছি
ওখানে কোন যোগী নেই- মানুষ বড়ো বেশি গৃহস্থ মায়ায়
লুকিয়ে রেখেছে সমূহ সন্ন্যাস আর নিয়মের উপাচার
দেখা হলো এক জোড়া কাঠবিড়ালির সাথে
যারা গত জন্মে সাধুর ভানে নিয়েছিল গৃহস্থ কামনা
এখানে কিছু মেঘের ভাসমান জল ছাড়া কিছু নেই
যারা এসেছে পৌরাণিক প্রতিকের কাছে চন্দ্রনাথ চূড়ায়
তারাও পুণ্যের জলে ডুবে যাবার আগে ভাবে
কোন রত্নাকরের দস্যুপনার কথিত গল্পের ছবি!
পাপ আর পুণ্য কোনটাই টানেনি তেমন
শুধু ডুবে গেছি বিবিধ বৃক্ষের ছোঁয়ায়
অবিন্যস্ত সিঁড়ি-পথের প্রতিটি পাথরের কাছে
রেখে আসি কিছু অব্যক্ত ঘাম আর সুতীব্র নিঃশ্বাস।
শিউলি বিছানো পথের মায়ায় পেয়েছি স্বর্গীয় আমেজ
এসবের মাঝে গড়েছি কামে প্রেমে বাঞ্চাকল্পতরু।
নিখুঁত আঁধার
রাতের নিপুণ আঁধার হাতে
রচনা করেছি কিছু স্বপ্ন আর
প্রার্থিত পরিখা।
সুরের অন্তরে যুদ্ধের মন
প্রাচীন আলোয় মেতে ওঠে
উদাস মুদ্রায় লাগে পুরনো প্রণয়।
তোমার বিছানা করে আকুলি বিকুলি
আসন্ন আগুনে মাতাল পাখি
হঠাৎ ফিরে যায় সুলভ সুন্দরে
যেখানে ছিল অসীম আশ্রয় আর
তরমুজ রাঙা মায়াবী সুখের শরীর।
কপালে নিখুঁত সিঁদুর নিয়ে
রমনের তরে রাধা হয়ে
নিষিদ্ধ ব্যথা আর দিও না বুকে
ছেড়ে দাও তিল তিল পোড়া
আগুনের ফানুস।
হয়তোবা ছাই হয়ে বিরহী রাতে
উড়ে এসে দিয়ে যাবো নিখুঁত আঁধার।
পাপড়ি পাপড়ি
চোখের ভেতর জাগে দুর্বিনীত আলো। চারিদিকে ঘুরি তীব্র মায়ার মাঝে।
গোলাপের ছড়ানো পাপড়ি জোড়া লাগানোর আশায় যতোবার গিয়েছি
তোমার কাছে। বর্ণিল হাসিতে উড়িয়ে দিলে আকাশে। পাপড়ি মানে
জেনেছি বিনিদ্র রজনীর স্বপ্ন। যার রয়েছে দীর্ঘ অনুরাগের গোপন ভাষা।
যে ভাষা আজো দ্বিধায় বলা হয়নি ঠিক চিন্তার অবিকল। একবার সুন্দর
সফেদ গোলাপ তার সব মায়া নিয়ে শিখিয়েছে ভালোবাসার বিন্দু-বিসর্গ।
অপূর্ব ঘোরের মাঝে কেটে গেলে বেলা ভুলে যাই ফুলের অপূর্ব সুরভি।
শুধু সমুদ্র বিশাল। লোনা লোনা খেলা যতো জেগে ওঠে অপার মহিমায় ।
বাঁকে বাঁকে বাজে বাঁশি, সুরের সমাধি। আলো তার প্রকট উজ্জ্বল আশা।
সমুদ্র মন্থনের পর উঠে আসা যতো সুন্দর তার সব নিয়ে গেলে তুমি।
রেখে গেলে শুধু কিছু প্রগাঢ় নীল। সেই নীল পানে নীলকণ্ঠ হয়ে বুঝি
আলোর মাত্রা। যে আলোয় অন্ধ হয়ে মাতাল মত্ততা নিয়ে থাকি ঘোরে।
পৃথিবী অচেনা হয় যদি, তোমারে চিনিতে চিনিতে আবার নীলকণ্ঠ হয়ে
সুরের সিঙ্গায় তুলে আনি সমস্ত গোলাপের পাপড়ি। পাপড়ি পাপড়ি শুধু।
জানো যদি কতো পাপড়িতে হবে এক সুবোধ গোলাপ। বিভেদ ভুলে
একবার বলে যাও হে আলো, তুমি কেন হও কালো বুকের স্নিগ্ধ আবাসে।
শামুক মুখ
এতকাল পরে ভাটির শামুক এক
মৃদু পায়ে চলে চর হতে লোকালয়
শহরে বীর্যের ঘ্রাণমগ্ন পোকাদের ভিড়
পথে পথে পথিক স্বার্থের ধুলোয়
অচেনা সুর নিয়ে চলে যায় একা।
দুধেল শরীর আর বাহারি আমোদ নিয়ে
বেড়ে যায় শামুকের মুখ
জলের স্রোতে টিকে থাকে কংক্রিট দেহ
তীক্ষ্ণ চুম্বন ছুঁয়ে সহসা সমুদ্র যাপন
আর গণহারে মৎস্য সঙ্গম।
জমিনের অন্তর্বাস
জলের কল্লোলে ঘুম ভাঙা রাতের কাছে
রেখেছি আনাড়ি যৌবন
মাটি-জলের তুমুল মিলনে ভাঙে চরের সম্ভ্রম।
আমাদের বেড়া দেয়া সংসারে
ঝিরঝিরে বাতাস আসে
মেঘেদের ডাকে তিরোহিত হয় নদীর শরীর।
খরাক্লান্ত তিস্তায় জাগে শুশুক শিহরণ
আবাদি মনগুলো জলের আশায়
খুলে রাখে অনন্ত অন্তর্বাস
এসবের প্রখর উল্লাসে সেদিন
রমণ জলে ভরেছে সোমত্ত জমিন।
রাতুল প্রহর
বিনিদ্র রজনী আঁকে কামক্লান্ত চোখ
নিখুঁত কালো জমে উজ্জ্বল শিরায়
তারা যদি খসে যায় আপাত নিয়মে
আঁধারে খেলা করে অনন্ত অভিমান।
উড়ে গেছে যে ডাহুক ঝোপের আড়ালে
তার তরে কেবা গায় বিলাপের সুর
জল আছে হাওয়া নাচে হৃদয় ফুলে
খোঁজ করো যতো পারো নতুন আবেগ।
ভোরগুলো তাজা প্রাণে হউক অম্লান
ঝলমল রোদ ওঠে হীরক আমোদ
পেছনের সুর ভুলে সমুখ সমর
তলোয়ার গুনে শুধু রাতুল প্রহর!
সূর্যরাঙা সিঁদুর
মধুর
সময় দিয়েছে শিখর মুগ্ধতা। প্রেমাহূত পরশ এতোটা হালকা করে বুঝিনি আগে।
ভাসমান বেলুন হয়ে উড়েছি বিবিধ আনন্দে। ফাঁকি দিয়ে গোয়েন্দা চোখ কেড়ে নিতাম
তোমার মহাকর্ষ মমতা। মিলনের মৌতাতে নিয়ত পেয়েছি তুলোর স্বভাব। হরণের
আকাঙ্ক্ষায় বারবার এসেছো নিবিড় আলিঙ্গনে। একদা সাহসের পরিধী মাপাতে চেয়ে
বলেছিলে : পারো কিনা দেখি রাঙাতে সিঁদুর শোভায়! অন্ধ সামাজিক চোখে ব্যর্থ
হয়েছে নিবিষ্ট কারুকাজ।
কথা ছিল কপালে
সূর্যের অবিকল সিঁদুর মেখে রাঙিয়ে দেবে অমীমাংসিত অনুরাগ। তুলসী গাছ শুকিয়ে
পাতায় পুজোর ঘ্রাণ মুছে গেলে তুমি হাতের কররেখা জুড়ে ছড়িয়ে দাও অবিশ্বাস্য
ছলনা। আজকাল যে সিঁদুর-সূর্য নিয়ে ঘুরে বেড়াও তাতে আমার কোন অধিকার নেই।
আছে শুধু এক বিমুগ্ধ ইতিহাস যা নিয়ত হত্যা করে নিঠুর ছুরিতে আর যমরাজের
আদিষ্ট আজ্ঞায় প্রতিবার ফিরে পাই প্রাণ।
বহুকাল কেটেছে এখানে
হলুদ গোলাপের বাহারি সুখে
ভাসে প্রণয়ক্লান্ত ঠোঁট আর চোখের বাগান
কাজলের গাঢ় দাগে ডুবে যেতে যেতে
প্রশস্ত ললাটে লিখে রাখি বিদায় ভাষ্য।
আরো নিচে
ছুঁয়েছি চপল তিল চুলের গোড়ায়
দিশেহীন ঝিম ধরা চোখে
ঢেউ জাগে জোয়ারের টান
আঙুল শিহরণে সমবেত ঠোঁটে লাগে দোলা।
পথের পাশে জড়িয়ে থাকে পর্বত রাত
চূড়ার মায়ায় তুলি নিবিড় টান
কম্পনের সাম্পানে চড়ে খুলে যায় পাতাল পুরি
তোমার গোয়েন্দা হাত খুঁজে আনে প্রবল নাটাই
ঘুড়ি ওড়ে তুমুল বাতাসে।
ত্রিশের সমান পথ
কালের মহান হাত ধরে চলেছি নিবিড় সবুজ প্রান্তরে
ত্রিশ বছর জুড়ে ভাটির ভুবনে বিনত নরোম বাতাসে
বেলা আর অবেলার সুর ধরে ঘর্মাক্ত গ্রাম থেকে শহরে।
এখানে নগরে বিচিত্র ঋতুর কঠিন ভেলায় ঘুরে ঘুরে
ভুলেছে প্রান্তজন রোদ-পোড়া মাঠ আর ঘুড়ি-ওড়া বিকেল
তারে দেখে মায়া হয় ছায়াহীন অবলা মানুষ অসহায়।
আধেক কাল কেটেছে মুগ্ধতায় মাটিলগ্ন মনের ভেতর
যেখানে অমল ধবল ধেনু আর সহজ মানুষের ভিড়।
দাওয়ায় বসে দেখি রোদ-রাঙা উঠোনে ফোটে বাহারি ফুল
শান বাঁধানো ঘাটের জলে মমতা-ঢেউ এলোমেলো হাওয়া।
গন্ধরাজের বিবিধ মায়ায় হাসে প্রজাপতি ডানা অম্লান
বরষা-বিমুগ্ধ বেলায় সোঁদা গন্ধে দোলে মাতাল মাটিমন।
অতঃপর যান্ত্রিক মানুষের ভিড়ে কেটে যায় বাকিটা বেলা
সময়ের ফাঁদে পড়ে মাথা খোলে বেড়ে ওটি নতুন মানুষ।
কষ্টের কাল আসে কতো বেদনার রঙ নিয়ে বেতাল তানে
বধির ব্যস্ততা ভিড়ে এসেছিল কাছে কেউ মনের তাগিদে।
পেয়েছি নতুন ভাষা তার কাছে জমা রেখে বিবিধ মনন
আপন মনে টেনেছি কাছে যারে বেমালুম চলে গেছে দূরে।
বেলা যায় জীবনের ঢেউ তোলে কিছু তার জানে নাকো কেউ
যান্ত্রিক চমকে হাসে বিস্তর বেলা আর বিষণ্ন বেদনায়।
রুজির বাজি আর হিলিয়াম চাঁদ-রাঙা রাত দিবে কতোটা
আমোদ? যে শিশির চলে গেছে সিঁদুর-সূর্য নিয়ে নিদারুণ
তার তরে চেনা জনপদের ভিড়ে কেন জাগে অচেনা ঢেউ !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন