বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৬

কবিতার চিন্তা ও চেতনা

শেখর দেব
http://www.fns24.com/details.php?nssl=c1537c9ed39baee3476c6fdd666b5fd8&nttl=1407201534126#.Vvzeh3qeXIV14 Jul 2015   09:20:07 PM   Tuesday BdST A- A A+
 কবিতার চিন্তা ও চেতনা
কবির চিন্তা ও চেতনার গভীরতা কবিতার রসদ। মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। চিন্তার স্বাভাবিক প্রবণতা কবিকে কাব্য শরীর দাঁড় করাতে সাহায্য করে। চেতনা চিন্তাকে পরিশীলিত করে। সম্যক জ্ঞান কবিতায় আনে সুনির্দিষ্ট বার্তা। এ বার্তা প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত বার্তা নয়। যেহেতু কবিতার ভাষা মন ও মননের সংমিশ্রণ, এর বার্তাও একান্ত মনো-মননগত। এ বার্তা মানুষের মনের উৎকৃষ্ট অনুভূতি ও মননের চেতনাগত বার্তা। উদ্দেশ্যহীন মনোভাষা আবেগতাড়িত কবিতার জন্ম দেয়। তাই মনন দিয়ে মনকে পরিশীলিত করতে হয়। মনের চিন্তাগুলো ভাষা হবার আগে চেতনায় পরিশুদ্ধ হলে কবিতা হয়। অন্যথায় মনের ভাষা ও মুখের ভাষা এক হয়ে যায়। অবশ্য মুখের ভাষা মস্তিষ্ক ও মনের চিন্তা প্রসূত। তাহলে মনের ভাষা ও মুখের ভাষায় পার্থক্য কই? পার্থক্য আছে। আছে বলেই মাঝে মাঝে মনের কথা ঠিক প্রকাশ করে উঠতে পারি না। আমরা নির্বাক হই, ভাষাহীন হই। তাই কবিতা মনন বিশ্লেষিত মনের ভাষা। এখানেই কবিতা ও কথাসাহিত্যে পার্থক্য। কবিতা যদি মুখের ভাষা হয়ে যায় তা শীল্পমূল্য হারায়। কবির আবেগ কবিকে সমৃদ্ধ করে যেমন ডুবায়ও তেমন। আবেগের পরিশীলন না হলে কবিতা উর্ত্তীন্ন হয় না। আবেগ বর্ষার জমাট বাঁধা কালো মেঘের মতো। তার একটাই ফল তুমুল ঝরে যাওয়া, চরাচর ভাসানো। কিন্তু বৈশাখের মেঘ অনেক রহস্যজনক। এখন কালো হয়ে এলো আবার এখন ফর্সা হয়ে আসছে। এখন ঢেকে দিল নীল আকাশ, আবার সমহিমায় হাজির। এর মধ্যে একটা ধাঁধা আছে। এটাই কবিতা। তাই কাঁচা আবেগ কবিতাকে বর্ষার মেঘের মতো ভারী করে তোলে, যার ফল সুনিশ্চিত। তাই আবেগের পরিশীলন জরুরী। চিন্তায় আবেগ থাকে, তাই চেতনার দরকার হয়। কবির এমন কোন দায় নেই কবিতায় একটি নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাতে হবে। বোঝাতে গেলেই  কবি কাব্য মঞ্চে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কবির চিন্তা ও চেতনার সমন্বয়ে কবিতা হয়। বোঝার দায়িত্ব পাঠকের। না বুঝলেও তেমন ক্ষতি নেই কারণ আগেই বলেছি কবিতার ভাষা মনের ভাষা। তাই মনের ভাষা সবসময় বুঝতে হবে এমন কথা নেই। আমরা কজন নিজের মনকে বুঝি? আবার অন্যের মন! তবে অনুভূতির একটা মজা আছে। অনুভূতির মজা মুখে বলে প্রকাশ যোগ্য হয়ে ওঠে কম। অনুভূতির কথা অনুভবের ব্যাপার। এই অনুভবের জন্য চাই স্থির মন। অস্থিরতা কবি ও কবিতা দুটোকে নষ্ট করে। ঠিক তেমনে পাঠকের ক্ষেত্রেও সত্যি। তাই একই কবিতা পাঠকবেধে মূল্যায়নের ভিন্নতা দেখা যায়। পাঠকের মানসিক উচ্চতা কব্যপাঠে সাহায্য করে। মানসিক উচ্চতা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে না গেলে কবিতা দুর্বোধ্যই থেকে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই কাব্য পাঠে যোগ্যতার প্রশ্ন আসে। শিল্প আজীবন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষকেই আনন্দ দিয়েছে এবং দিবে। সাহিত্যের উৎকৃষ্ট শিল্প হলো কবিতা। পাঠকের চিন্তার জগত তার চেতনার চেয়ে বেশি নয় কিন্তু কবির চিন্তার জগত তাঁর চেতনার চেয়ে বেশি, এটা কবির স্বভাবগত। এজন্যই একজন কবি, কবি হয়ে ওঠেন। চিন্তা মানুষের স্বভাবগত বিধায় তা সাধারণত দৃশ্যগোচর বস্তু দর্র্শনে সৃষ্টি হয়। তার পজেটিভ ও নেগেটিভ দুটো দিকই আছে। তবে চেতনার পজেটিভ ছাড়া নেগেটিভ কোন দিক আছে বলে মনে হয় না। চিন্তার জন্ম চোখ থেকে আর চেতনার জন্ম মন থেকে। এটা বলা যায় বর্হিদৃষ্টি ও অর্ন্তদৃষ্টির সমন্বয় হলে একজন মানুষ ভালো মানুষ হয় তার কাজে ও কর্মে। কবি মাত্রই ভালো মানুষ কারণ সে কবিতা লেখে। অবশ্য সাধু কবিদের ফাঁকে আজকাল অসাধু কবিও দেখা যায়। সাধু কবি তার চারপাশের পরিবেশের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতার মধ্যে কবি মুক্তি খুঁজে পান। সেই মুক্তি বিন্দুমাত্র সেচ্ছাচারিতা নয়, কবির অবাধ বিচরণ। কবির সমগ্র সত্ত্বায় গেঁথে আছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মাঝে। অসাধু কবি আসলে কবি নয় অসাধু। তারা আসলে ধ্যান ভ্রষ্ট বা সাধনভ্রষ্ট সাধু। তারা সাধুর ভান ধরে আছে। তাই মানুষ মাত্রই কবি নয় আর কবি মাত্রই সাধু কবি নয়।
কবিতার নির্দিষ্ট কাঠামো আছে, এ যেমন সত্যি, সেই কাঠামো ভেঙে দিয়েও কবিতার ক্যানভাস রঙিন করে তোলা যায় শব্দ ও ভাবের সুষম সমন্বয়ে। শব্দের শক্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া একজন কবির বেশ প্রয়োজন। কবিতার বড়ো পরিসর গ্রহণে খুব অনিহা। তাই ছোট ক্যানভাসে কবিকে কবিতা ফোটাতে হয় যতনের সাথে। যাকে আবার কবিতাও হতে হয়। শব্দ যুগপৎ দৃশ্য ও ভাবের জন্ম দেয়। শব্দের মধ্যে দৃশ্য খুব সহজে ধরা দিলেও ভাবের ক্ষেত্রে তেমনটি না। একটি শব্দ পুরো একটি ভাবকে ধারণ করতে পারে না। শব্দের সাথে শব্দের বন্ধুত্ব না হলে ভাব মাঠে মারা যায়। কবি পাঠককে কবিতার ভেতরে প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়। তাই কবিতায় কবির ভাব সুস্পষ্ট করতে হলে শব্দের গাঁথুনি হতে হয় যুৎসই। শব্দের পরশে শব্দের অর্থগত পরিবর্তন ঘটে। যা তার শাব্দিক অর্থকে ছাড়িয়ে যায়। উপহার দেয় নতুন কিছু। এখানেই কবির সার্থকতা। কবির অর্ন্তজগতে প্রতিটি শব্দ জোনাকি হয়ে জ্বলে যা বর্হিজগতের সাথে সঙ্গতি সুসংহত করে তোলে। মাঝে মাঝে শব্দে শব্দে গড়ে ওঠে ধাঁধা। কবিতার ভাবে লাগে বহুরৈখিকতার পরশ। কবিতার ভাবের বিভিন্নতা কবিতাকে রহস্যময় করে তোলে। কবিতার এ রহস্য চিরন্তন। স্বভাবগতভাবে কবি এ রহস্যের খেলা রপ্ত করেন। কবি খুব সহজ কথায় অনেক মূল্যবান ভাব প্রকাশ করতে পারে। মূল্যবান মানে সৌন্দর্যের মূল্য। যা একান্তই মনোগত ব্যাপার, উপলব্ধি করতে পারলে ভালো লাগা কাজ করে। ভালো না লাগলে কবিতা ব্যর্থ হয়, সাথে কবিও। শব্দের সুষম সমন্বয় কবিতাকে ফুটিয়ে তোলে ভোরের সূর্যমুখীর মতো আবার শব্দের বাহুল্য বা অসমন্বয় কবিতাকে ডোবায়। অপ্রয়োজনীয় শব্দ কবিতাকে মেদবহুল করে, কবির আবেগ কবিকে এই ভুল করিয়ে নেয়। তাই আবেগের পরিশীলন জরুরী।
কলম খাতার কাছে আসলেই বা কিবোর্ড আর মনিটর সামনে থাকলেই কবিতা হয় না, হয় কথা। শুধু কবির কলম ও খাতা বা কিবোর্ড আর মনিটর সামনে থাকলেই কবিতার জন্ম হয়। কবি মানুষের অভিন্ন কিন্তু চিন্তা ও তার রূপায়নে ভিন্ন। দৃশ্যমান সবকিছু কবি অন্য দশজনের মতো দেখে এবং বোঝে কিন্তু একজন কবি তা কালিতে চমক দিতে পারে বলে সে কবি। কবির মানসিক সত্তা ও সামাজিক সত্তার মিল অমিলের কারণে কবিতা আসে। কবিতা হয়ে যাওয়ার বিষয়। মূলত কবিতা শব্দ ও ভাবের অনুপম কলা। সেই কবিতার সাথে সামান্যতম কৌশল কবিতাকে দিতে পারে অন্য মাত্রা। তবে কবিতা কি কৌশল? উত্তরঃ না। তবে কবিতায় কিয়দাংশ কৌশল প্রয়জোন পড়ে। কবির দৃশ্যগত বা চিন্তাগত বা দর্শনগত পীড়ন সবসময় কাজ করে। এসবের সমন্বয়ে একটি ভাব  তৈরি হয় যা শব্দের ডানায় চড়ে ক্রমাগত কবিতার আকাশে উড়ে যেতে চায়। জন্ম হয় কবিতার। এ পুরো প্রক্রিয়ায় আবেগের সংযোগ বা বর্জনের, শব্দের দন্ধের বা বন্ধুত্বের, ভাবের সৌন্দর্যের বা ব্যর্থতার কৌশলে আবর্তিত হয়। কাব্য উদ্দীপনার পরের ব্যাপারটি কৌশল। কাব্য কৌশল। এ জন্য কবিতা কল্পনামূলক শব্দ গ্রহণ করে। যে শব্দে রয়েছে যুগপৎ ভাবের রহস্য ও সৌন্দর্যের ঝিলিক।
ছন্দ শব্দকে সুগঠিত করে, কবিতাকে দেয় একটি ফর্ম। কবির মনে একধরনের সুর কাজ করে। এ গানের সুরের মতো নয় য্যান ঠিক। কবিতার সুর। কবিতায় এ সুর ধ্বনিত হয় শব্দে শব্দে। এ সুরই কবিতার ছন্দ। একজন কবি মেপে মেপে নয়, প্রকৃতিগতভাবেই এটা রপ্ত করেন। যদি অন্তরে সুর খেলা করে, কবিতায় ছন্দ আসবেই। কবিতায় থাকবে চিত্রকল্প বা কল্পচিত্র। শব্দের সহজ সমন্বয়ে যা গড়ে ওঠে। এ চিত্র একান্তই কবির আশেপাশে ছড়িয়ে  আছে। কবিতায় তা ধরার জন্য চাই সহজিয়া মন ও মনন। খুব সাধারণ চিত্র কল্পনায় ফুটিয়ে তোলা যায় অসাধারণ করে। এ ক্ষেত্রেও কবিকে সেই চিত্রকে ফোটানোর জন্য যুৎসই শব্দের সমন্বয় জরুরী হয়ে ওঠে। কবি তা পারে। কবির অদ্ভুত এ ক্ষমতাটি রয়েছে। না বলা কথা সে বলে দেয়, না বোঝা কথা সে বুঝিয়ে দেয়।
শব্দমেদ যেমন কবিতাকে কাব্যরসহীন করে ঠিক তেমনি ভাবের বিচ্ছিন্নতার মাঝে কবি শৃঙ্খলা তৈরির মুন্সিয়ানা দেখাতে পারলে কবিতা সার্থকও হয়ে ওঠতে পারে। তবে তা কবির কাব্যশক্তিতে নিহিত। কাব্যশাসন কবিতাকে নিরোগ করে। কবিতাকে বাঁচায় বিচ্ছিন্নতার বলি হতে। কবির কাছে শব্দ ফুলের মতো। যার আছে সৌন্দর্য ও কোমলতা। কবির সুন্দর চেতনা জরুরী। কবিতা শিল্পটাই মূলত সুন্দরের শীল্প। এ শিল্প কবির ভাষাবোধকে সমৃদ্ধ করে।
কবিতে সময় সচেতন হতে হয়। কবিতায় সময়কে ধারণ করতে না পারলে কবি ব্যর্থ। এই ধারণের ব্যাপারটি হতে পারে কবিতার বিষয়, আঙ্গিক ভঙ্গি এসবের সমকালিন প্রবণতাকে ধারণ। কবির একটি দেশ থাকে। যে দেশের আলো বাতাসে সে বেড়ে ওঠে। যার মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখে। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, বর্ণিল সংস্কৃতি। একজন কবি এর সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, খোঁজেন সংগতি আর অসংগতি। কবিতা এ সবের প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে সুপ্রাচীন।‘চর্যাপদ’ হতে বাংলা কবিতার যাত্রা। চর্যাপদের সময়  হতে এ  পর্যন্ত রাশি রাশি কবিতা রচিত হয়েছে শত শত কবির হাতে। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও চেতনাকে ধরতে হলে কবিকে সাঁতার দিতে হবে এ কাব্য সমুুদ্রে। বুঝে নিতে হবে কবিতার বাঁক ও প্রবণতা। প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পুঁজি করে সমকালিনতার উপর ভর করেই কবিতাকে অনন্তের মুখ দেখাতে হয়। শেকড়জাত বিষয়গুলো কবিতায় নিয়ে আসার আলাদা কোন কৌশল নেই। কবিকে এ ব্যাপারে কোন অত্যধিক প্রচেষ্টারও প্রয়োজন পড়ে না। এ বিষয়গুলো আপনাআপনি আসে কারণ একজন  কবি তাঁর শেকড়ের উপর ভর করেই বেড়ে ওঠে। শেকড়জাত চিন্তনে, ভাষ্যে এসবের চিত্র ফোটে। কবির কাজ শুধু কবিতা লেখা নয়। আর দশজনের মতো তাকেও যাপন করতে হয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার জীবন। যাপনের আনন্দ-বেদনা কবিতায় আসে। এসবের মাঝে আমাদের ঐতিহ্য চেতনা সচেতনভাবে ঢোকাতে হয় কবিকে। তাই আমাদের শেকড়জাত বিষয়গুলো নিয়ে পঠন-পাঠন জরুরী। তাই কবিকে পড়তে হয় বেশি লেখার চেয়ে।

ধৃতরাষ্ট্রের দেশে ][ শেখর দেব

http://saatdin.blogspot.com/p/blog-page_3087.html

রক্ত পোড়ার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ আর
দেহের বিৰত মাংসের সমান হিংস্র সভ্যতা!
মানুষ কবে মানুষ হবে মধ্যপ্রাচ্যের গুহায়?
পবিত্র শিশুর বাগানে যে ঢালে আগুনের লাভা
সে কী মানুষ হবে না?
পিলে চমকানো যে ছবি ফোটে বোমার হুঙ্কারে
তাতে ধৃতরাষ্ট্রদের চোখের ঠুলি কখনো যাবে না খুলে
মানুষ জাগো
জেগে ওঠো আলো হয়ে অন্ধ রাজাদের চোখে!

সাক্ষাৎকার

অচেনা যাত্রী

 http://achenayatri.blogspot.com/2014/10/blog-post_44.html

পাপড়ি পাপড়ি

চোখের ভেতর জাগে দুর্বিনীত আলো চারিদিকে ঘুরি তীব্র মায়ার মাঝে

গোলাপের ছড়ানো পাপড়ি জোড়া লাগানোর আশায় যতোবার গিয়েছি

তোমার কাছে বর্ণিল হাসিতে উড়িয়ে দিলে আকাশে পাপড়ি মানে

জেনেছি বিনিদ্র রজনীর স্বপ্ন যার রয়েছে দীর্ঘ অনুরাগের গোপন ভাষা

যে ভাষা আজো দ্বিধায় বলা হয়নি ঠিক চিন্তার অবিকল একবার সুন্দর

সফেদ গোলাপ তার সব মায়া নিয়ে শিখিয়েছে ভালোবাসার বিন্দু-বিসর্গ

অপূর্ব ঘোরের মাঝে কেটে গেলে বেলা ভুলে যাই ফুলের অপূর্ব সুরভি

শুধু সমুদ্র বিশাল লোনা লোনা খেলা যতো জেগে ওঠে অপার মহিমায় 

বাঁকে বাঁকে বাজে বাঁশি, সুরের সমাধি আলো তার প্রকট উজ্জ্বল আশা

সমুদ্র মন্থনের পর উঠে আসা যতো সুন্দর তার সব নিয়ে গেলে তুমি

রেখে গেলে শুধু কিছু প্রগাঢ় নীল সেই নীল পানে নীলকণ্ঠ হয়ে বুঝি

আলোর মাত্রা যে আলোয় অন্ধ হয়ে মাতাল মত্ততা নিয়ে থাকি ঘোরে

পৃথিবী অচেনা হয় যদি, তোমারে চিনিতে চিনিতে আবার নীলকণ্ঠ হয়ে

সুরের সিঙ্গায় তুলে আনি সমস্ত গোলাপের পাপড়ি পাপড়ি পাপড়ি শুধু

জানো যদি কতো পাপড়িতে হবে এক সুবোধ গোলাপ বিভেদ ভুলে

একবার বলে যাও হে আলো, তুমি কেন হও কালো বুকের স্নিগ্ধ আবাসে

বৈকালিক সাধনা

বিকেল মানে বেদনা এরূপ ধারনা নিয়ে ঘুম ভাঙার পর

পশ্চিমের রক্তিম আভায় ডুবে যেতে থাকা সূর্যের সাথে

জমে যায় ভাব ব্যথা সেতো গোধূলি বেলার উড়ে যাওয়া বক

বিগত এক গোধূলির বুকে জমে আছে আমাদের নির্মোহ প্রেম

আকাশে বিচ্ছুরিত লালের অবিকল রক্তাভ কপোলে খুঁজেছি

সমস্ত দিনের দর্শন স্বর্গের সুষমা বুঝেছি সেই প্রথম

বাতাসের অন্তর্গত বেদনার ভেতর রাখালের বাঁশির সুরে উড়ে ধূলি

গাঢ় মেঘের ঘুম-চোখ নিয়ে অস্তবেলার স্বপ্নে বিভোর হারিয়ে ফেলি

বৈকালিক বেদনা এখন বিকেল মানে প্রিয়ার সাধনা!

প্রেমসূত্র

বুকে নিরবতার ইতিহাস নিয়ে হাঁটি চরাচরে

চোখ বন্ধ হয়ে আসা শান্তির অনুভূতি যে দিয়েছে

তার কাছে রেখেছি জীবনের আধেক সাধনা

অন্তরের সুরে ভেসে ভেসে শূন্যে মিশে যাবার পাঠশালায়

শিখেছি মৌনজগতের মহাকর্ষ যা নিউটন বুঝেননি তেমন

দেহে দেহে ঘষা লেগে আগুন ধরেছে যেদিন

সেদিন সভ্যতার সোপানে পা রেখে দেখেছি

পাপ আর পবিত্রতার মাঝে রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র

নিরবতার আগুনে যে আপেক্ষিকতা লুকানো তার গুণ নিয়ে

ছড়িয়ে দেই ঘোরের সুন্দরে যা আইনস্টাইন বুঝেননি কিছুই

আদিম সুর নিয়ে যেই সভ্যতার দিকে যাই

দেখি প্রেম ছাড়া পৃথিবীর কোন ইতিহাস নেই

সব সূত্র এখানে একসূত্রে গাঁথা--যার নাম প্রেমসূত্র

বাঞ্ছাকল্পতরু’ নিয়ে শেখর দেব

http://dhakareview.org/interveiw-with-shekor/

শেখর দেব 
ঢাকা রিভিউ: ‘বাঞ্ছকল্পতরু’ বই হিসাবে কত নম্বর বই? এর আগের বইগুলোর নাম কি?
উত্তর: এটা আমার দ্বিতীয় কবিতার বই। প্রথম কবিতাগ্রন্থটির নাম ‘প্রত্নচর্চার পাঠশালা’। ২০১৪ সালে পাঠসূত্র প্রকাশন ৪৮টি কবিতা নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছিল।
ঢা রি: এই বইয়ে কয়টি কবিতা আছে? কতদিনের প্রস্তুতি?
উত্তর: এই বইয়ে ৫৪টি কবিতা আছে। তিন বছর ধরে লেখা প্রায় ১৫০ প্রকাশিত কবিতা থেকে বাছাই করে বইটি করেছি।
ঢা রি: আমাদের বই শুধু মেলা উপলক্ষে বের হয় কেন? এটা কি ঠিক?
উত্তর: আমাদের দেশে বই মেলা বড়ো উৎসবে পরিণত হয়েছে। সবাই চাই এই উৎসবের শামিল হতে। তাছাড়া বই মেলায় গিয়ে মানুষ বই কেনে। তাই হয়তো বই মেলে উপলক্ষে সবাই বই বের করতে চায়। ঠিক বেঠিকের প্রশ্ন নয় বরং বই প্রকাশিত হচ্ছে এটা একটা বড়ো ব্যপার। সব লেখকরা এক ধরনের চর্চার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এটাই পজেটিভ।
ঢা.রি: একটা বইয়ের থিম কিন্তু তার শিরোনাম।আপনার শিরোনাম কিভাবে দেওয়া।
উত্তর: আমার বইয়ের শিরোনাম ‘বাঞ্ছাকল্পতরু’। মূলত পৌরাণিক মিথ থেকে এ নাম নেয়া। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মাটিলগ্ন বিষয়গুলোর সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের পৌরাণিক মিথগুলো মিলে মিশে আছে। মিথের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থেকে এ ধরনের নামকরণ। এ ছাড়াও সমকালিন বিষয়গুলোকে মিথিক ব্যঞ্জনায় কবিতায় উপস্থাপনের অদম্য ইচ্ছা আমার কবিতার অন্তর্গত বিষয়। ‘বাঞ্ছাকল্পতরু’ হল এমন একটি কল্পিত বৃক্ষ যার কাছে যে যা চাইবে তাই পাবে। অর্থাৎ সে সবার বাঞ্ছা পুরণ করে। আমার কবিতার মধ্যে বাংলার বিভিন্ন বিষয়-আশয় ধরার প্রবণতা আপনারা দেখবেন।
ঢা রি: আপনার কবিতাগুলো কি অটোমেটিক পোয়েট্রি না আপনি সচেতনভাবে কোনো থিম নিয়ে কাজ করেছেন?
উত্তর: অটোমেটিক পোয়েট্রি বলতে আমরা কি বুঝব? যে কবিতা কবির মস্তিষ্ক হতে কলমে অটোমেটিক চলে আসে? আসলে অটোমেটিক পোয়েট্রি বলে কিছু কি আছে? কবিতার কবির সচেতনার ফল মাত্র। অটোমেটিক হলেও তা কবির চারপাশের চিন্তা ও চিত্রের সচেতন প্রতিফলন। কবিতায় দর্শন খুব জরুরী। তবে কোণ বিশেষ থিম নিয়ে একটা কবিতার বই করা যায় কি না আমি জানি না। তবে বিভিন্ন থিমের মাঝে একটি দর্শন একটি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। আমার কবিতার বইয়ে আমি বাংলাদেশের আবহমান ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভেতর মানুষের বিচিত্র চিন্তা ও চেতনার সমন্বয়ের চেষ্টা করেছি মাত্র। লোকজ বিষয়, সংস্কার ও মিথিক অনুষঙ্গ আমাকে প্রাণিত করে। আমার কবিতায়ও তাই আছে।
ঢা রি: কবিতার কি কোনো দায় আছে? থাকলে সেই দায়বোধ কি? কারপ্রতি?
উত্তর: সাহিত্যের অবশ্যই দায় আছে। কবিতারও। এই দায় কবির বেড়ে ওঠা দেশের মানুষের, সমাজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি।
ঢা রি: আপনার এই কবিতার বই পাঠককে কি বলতে চায়?
উত্তর: আমার কবিতার বই পাঠককে কি বলতে চায় পাঠক পড়ে বুঝে নিবে। তবে আমি চেষ্টা করেছি মানুষের সহজিয়া চেতনাকে উস্কে দিতে। কতটুকু পেরেছি পাঠক বলবে।
ঢা রি: কবিতার বই চলে না জাতীয় একটা কথা প্রচলিত আছে। এটা কি ষড়যন্ত্র?না চললে এত বই বের হবে কেন?
উত্তর: কবিতার পাঠক কখনো বেশি ছিল না। মূলত কবিরাই কবিতাকে গুরুত্বের সাথে পাঠ করে। তাই হয়তো কবিতার বই কম চলে। তবে কবিতার বই একদম চলে না তা নয়। ষড়যন্ত্রের বিষয় নয়, হয়তো গল্প, উপন্যাসের চেয়ে কম চলে বলেই এমন কথা প্রচলতি। বই যেমন বের হচ্ছে তেমন বই বিক্রিও হচ্ছে তবে কম আর বেশি।
ঢা রি: আপনার এই বইয়ের কতটুকু প্রচারণা ও বিক্রয় আশা করেন?
উত্তর: বইয়ের প্রচারণা অবশ্যই চাই। তবে আগেই বলেছি কবিতার পাঠক কম। আমার বই এসেছে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে। দুই দিনে ১০ কপি বিক্রি হয়েছে ‘বাতিঘর’ বই বিপণী হতে। বই বিক্রি হলে ভালো লাগে।
ঢা রি: আপনার পাঠকের জন্য কিছু বলবেন?
উত্তর: পাঠককে বলবো বই কিনুন, পড়ুন।
ঢা রি: বাংলা একাডেমির মেলা ও অন্য কোথায় বইটি পাওয়া যাবে?
উত্তর: বাংলা একাডেমির মেলায় ৫৭৭ নং ‘বেহুলা বাংলা’, বহেরা তলার ‘তৃতীয় চোখ’ ও ‘খড়িমাটির’ স্টলে বইটি পাওয়া যাবে। এছাড়াও চট্টগ্রামের বই বিপণি ‘বাতিঘর’, ‘নন্দন’, ‘গ্রন্থনিলয়’ ও ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’ এবং চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত বই মেলায় ‘শাঁখ’ এর স্টলে বইটই পাওয়া যাবে।

শেখর দেবের দশটি কবিতা

বাঞ্চাকল্পতরু

তোমাদের নিঝুম প্রেম থেকে দূরে-
যেখানে নিবিড় আরাম ডাকে প্রাণের মায়ায়
ক্ষণকাল আকাল পেরিয়ে গড়েছি নিয়মের সংসার
ধ্যানের সুরভি মেখে হাঁটি তরুণ তীর্থের পথে
খুঁজে পাই পঞ্চবটির বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা- বিবেকানন্দ প্রেম!
আমি ব্রহ্মচারী নই- শুধু বিবিধ বেদনায় হয়েছি আকুল নরোম
আশ্রমের প্রতিটি দেয়ালে লিখে যাই জীবনের নিবিষ্ট সূত্রমালা
জপমালায় ভরসা নেই- শুধু বিধানের নিয়ম ভেঙে গড়ি বিপুল পৃথিবী।
সূত্রের বিন্যাসে লাগে অসীমের ঢেউ
দুলে ওঠে পাল হয়ে বেসামাল নমিত নৌকায় লাগে দোলা
মানে-অপমানে, শত্রু-মিত্রে, শোকে আর সুখে গুছে যায় ব্যবধান ।

বাঞ্চাকল্পতরু-২

পাহাড়ের আনত বাধা পেরিয়ে মেঘের কাছাকাছি
ওখানে কোন যোগী নেই- মানুষ বড়ো বেশি গৃহস্থ মায়ায়
লুকিয়ে রেখেছে সমূহ সন্ন্যাস আর নিয়মের উপাচার
দেখা হলো এক জোড়া কাঠবিড়ালির সাথে
যারা গত জন্মে সাধুর ভানে নিয়েছিল গৃহস্থ কামনা
এখানে কিছু মেঘের ভাসমান জল ছাড়া কিছু নেই
যারা এসেছে পৌরাণিক প্রতিকের কাছে চন্দ্রনাথ চূড়ায়
তারাও পুণ্যের জলে ডুবে যাবার আগে ভাবে
কোন রত্নাকরের দস্যুপনার কথিত গল্পের ছবি!
পাপ আর পুণ্য কোনটাই টানেনি তেমন
শুধু ডুবে গেছি বিবিধ বৃক্ষের ছোঁয়ায়
অবিন্যস্ত সিঁড়ি-পথের প্রতিটি পাথরের কাছে
রেখে আসি কিছু অব্যক্ত ঘাম আর সুতীব্র নিঃশ্বাস।
শিউলি বিছানো পথের মায়ায় পেয়েছি স্বর্গীয় আমেজ
এসবের মাঝে গড়েছি কামে প্রেমে বাঞ্চাকল্পতরু।

নিখুঁত আঁধার

রাতের নিপুণ আঁধার হাতে
রচনা করেছি কিছু স্বপ্ন আর
প্রার্থিত পরিখা।
সুরের অন্তরে যুদ্ধের মন
প্রাচীন আলোয় মেতে ওঠে
উদাস মুদ্রায় লাগে পুরনো প্রণয়।
তোমার বিছানা করে আকুলি বিকুলি
আসন্ন আগুনে মাতাল পাখি
হঠাৎ ফিরে যায় সুলভ সুন্দরে
যেখানে ছিল অসীম আশ্রয় আর
তরমুজ রাঙা মায়াবী সুখের শরীর।
কপালে নিখুঁত সিঁদুর নিয়ে
রমনের তরে রাধা হয়ে
নিষিদ্ধ ব্যথা আর দিও না বুকে
ছেড়ে দাও তিল তিল পোড়া
আগুনের ফানুস।
হয়তোবা ছাই হয়ে বিরহী রাতে
উড়ে এসে দিয়ে যাবো নিখুঁত আঁধার।

পাপড়ি পাপড়ি

চোখের ভেতর জাগে দুর্বিনীত আলো। চারিদিকে ঘুরি তীব্র মায়ার মাঝে।
গোলাপের ছড়ানো পাপড়ি জোড়া লাগানোর আশায় যতোবার গিয়েছি
তোমার কাছে। বর্ণিল হাসিতে উড়িয়ে দিলে আকাশে। পাপড়ি মানে
জেনেছি বিনিদ্র রজনীর স্বপ্ন। যার রয়েছে দীর্ঘ অনুরাগের গোপন ভাষা।
যে ভাষা আজো দ্বিধায় বলা হয়নি ঠিক চিন্তার অবিকল। একবার সুন্দর
সফেদ গোলাপ তার সব মায়া নিয়ে শিখিয়েছে ভালোবাসার বিন্দু-বিসর্গ।
অপূর্ব ঘোরের মাঝে কেটে গেলে বেলা ভুলে যাই ফুলের অপূর্ব সুরভি।
শুধু সমুদ্র বিশাল। লোনা লোনা খেলা যতো জেগে ওঠে অপার মহিমায় ।
বাঁকে বাঁকে বাজে বাঁশি, সুরের সমাধি। আলো তার প্রকট উজ্জ্বল আশা।
সমুদ্র মন্থনের পর উঠে আসা যতো সুন্দর তার সব নিয়ে গেলে তুমি।
রেখে গেলে শুধু কিছু প্রগাঢ় নীল। সেই নীল পানে নীলকণ্ঠ হয়ে বুঝি
আলোর মাত্রা। যে আলোয় অন্ধ হয়ে মাতাল মত্ততা নিয়ে থাকি ঘোরে।
পৃথিবী অচেনা হয় যদি, তোমারে চিনিতে চিনিতে আবার নীলকণ্ঠ হয়ে
সুরের সিঙ্গায় তুলে আনি সমস্ত গোলাপের পাপড়ি। পাপড়ি পাপড়ি শুধু।
জানো যদি কতো পাপড়িতে হবে এক সুবোধ গোলাপ। বিভেদ ভুলে
একবার বলে যাও হে আলো, তুমি কেন হও কালো বুকের স্নিগ্ধ আবাসে।

শামুক মুখ

এতকাল পরে ভাটির শামুক এক
মৃদু পায়ে চলে চর হতে লোকালয়
শহরে বীর্যের ঘ্রাণমগ্ন পোকাদের ভিড়
পথে পথে পথিক স্বার্থের ধুলোয়
অচেনা সুর নিয়ে চলে যায় একা।
দুধেল শরীর আর বাহারি আমোদ নিয়ে
বেড়ে যায় শামুকের মুখ
জলের স্রোতে টিকে থাকে কংক্রিট দেহ
তীক্ষ্ণ চুম্বন ছুঁয়ে সহসা সমুদ্র যাপন
আর গণহারে মৎস্য সঙ্গম।

জমিনের অন্তর্বাস

জলের কল্লোলে ঘুম ভাঙা রাতের কাছে
রেখেছি আনাড়ি যৌবন
মাটি-জলের তুমুল মিলনে ভাঙে চরের সম্ভ্রম।
আমাদের বেড়া দেয়া সংসারে
ঝিরঝিরে বাতাস আসে
মেঘেদের ডাকে তিরোহিত হয় নদীর শরীর।
খরাক্লান্ত তিস্তায় জাগে শুশুক শিহরণ
আবাদি মনগুলো জলের আশায়
খুলে রাখে অনন্ত অন্তর্বাস
এসবের প্রখর উল্লাসে সেদিন
রমণ জলে ভরেছে সোমত্ত জমিন।

রাতুল প্রহর

বিনিদ্র রজনী আঁকে কামক্লান্ত চোখ
নিখুঁত কালো জমে উজ্জ্বল শিরায়
তারা যদি খসে যায় আপাত নিয়মে
আঁধারে খেলা করে অনন্ত অভিমান।
উড়ে গেছে যে ডাহুক ঝোপের আড়ালে
তার তরে কেবা গায় বিলাপের সুর
জল আছে হাওয়া নাচে হৃদয় ফুলে
খোঁজ করো যতো পারো নতুন আবেগ।
ভোরগুলো তাজা প্রাণে হউক অম্লান
ঝলমল রোদ ওঠে হীরক আমোদ
পেছনের সুর ভুলে সমুখ সমর
তলোয়ার গুনে শুধু রাতুল প্রহর!

সূর্যরাঙা সিঁদুর

মধুর সময় দিয়েছে শিখর মুগ্ধতা। প্রেমাহূত পরশ এতোটা হালকা করে বুঝিনি আগে। ভাসমান বেলুন হয়ে উড়েছি বিবিধ আনন্দে। ফাঁকি দিয়ে গোয়েন্দা চোখ কেড়ে নিতাম তোমার মহাকর্ষ মমতা। মিলনের মৌতাতে নিয়ত পেয়েছি তুলোর স্বভাব। হরণের আকাঙ্ক্ষায় বারবার এসেছো নিবিড় আলিঙ্গনে। একদা সাহসের পরিধী মাপাতে চেয়ে বলেছিলে : পারো কিনা দেখি রাঙাতে সিঁদুর শোভায়! অন্ধ সামাজিক চোখে ব্যর্থ হয়েছে নিবিষ্ট কারুকাজ।
কথা ছিল কপালে সূর্যের অবিকল সিঁদুর মেখে রাঙিয়ে দেবে অমীমাংসিত অনুরাগ। তুলসী গাছ শুকিয়ে পাতায় পুজোর ঘ্রাণ মুছে গেলে তুমি হাতের কররেখা জুড়ে ছড়িয়ে দাও অবিশ্বাস্য ছলনা। আজকাল যে সিঁদুর-সূর্য নিয়ে ঘুরে বেড়াও তাতে আমার কোন অধিকার নেই। আছে শুধু এক বিমুগ্ধ ইতিহাস যা নিয়ত হত্যা করে নিঠুর ছুরিতে আর যমরাজের আদিষ্ট আজ্ঞায় প্রতিবার ফিরে পাই প্রাণ।

ঘুড়ির কথা 

বহুকাল কেটেছে এখানে
হলুদ গোলাপের বাহারি সুখে
ভাসে প্রণয়ক্লান্ত ঠোঁট আর চোখের বাগান
কাজলের গাঢ় দাগে ডুবে যেতে যেতে
প্রশস্ত ললাটে লিখে রাখি বিদায় ভাষ্য।
আরো নিচে
ছুঁয়েছি চপল তিল চুলের গোড়ায়
দিশেহীন ঝিম ধরা চোখে
ঢেউ জাগে জোয়ারের টান
আঙুল শিহরণে সমবেত ঠোঁটে লাগে দোলা।
পথের পাশে জড়িয়ে থাকে পর্বত রাত
চূড়ার মায়ায় তুলি নিবিড় টান
কম্পনের সাম্পানে চড়ে খুলে যায় পাতাল পুরি
তোমার গোয়েন্দা হাত খুঁজে আনে প্রবল নাটাই
ঘুড়ি ওড়ে তুমুল বাতাসে।

ত্রিশের সমান পথ

কালের মহান হাত ধরে চলেছি নিবিড় সবুজ প্রান্তরে
ত্রিশ বছর জুড়ে ভাটির ভুবনে বিনত নরোম বাতাসে
বেলা আর অবেলার সুর ধরে ঘর্মাক্ত গ্রাম থেকে শহরে।
এখানে নগরে বিচিত্র ঋতুর কঠিন ভেলায় ঘুরে ঘুরে
ভুলেছে প্রান্তজন রোদ-পোড়া মাঠ আর ঘুড়ি-ওড়া বিকেল
তারে দেখে মায়া হয় ছায়াহীন অবলা মানুষ অসহায়।
আধেক কাল কেটেছে মুগ্ধতায় মাটিলগ্ন মনের ভেতর
যেখানে অমল ধবল ধেনু আর সহজ মানুষের ভিড়।
দাওয়ায় বসে দেখি রোদ-রাঙা উঠোনে ফোটে বাহারি ফুল
শান বাঁধানো ঘাটের জলে মমতা-ঢেউ এলোমেলো হাওয়া।
গন্ধরাজের বিবিধ মায়ায় হাসে প্রজাপতি ডানা অম্লান
বরষা-বিমুগ্ধ বেলায় সোঁদা গন্ধে দোলে মাতাল মাটিমন।
অতঃপর যান্ত্রিক মানুষের ভিড়ে কেটে যায় বাকিটা বেলা
সময়ের ফাঁদে পড়ে মাথা খোলে বেড়ে ওটি নতুন মানুষ।
কষ্টের কাল আসে কতো বেদনার রঙ নিয়ে বেতাল তানে
বধির ব্যস্ততা ভিড়ে এসেছিল কাছে কেউ মনের তাগিদে।
পেয়েছি নতুন ভাষা তার কাছে জমা রেখে বিবিধ মনন
আপন মনে টেনেছি কাছে যারে বেমালুম চলে গেছে দূরে।
বেলা যায় জীবনের ঢেউ তোলে কিছু তার জানে নাকো কেউ
যান্ত্রিক চমকে হাসে বিস্তর বেলা আর বিষণ্ন বেদনায়।
রুজির বাজি আর হিলিয়াম চাঁদ-রাঙা রাত দিবে কতোটা
আমোদ? যে শিশির চলে গেছে সিঁদুর-সূর্য নিয়ে নিদারুণ
তার তরে চেনা জনপদের ভিড়ে কেন জাগে অচেনা ঢেউ !
শেখর দেব

কবি শেখর দেব এর সাথে কবিতা বিষয়ক আলাপ

http://earthnews24.com/2016/03/37766on:
কবি শেখর দেব
কবি শেখর দেব

কবি কবিতার উঠোনে লেপেন শিউলি ঝরা সকালের মোহনীয় শিশির বিন্দু। যার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে বাড়ন্ত বেলার কোমল সব অনুভূতি। এবং শব্দের ঝংকারে নিজেকে বেঁধে আয়োজন সারেন প্রাত্যহিক কর্মের। যা মেদহীন শব্দের মোহন জালে দোলা দিয়ে যায় পাঠক হৃদয়। শেকড়ের ঘ্রাণ অথবা দেখা-অদেখার হাজারো মিশেলে তৈরী করেন কবিতার শরীর। কবিতা কী এবং কেন কবিতা, এ প্রশ্ন যেমন চিরকাল জর্জরিত তেমনি প্রতিনিয়ত চলছে কবিতা চর্চা। থেমে যাওয়া কিংবা থেমে গেছে এ নিয়ে অনেককাল আগ থেকেও নানারকম জিজ্ঞাসা প্রতিনিয়ত উঁকি দিচ্ছে আমাদের মাঝে। একজন কবি চোখের দেখা ঘ্রাণ নিয়ে পথ চলে অবিরাম যার নাড়িভূড়ি ঘেটে ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরী করেন নানান সব  শব্দের জাদুকরি মুগ্ধতা। কবির চিন্তনের সীমারেখা বেশ সুন্দর ও সাবলীল যার রেশে হেঁটে পার করা যায় বেশ সময়।  কবি শেখর দেব তেমনি একজন কবি। কবির রয়েছে ২টি কবিতাগ্রন্থ প্রত্নচর্চার পাঠশালা (২০১৪) ও বাঞ্ছাকল্পতরু (২০১৬)। এবং বর্তমানে ‘সবুজ আড্ডায়’ ও ‘শাঁখ’ লিটল ম্যাগ সম্পদনার সাথে যুক্ত।  কবিতা বিষয়ক কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আর্থনিউজ২৪ এর সাথে কথা বলেছেন  কবি শেখর দেব 

আর্থনিউজ২৪ :  কেন কবিতা লিখেন?
শেখর : লেখার তাগিদ কাজ করে মনের ভেতর। এই তাগিদ হতে কবিতার শরীর দাঁড়িয়ে যায় কারণ কবিতায় তা প্রকাশ করতে পারি সবচেয়ে বেশি, অন্যান্য সাহিত্য মাধ্যমের চেয়ে। 
আর্থনিউজ২৪ : কবিতা কী সবার জন্য, যদি সবার জন্য না হয়, তাহলে সবার জন্য নয় কেন?
শেখর : সাহিত্য সবার জন্য। ঠিক কবিতাও। তবে কবিতা সাহিত্যের উচ্চ মার্গীয় শিল্প মাধ্যম বলে সবাই কবিতার সাথে কমিউনিকেট করতে পারে না। তাই কবিতা শেষ পর্যন্ত সবার হতে পারে না। কমিউনিকেট করতে না পারাটা মূলত কবিতার সীমাবদ্ধতার চেয়ে পাঠকের সীমাবদ্ধতাই বেশি। কবিতার পাঠক কখনো বেশি ছিল না। জ্ঞানের উচ্চতম ও নন্দনের শুদ্ধতম প্রকাশে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে না। 
shekhor-2আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক কবিতার যে  দুর্বোধ্যতা এই বিষয়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শেখর : সাম্প্রতিক সময়ে কবিতা দুর্বেধ্য এমনটা নয়। কখনো কবিতা সুবেধ্য ছিল না। কবিতা মানুষের ভাবনাকে উস্কে দেয়। ভাবনার ভুবনে ডুবাতে চায়। যারা এই ভুবনে ডুবতে নারাজ তারাই কবিতা দুর্ভেদ্য বলে। তবে বর্তমান সময়ে কিছু কিছু কবিরা কবিতাকে কবিতা করার অপারগতার কারণে দুর্ভেদ্য করে তুলছেন। এ দায় কবিদের।
আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক তরুণ কবি ও অগ্রজ কবিদের মধ্যে কি রকম কবিতা-পার্থক্য লক্ষ্য করেন?
শেখর : প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে কবিতার ভাষা বা বয়ান ভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অগ্রজ কবিরা যেভাবে বলে এসেছেন তরুণ কবিরা চায় অন্যভাবে বলতে। অন্যভাবে নিজেকে দাঁড় করাতে। এ জন্য কবিতায় বিষয়, শব্দ ব্যবহারগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
আর্থনিউজ২৪ : বর্তমানে যে গদ্যকবিতা লিখা হয়, এ বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখছেন?
শেখর : গদ্য কবিতা অনেক আগে থেকে লেখা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের “লিপিকা” কাব্যটি গদ্যে লেখা। কবিতা প্রকাশের ভিন্নতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফর্ম তৈরি হয়। প্রচলিত ছন্দের বাইরে এসে গদ্যে কবিতা লেখার জন্য কবিতার বিভিন্ন বিষয় (ব্যকরণগত, প্রকাশগত) ভালো করে রপ্ত থাকা চাই। গদ্য কবিতাকে ছন্দহীন মনে করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সুন্দর বলেছিলেন, “নৃত্যরত রমণী ছন্দ আর হেঁটে যাওয়া রমনীর ছন্দ আলাদা” তাই ছন্দহীন কবিতা হয় না। গদ্য কবিতার ছন্দ সেই হেঁটে যাওয়া রমণীর ছন্দের মতো।
আর্থনিউজ২৪ : কবির ক্ষেত্রে কখন কবিতার বই করার উত্তম বলে মনে করেন?
শেখর : যখন কবি মনে করেন তাঁর কবিতার বই করা উচিত।
আর্থনিউজ২৪ : সাম্প্রতিক কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখর : সাম্প্রতিক কবিতা বলতে কি এই সময়ে লেখা কবিতাকে বোঝানো হয়েছে? যদি তাই হয়, তাইলে বলতে হয় সাম্প্রতিক কবিতা বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আর্থনিউজ২৪ : কবিতায় যে উত্তর-আধুনিক ফর্ম, এই বিষয়কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শেখর : উওর আধুনিকতা হলো কবিতা বিষয়ক চিন্তা ও চেতনা, কবিতার দর্শনও বলা চলে। এটা কোন ফর্ম না হলেও উত্তর আধুনিক কবিতার একটি ফর্ম আপাত দাঁড়িয়ে গেছে বলে আমার ধারনা। বিষয়গত দিক হতে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মাটিলগ্ন মানুষের সুর, লোকাচার, মিথ, পুরাণ ও ছন্দগত দিক হতে প্রচলিত ছন্দ হতে বেরিয়ে এসে কথন স্পন্দের প্রতি জোর কবিতাকে একটি ফর্ম দিয়েছে বৈকি।
আর্থনিউজ২৪ : ভবিষ্যতে কবিতার ট্রেন্ড কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন?
শেখর : কবিতা বহতা নদীর মতো তাঁর পথ বেছে নিবে। মানুষের আচার, সংস্কৃতি এসবের পরিবর্তনের সাথে সাথে কবিতাও পরিবর্তিত হবে।
আর্থনিউজ২৪ : বর্তমান সময়ে কার কার কবিতা আপনার ভালো লাগে?
শেখর : বর্তমান সময়ে অনেকের কবিতা ভালো লাগে। সবার সব কবিতা হয়তো ভালো লাগে না তবে অনেকের কবিতায় চমক আমাকে মুগ্ধ করে।

শেখর দেবের কবিতা

শেখর দেবের কবিতা2015-12-17T10:52:44+00:00
কখনো পাইনি কোন রোমাঞ্চকর কান্নার রাত
ভাসায় তবু দীর্ঘ কুহকের অনুভূতি
সেসব অতৃপ্তির আঁধারে হাসে প্রগাঢ় প্রমাদ
চুমুর বিনিময়ে দিয়েছি মনের দামে কেনা সমূহ সঞ্চয়!
ব্যক্তিগত পুকুর অথবা পাখির কথা

চড়ুইভাতি পুকুরে ভাসে পদ্মের দল। পুকুরে বাড়ন্ত মীনের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমাদের অপার আমোদ। কী সুন্দর দুলেছে
পৃথিবী। চারপাশে শৈশবের বন্ধুরা যে যার মতো গড়েছে সংসার। অথচ আমার কোন ব্যক্তিগত পুকুর ছিল না। সেই থেকে চড়ু
ইভাতির দিন এলে পুকুর পাড়ে মালিকানার আশায় কেটেছে সময়। পাশে ঘনকালো ছায়ারা খেলেছে বাহারি মুগ্ধতায়।
মনে হলো কী হবে পুকুর দিয়ে বরং ব্যক্তিগত কোন পাখি দরকার। যার ডানায় বাতাসের সুগন্ধ আর ঠোঁটে বিবিধ ফলের সুবাস।
একদিন পাখির আধখাওয়া ফলে কামড় দিয়ে জেনেছি পাখিদের কোন মালিকানা হয় না। এসব ইচ্ছের মাঝে একদিন সংসারে হানা
দিল জন্মগোত্রহীন শারমেয় দল। পুকুরের মাছ আর আকাশের পাখির কথা ভুলে সারারাত ঘুরেছি বনে বাদাড়ে। জঠরের অন্ধকার
ভেদ করে যেদিন আলোর মুখ দেখলাম ততোদিনে কেটেছে বীভৎস নয় মাস।

পাখির ডানায় পোড়া মানচিত্র

আমাকে বেদনাহত পাখির কাছে নিয়ে চলো
যার ডানায় ঝুলে আছে পোড়া মানচিত্র
আর রাক্ষুসীর বীভৎসা বাসনা।
রক্তাক্ত বুলেট থেকে কুড়ানো স্বপ্নগুলো
চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে।
পেট্রোল বোমার আগুন-থাবায় পুড়ে
মানুষের বিবেক আর ট্রাক ড্রাইবার শহীদুল
অথচ কারো তরুণ তর্জনী দোলে না!
নতুন বইয়ের ঘ্রাণে বিমুগ্ধ কিশোরীকে
কী কৈফিয়ত দেবো?
ড্রাগন নাগিনীর মুখের আগুনে
জ্বলে চুলের ফিতা আর চঞ্চল চিবুক
পাঠশালার স্নিগ্ধ সময় যার কাটে
হাসপাতালের ব্যান্ডেজেÑ কালের কাতরাতায়।
ফাগুনের ফুল কতোটা সুবাস ছড়ালো
কতোটা পোড়ার ঘ্রাণ আকাশে বাতাসে?
রাক্ষুসীর বাতাস লাগা বিমর্ষ বাংলায়
ভেঙে যায় নিবিড় সুখের ঘুম।
চোখে ডিজিটাল স্বপ্নের ভেতর
দেখি দগ্ধ দামাল আর পিতার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন।
সংবিধান কি বোঝে না মায়ের বেদনা?
আত্মঘাতী বাঙালির স্বপ্নের ভেতর
পিঠে আগুন নিয়ে কতদূর উড়ে যাবে পাখি!

কৃষ্ণপক্ষ

তোমার ইশারায় কাঁপে ঋতুজ মনন। চারপাশে কৃষ্ণপক্ষের ধাঁধা। আমাকে দেখেই চঞ্চল চড়ুই স্বভাবে লাফিয়ে উঠতো হৃদয়ের
বহুমুখী মেধারা। এসব অপরিমেয় মেধার ভেতর ক্রমশ হারিয়ে সংযত শান্ত মনে কী যেন বলতে গিয়ে চুপসে গিয়েছি লজ্জাবতীর
আদলে। অথচ আমার ভেতর আছে নিশ্বাসের নিষিদ্ধ ঝংকার আর চলিষ্ণু ঝরনার খরবেগ। এসব মন ও মেধার পাঠ হারিয়ে গেছে
নাপোড়ার ছড়ায়।
আজ যারা নিজের ওজনের চেয়ে ভারী স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাঁটে আর লজ্জানত চোখে চারপাশে তাকায়, তাদের কাছে তুলে দিয়েছি
সম্ভাবনার প্রতিটি ফুল। কৃষ্ণপক্ষ পেরিয়ে এসে অন্তর্গত বিস্ময়ে দেখি তোমার সিঁথির বিদ্যুৎ রেখায় রক্তাক্ত একাত্তর। সমগ্র জীবন
বাজি রেখে ভেবেছি যে পথ সত্য সে পথ আমার। অথচ সে পথেই কালো পিচাশের আঁধার। কোন অজানা কারণে অকালপক্ক ভাঁড়ের
হাতে দিয়েছি মননের জামানত!

তিলোত্তমা জাদু

আকাশ জুড়ে কদম ঘ্রাণে বৃষ্টি অনাবিল
নিবিড় প্রাণে মনরে টানে মিষ্টি জাদুর তিল।
তিলেক সময় চোখ ফেরে না নিবিড় অনামিষা
বৃষ্টি বুঝি তুমুল মাতাল মিটিয়ে দেবে তৃষা।
চুলের নেশায় আঁধার নামে গোপন চোখে মুখে
আকাশ নীলে লীন হয়ে যাই মদির বায়ুর সুখে।
তিল দেখেছি চিলের ঢঙে দেহের মেঘে ঘুরে
ঠা-া বায়ুর স্রোত নেমেছে বৃষ্টি অচিনপুরে?
চোখের পানে চোখ রেখেছি বুঝি মনের ভাষা
মেঘ কাটে না নীল দেখি না তবে কি দূর আশা?
ভাষার জাদু আশার মধু নিয়ে বৃষ্টি নামে
ছলছলিয়ে জল গড়িয়ে যায় যে ডানে বামে।
ওগো জাদু এমন দিনে কেমন আছো একটু বল না
‘এসব তেমন বুঝি না বাবু জানি না জানি না!’
চোখের তারায় ঠোঁটের মায়ায় গরম বাতাস মৃদু
তিলের ম্যাজিক মন্ত্রে তুমি তিলোত্তমা জাদু।

সুগন্ধী বাগান
http://dhakareview.org/%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE/ 
কখনো পাইনি কোন রোমাঞ্চকর কান্নার রাত
ভাসায় তবু দীর্ঘ কুহকের অনুভূতি
সেসব অতৃপ্তির আঁধারে হাসে প্রগাঢ় প্রমাদ
চুমুর বিনিময়ে দিয়েছি মনের দামে কেনা সমূহ সঞ্চয়!
হৃদয়ঘন কালে চোখ বন্ধ হয়ে এলে
চারপাশের আলোকে চুষে করেছি রাত
অতঃপর আঁধারের আরাধ্য আরতি!
উন্মোচিত শরীরে ফুটে সুগন্ধী ফুল
ক্রমশ রমণীয় ফুলের বাগানে হয়েছি বিভোর।
পৃথিবীতে পরম কোন অধ্যায় নেই
পরমার চোখে বেড়েছে দিন
যার মতো কোন সুগন্ধী বাগান দেখিনি আর।
প্রকাশিত প্রথম কাব্য ‘প্রত্নচর্চার পাঠশালা’। জড়িত আছেন ছোট কাগজ ‘শাঁখ’ সম্পাদনার কাজে। শেখর দেব চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার শেখেরখীল গ্রামে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিশুদ্ধ গণিতে স্নাতকোত্তর শেষে একটি কমার্শিয়াল ব্যাংকে কর্মরত ।

শেখর দেব এর পাঁচটি কবিতা

http://jolbhumi.blogspot.com/2014/05/blog-post_6.html






শেখর দেব এর পাঁচটি কবিতা

শামুক মুখ


এতকাল পরে ভাটির শামুক এক
মৃদু পায়ে চলে চর হতে লোকালয়
শহরে বীর্যের ঘ্রাণমগ্ন পোকাদের ভিড়
পথে পথে পথিক স্বার্থের ধুলোয়
অচেনা সুর নিয়ে চলে যায় একা।

দুধেল শরীর আর বাহারি আমোদ নিয়ে
বেড়ে যায় শামুকের মুখ
জলের স্রোতে টিকে থাকে কংক্রিট দেহ
তীক্ষè চুম্বন ছুঁয়ে সহসা সমুদ্র যাপন
আর গণহারে মৎস্য সঙ্গম।

পাখিদের দেহবিদ্যা


নতুন দোলায় দোলে পাখি
ডানার হাওয়ায় নাচে অমারাত্রির ঘোর
বিবিধ বিজারণে লাগে প্রাচীন সুর
রাতগুলো তোমার বিনিদ্র চুলে হাহাকার।

যেপথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন জড়ো হয়
সেখানে জ্বলে ওঠে হন্তারক আলো
যার কাছে তেজোদীপ্ত মুদ্রাগুলো
নিমেষে নুয়ে পড়ে অসহায়।

তোমার পাখি জীবনে
নিজেকে ভেবেছি গাছের শাখা
শেকড়ের কথায় উদাসীন হতে না পেরে
ব্যর্থ হয়েছে বিবিধ উড়ালবিদ্যা।

মেঘের কাছে রেখেছিলাম যাপনের গন্ধ
বৃষ্টির ধারায় সে বলে গেল-
মহান মানুষীরা উড়ে যায় দূরে
পড়ে থাকে অসমাপ্ত আয়োজন
আর দেহবিদ্যার তুমুল কসরত।
 

বাঁশিবিদ্যা


সখিনা বোঝে শুধু মমতার ভাষা
পিচ্ছিল সুখ নিয়ে হাওয়া দোলে
মন ছোটে চারিদিক নরোম আরাম।

নাতিদূর দেহ ভেলা আনত ভুবন
নড়েচড়ে রমরমা দেয় প্ররোচণা
বায়ুবেগে বেজে ওঠে সুরের বাঁশি।

সুর ওঠে রঙ লাগে বর্ণিল তান
গান হয় জল বাজে মরম জ্বলে
ঘোর লাগে ঝিম ধরে সুরার মন।

 

রাতুল স্বর


সময়ের হাতে হাতে বেড়ে ওঠে নতুন নিয়তি
নিদাগ মননে লাগে কতো বিনোদন- নিশিদিন
গাঁয়ে ফিরি মেঠোপথে স্বপ্নবাজ- উদোম বালক
যেখানে পুকুর আর মাছ ধরা জাল- মাছরাঙা।

উড়ে যায় বিলের বলাকা নিখুঁত নিয়ম মেনে
উঠোনে বিকেল নামে লালরাঙা- কবুতর ডানা
জানালার পাশে বসে পরিচিত আলো ঝলমল
মেহগনি গাছে, জ্বলে গেছে ভোর- অন্তিম আগুন
চোখের আলোয় নিভে যায় দিদির দলিত মন।

পুকুর ঘাটের কথা বলব কী! চিনেনি আমায়
কামরাঙা গাছ শুধু হেসে হেসে তির্যক দুলেছে
ওপাড়ার সনাতন সুধিজন হেঁটে গেছে পাশে।

বেড়েছি দারুণ স্রোতে সময়ের তালে- ভদ্রলোক
শিমুল তমাল আমি উঠেছি উঁচুতে ভাসমান
হয়ে গেছে ছোট সব পুকুর গুদাম গোলাঘর
চেনা পথ সুর তোলে অচেনারে ডাকে অনায়াসে
কান্নার কেমন স্বর চুপচাপ রাতুল বেদনা।

ভালোবাসা ছাড়া নাই কোন ফুল


ফুলের কাছে তার গন্ধযাপনের
অম্লান ইতিহাস জানতে চেয়ে
ঈশ্বরের পুজোতে বলি দিয়েছি
পাশবিক প্রেম।
সেই থেকে মসজিদের আযান আর শাঁখের শব্দে
যুগপৎ বেদনায় ডুবে যাই
        ফুলের নির্মোহ অন্তরে।

অন্ধ আর বধির প্রেমের শরীর নিঙড়ে
            নির্বাণের ঘোরে
ফুলের সহজাত স্নিগ্ধতার ভেতর
জেগে আছে
ভালোবাসার সুন্দর অন্দর।

এতকাল ঘুরে ঘুরে বুঝেছি
পৃথিবীর অসীম অন্তরে
যে ফুল ফুটে অছে
নাম তার ভালোবাসা ভালোবাসা।

গদ্য কবিতার করিডোর ও প্রবণতা: শেখর দেব

https://adititithi.wordpress.com/2014/11/28/%E0%A6%97%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A1%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%93-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC/ shekhor-deb1
আজকাল গদ্য কবিতার কথায় কবিতার পাঠক তেমন অবাক হন না। বিভিন্ন কাগজে কবিতা নাম দিয়ে ছাপানো গদ্য আকারের রচনাগুলোই গদ্য কবিতা, এভাবে পরিচয় দিলে কি গদ্য কবিতার পরিচয় আদৌ ফোটে? অতি সাধারণ পাঠকদের জন্য এভাবে বলা ছাড়া জো নেই। তবুও যারা কবিতা লিখি ও পড়ি তারাও কি উপলব্ধি করতে পারি গদ্য কবিতা আসলে কী? ‘গদ্য কবিতা’ কি কবিতা থেকে আলাদা কিছু? কবিতা তো কবিতাই। তার আগে গদ্য বিশেষণটি লাগিয়ে আলাদা করে প্রকাশ করার মানে কী? আসল কথা হলো কবিতার একটি ফর্মকে নির্দেশ করে গদ্য বিশেষণটি দিয়ে। কবিতারও আছে রকমফের। এর কারণ কবিতার অন্তর্গত গঠনশৈলী। গঠনগত ভিন্নতার কারণে কবিতা হয় বিভিন্ন রকমের। কবিতার দেহ গড়ে ওঠে শব্দের অমোঘ বন্ধনে, ভাবের নিবিড় বিন্যাসে। প্রাচীন কাল হতে কবিরা শব্দের এ বন্ধন ও ভাবের এ বিন্যাস ঘটিয়েছেন বিবিধ ছন্দের মাধ্যমে।
ছন্দের ভিন্নতার জন্য কবিতা হয়ে ওঠেছে বিভিন্ন রকম। আমরা বাংলা কবিতার প্রধান তিন ছন্দ সম্পর্কে জানি। অক্ষর, মাত্রা ও স্বর এই তিন ছন্দের কবিতার জন্য কবিতাকে আমরা তিন রকম বলতে পারি। নদী যেমন চলতে চলতে পথ পরিবর্তন করে, গড়ে নেয় নিজের পথ। ঠিক তেমনি বাংলা ছন্দও কবিতার শরীর বেয়ে চলতে চলতে নতুন নতুন ছন্দ বানিয়ে নিয়েছে তার নিজের চলার পথকে সুগম করার জন্য। ঠিক এভাবেই আধুনিক যুগে কবিতার শরীরে এলো নতুন ছন্দ। যাকে আমরা বলেছি গদ্যছন্দ। গদ্যছন্দ দিয়ে লিখিত কবিতাই কি গদ্য কবিতা? এখন এ প্রশ্নের উত্তর দেয় শক্ত ব্যাপার। এ প্রশ্নের উত্তরের দিকে পরে আসছি। আগে আমরা গদ্যের কথায় আসি। গদ্যে কি আসলে কোন ছন্দ আছে? গদ্য মানেতো সরল কথা মাত্র।
এখানে ছন্দ কী? কথাকে ছন্দের সুতোতে গাঁথলেই তো কবিতা হবে। গদ্য তো ছন্দে বাঁধা যায় না। আবার গদ্য কবিতা কী? এসব প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু গদ্য কবিতা লেখা হচ্ছে গদ্যের মতো করেই। গদ্যটি যখন কবিতার ভাব লাভ করছে ঠিক সেই মুহূর্তেই গদ্যটি আর গদ্য না থেকে কবিতা হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কবিতাকে গদ্য কবিতা বলে আলাদা চিহ্নিত করার কিছু নেই। কবিতা কবিতাই। শুধু তার ফর্মটা বোঝানোর জন্যই আমরা তার নাম দিয়েছি গদ্য কবিতা। এখন প্রশ্ন আসে একটি গদ্য কখন কবিতার মর্যাদা লাভ করে? অর্থ্যাৎ গদ্যে এমন কী থাকে যে এটাকে আমরা কবিতার সমান মূল্য দিচ্ছি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেল দেখবো— এখানেও এক প্রকার ছন্দ আছে, নাম গদ্যছন্দ। অর্থ্যাৎ গদ্য কবিতা বলতে ছন্দহীন কোন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের ছন্দ শব্দটির আশ্রয় নিতেই হলো। কবিতাকে গদ্য কবিতা বলেও ছন্দ শব্দটি পরিত্যাগ করতে পারলাম না। ‘ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য ছিল এরকম—‘সাত্ত্বিক কবিমাত্রেই গদ্যপদ্যের বিবাদ মেটাতে চেয়েছেন কিন্তু কৃতকার্য হননি। এতদিন পরে রবীন্দ্রনাথের অধ্যবসায়ে হয়তো বিরোধ ঘুচল’।
এখন মনে প্রশ্ন আসলো রবীবাবু গদ্য কবিতা নিয়ে কী অধ্যবসায়টি করলো? রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীর সাথে এক আলোচনায় বলেছিলেন— ‘ভাবকে এক-একটি ছন্দের কাঠামোর আনুগত্য মেনে চলতে হয়। কিন্তু যাকে গদ্যকবিতা বলা হয় তার নিয়মরীতি স্বতন্ত্র। তার বিশেষত্ব হচ্ছে— ভাবের আনুগত্য স্বীকার করতে হয় ছন্দকে, ভাবের মধ্যে ছন্দের গতিবিধি, ভাবভঙ্গি দেয় ছন্দকে। যদি নতুন বলে এর প্রতি বিমুখ হও তাহলে এর মধ্যে যে ছন্দ আছে তার পরিচয় পাবে না।’ আসলেই রবীন্দ্রনাথের কাছেই যেন আমাদের সবকিছুর সমাধান! কবি হুমায়ুন আজাদ ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যথার্থই বলেছেন—‘অকাশে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, আমরা সূর্যের স্নেহই পাই সারাক্ষণ। সূর্য ছাড়া আমাদের চলে না। তেমনি আমাদের আছেন একজন, যিনি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য। তার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
গদ্যকবিতার কথা বলতে গিয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘ছন্দের ’সহজ পাঠ’’ প্রবন্ধে একটি প্রচলিত মজার কথা বলেছেন এভাবে—‘গদ্যকবিতার কথা যখন উঠলই, তখন এই নিয়ে যে রসের কথাটা এককালে খুব শোনা যেত, সেটাও বলি। অনেককেই তখন বলতে শুনেছি যে, টানা একপাতা গদ্য লিখে তারপর ইরেজার দিয়ে তার দু’পাশটা একটু এলোমেলোভাবে মুছে দিলেই সেটা অমনি গদ্য কবিতা হয়ে যায়। খুবই যে মোটা দাগের রসিকতা, তাতে সন্দেহ নেই। যারা বলতেন, তাঁদের সঙ্গে তর্ক করতেও রুচিতে বাধত বলেই আমার এক বন্ধু মন্তব্য শুনে একটুও না হেসে খুব অবাক হবার ভান করে বলতেন, “মুছতে যে হবেই, এমন কথা কে বলল। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। না-মুছলেও কবিতা হয়”। বাজে রসিকতার এটাই ছিল মোক্ষম জবাব।’ কবিতা কী? সেটা আমরা কেউ ভালোভাবে বলার প্রয়াস না পেলেও, সবাই বুঝি। কবিতার মধ্যে কাজ করে অন্যরকম এক দ্যোতোনা। সেটা হউক ভাবের উপর ছন্দের শাসনে অথবা ছন্দের উপর ভাবের শাসনে। কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতাই, যেখানে ভাব ও ছন্দের সুষম সমন্বয় ঘটে। কবিতা নিয়ে কোলরিজ বলেছেন—‘শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্ঠ ব্যূহ’ আর মালার্মে বলেছেন ‘শব্দই কবিতা’।
এ কথাগুলো কতটুকু যথার্থতা তা বিচার না করে বলা যায় শব্দের মাধ্যমে ভাব ও ছন্দের সুষম বিন্যাসই কবিতা। গদ্য কবিতার কথায় আসি। নেহায়েত গদ্যের কথার মধ্যেও যে অন্যবিধ দ্যোতনা আছে সেটা নীরেন্দ্রনাথ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের দুটি গল্প যথাক্রমে ‘একরাত্রি’ ও ‘ত্যাগ’থেকে কিছু পঙ্ক্তি তুলে এনে দেখিয়েছেন। পঙ্ক্তিগুলো এখানে উল্লেখ করলাম— “তখন প্রলয়কাল,তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে— তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না— কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেহ কাহাকেও একটা কুশলপ্রশ্নও করিল না। কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম। পদতলে গাঢ়কৃষ্ণ উন্মত্ত মৃত্যু¯্রােত গর্জন করিয়া ছুটিতে লাগিল” এবং “কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী। অন্ধকার রাত্রি। পাখি ডাকিতেছে না। পুষ্করিণীর ধারের লিচুগাছটি কালো চিত্রপটের উপরে গাঢ়তর কালির প্রলেপের মতো লেপিয়া গেছে। কেবল দক্ষিণের বাতাস এই অন্ধকারে অন্ধভাবে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন তাহাকে নিশিতে পাইয়াছে।”
এই লাইনগুলো পড়ে আমরা অবাক হই গল্পে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ কাব্য করেছিল। এই কথাগুলোর মধ্যে অন্যরকম দ্যোতোনা আছে এবং ছন্দের কথা ভাবারও অবকাশ দেয় না। শব্দাবলির মাঝে পরস্পরের বন্ধন ও ধ্বনি বা ভাবের প্রবাহ আমাদের কবিতার মতোই মোহিত করে। অর্থ্যাৎ অন্যরকম এক ভাবছন্দ আমাদের হৃদয়ে ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথ যখন গীতাঞ্জলী ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন তখন তিনি ভেবেছিলেন—‘পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্য কবিতার রস দেওয়া যায় কি না।’ রবীন্দ্রনাথ ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকেও অনুরোধ করেছিলেন, তিনি গদ্য কবিতাকে স্বীকার করেছিলেন কিন্তু নিজে চেষ্টা করেননি। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ নিজেই গদ্য কবিতা লিখার প্রয়াস পান। ‘লিপিকা’ তারই পরীক্ষার ফল। ‘লিপিকা’ কাব্য হতে ‘বাঁশি’ গদ্য কবিতাটি পড়ে দেখুন—
“বাঁশির বাণী চিরদিনের বাণী— শিবের জটা থেকে গঙ্গার ধারা, প্রতি দিনের মাটির বুক বেয়ে চলেছে; অমরাবতীর/ শিশু নেমে এলো মর্তের ধূলি দিয়ে স্বর্গ-স্বর্গ খেলতে।/ পথের ধারে  দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনি আর মন যে কেমন করে বুঝতে পারি নে। সেই ব্যথাকে চেনা সুখদুঃখের সঙ্গে/ মেলাতে যাই, মেলে না। দেখি, চেনা হাসির চেয়ে সে উজ্জ্বল, চেনা চোখের জলের চেয়ে সে গভীর।/আর, মনে হতে থাকে, চেনাটা সত্য নয়, অচেনাই সত্য। মন এমন সৃষ্টিছাড়া ভাব ভাবে কী করে। কথায় তার/কোন জবাব নেই।/আজ ভোরবেলাতেই উঠে শুনি, বিয়েবাড়িতে বাঁশি বাজছে।/বিয়ের এই প্রথম দিনের সুরের সঙ্গে প্রতি দিনের সুরের মিল কোথায়। গোপন অতৃপ্তি, গভীর নৈারশ্য; অবহেলা,/অপমান, অবসাদ; তুচ্ছ কামনার কার্পণ্য, কুশ্রী নীরসতার কলহ, ক্ষমাহীন ক্ষুদ্রতার সংঘাত, অভ্যস্ত জীবনযাত্রার ধূলিলিপ্ত/ দারিদ্র— বাঁশির দৈববাণীতে এ-সব বার্তার আভাস কোথায়।/গানের সুর সংসারের উপর থেকে এই-সমস্ত চেনা কথার পর্দা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। চিরদিনকার বর-কনের/শুভদৃষ্টি হচ্ছে কোন্ রক্তাংশুকের সলজ্জ অবগুণ্ঠনতলে, তাই তার তানে তানে প্রকাশ হয়ে পড়লো। যখন সেখানকার/মালাবদলের গান বাঁশিতে বেজে উঠলো তখন এখানকার এই কনেটির দিকে চেয়ে দেখলাম; তার গলায় সোনার হার,/তার পায়ে দুগাছি মল, সে যেন কান্নার সরোবরে আনন্দের পদ্মটির উপর দাঁড়িয়ে।/সুরের ভিতর দিয়ে তাকে সংসারের মানুষ ব’লে আর চেনা গেল না। সে চেনা ঘরের মেয়ে অচিন ঘরের বউ হয়ে/দেখা দিলে। বাঁশি বলে এ কথাই সত্য।”
এ ছিল রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতার ধরন। কথিত ছন্দমুক্ত। কিন্তু একটি নিবিড় বার্তা আছে। ভাবের ছন্দ আছে। দৃশ্য আছে। এই গদ্য কবিতাও কি বর্তমান সময়ে এসে সেই রবীন্দ্রনাথের দেখানো জায়গায় আছে? সে কথায় পরে আসছি। ‘লিপিকা’ কাব্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন—‘গদ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সলজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ রেখে এই গন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে তাতে মিল নেই, পদ্য ছন্দ আছে, কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছি। যেমন—তরে, সনে, মোর প্রভৃতি যেসকল শব্দ গদ্যে ব্যবহার হয় না সেগুলিকে এই সকল কবিতায় স্থান দিইনি।’
রবীন্দ্রনাথ শুধু নিজেই গদ্য কবিতা লিখতে প্রভৃত্ত হননি অবনীন্দ্রনাথকেও অনুরোধ করেছিলেন লিখতে। এবং তিনি লিখেও ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’য় সংকলন করে নিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথেরও একটি গদ্যকবিতা। এবং সংকলন বিষয়ে সম্পাদক বলেছেন—‘অবনীন্দ্রনাথের গদ্যই যে কবিতা, তার একটা চাক্ষুস প্রমাণ উপস্থিত করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি।’ মূলত অবনীন্দ্রনাথের গদ্য রচনার ক্রিয়াপদগুলোকে নেড়ে চেড়ে দিয়ে বুদ্ধদেব বসু এই কবিতা হাজির করেছিল। এটা আমরা জানতে পারি শঙ্খ ঘোষকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর চিঠি হতে । বুদ্ধদেব বসু শঙ্খ ঘোষকে লিখেছিলেন—‘তুমি যে গরমিলগুলো লক্ষ করেছো তার কারণ খুব সম্ভব এই যে অবনীন্দ্রনাথের রচনাংশটিকে গদ্যকবিতা রূপ দিতে গিয়ে আমি দু-একটি শব্দের হেরফের করেছিলাম।…. তোমাকে না বললেও চলে, আমার লক্ষ্য ছিল ধ্বনিসৌষম্যের দিকে—“কিন্তু আমি গেয়ে চলি”-র বদলে “—গান গেয়ে চলি”, “সারারাত কাঁদছে”-র বদলে “কাঁদছে সারারাত” আমার শ্রবণের পক্ষে অধিক প্রীতিকর।’ বুদ্ধদেবের এই চিঠি গদ্য কবিতায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার বিষয়ে আমাদের সচেতন করে। সাধারণ গদ্যে আমরা সাধারণত ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু যদি সে ক্রিয়াপদ আমরা বাক্যের ভেতরে নিয়ে আসি তখন তার আলাদা আবেদন তৈরি হয়। কবিতা একটু ভিন্নতা আশা করে। গদ্যকে কবিতা করার অথবা গদ্য কবিতা লেখার একটি কৌশল হতে পারে এটি। যেমন— ‘উপাচার হাতে উপভোগের বর চেয়েছি’, এটি সরল গদ্য বাক্য। যদি বাক্যটি লিখি এভাবে—‘উপাচার হাতে চেয়েছি উপভোগের বর’। তখন বাক্যটিতে একটি আবেদন তৈরি হয়, হয়ে ওঠে বাক্যের ঠাস বুনন। নিচের গদ্য কবিতাটি পড়লে ক্রিয়াপদের ব্যবহার সম্পর্কে আঁচ করা যায়—
ধ্যানের সুরভিতে খুঁজেছি সুকোমল সাধন। উপাচার হাতে
চেয়েছি উপভোগের বর। প্রকটিত দেহে দেখেছি আশীর্বাদের
হাত, পেয়েছি মায়াবি ত্রিশূল। উপভোগের ভাগ দেবে বলে
ত্রিশূলে বেঁধেছ প্রাণ। অবশেষে সাধন ধন পদতলে ঢেলে
বানিয়েছি দেবী।
[ মোহনদেবী, প্রত্নচর্চার পাঠশালা]
এই কবিতায় নিম্নরেখাঙ্কিত ক্রিয়াপদগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রতিটি ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে ব্যবহার করলেও এ কবিতার ম্যাসেজে কোন পরিবর্তন হতো না। তবে সেক্ষেত্রে কবিতাটি কবিতার মর্যাদা হারাতো। কবিতার টান টান ভাব প্রবাহ বা ভাবছন্দের মাঝে ছেদ পড়তো। লাইনগুলোর মধ্যে পরস্পরের বন্ধন হয়ে যেত ঢিলঢিলে। বুদ্ধদেব বসু কেন অবনীন্দ্রনাথের গদ্যরচনাকে কবিতা করতে গিয়ে ক্রিয়াপদের নড়াচড়া করেছেন তা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি আমরা। গদ্য থেকে গদ্য কবিতাকে আলাদা করতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন—‘অন্তর্মুখী বিষয়কেও গদ্য ধরতে চায় তার বাইরের দিকে উদ্ঘাটন করে। কাবিতায় আছে এর উলটো চলন। কবিতা বাইরের বিশ্বকেও আয়ত্ত করতে চায় ভিতরের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে। এক-একটা মুহূর্ত আসে যখন আমাদের বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা, আমাদের বোধি আর প্রেরণা সমবেতভাবে সংহত হয় চেতনার এক কম্পমান বিন্দুতে, তৈরি হয় যেন শিখার মতো দীপ্যমান একটি রেখা, এই রেখাটিকে বিন্যস্ত করতে পারার মধ্যেই কবিতারচনার করণকৌশল লুকোনো।’
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন  তখন ইংরেজি গদ্যেই তা অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু ইউরোপের কবিতা প্রেমিকরা তা কাব্য বলে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি বরং তাঁকে নোবেল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরকে গদ্য কবিতা লেখার প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করলে বেশি মনে করা হবে না। কারণ অমিত্রাক্ষরের মাধ্যমে মধুসূদন পয়ারের আষ্টেপৃষ্ঠের বন্ধন থেকে কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। পয়ার ছন্দ হলো ১৪মাত্রার। প্রথম আট মাত্রার পরে অর্ধযতি, পরের ছয় মাত্রার পর পূর্ণযতি আর অন্ত্যমিলের খেলা। কিন্তু অমিত্রাক্ষর পয়ারের এ নিয়মকে ভেঙে দিয়ে ১৪ মাত্রা ঠিক রেখে প্রতিটি লাইনের শেষে পূর্ণযতি ঠিক না রেখে তাকে প্রবাহিত হতে দিল ইচ্ছে মতো। অনেক সময় পূর্ণযতি আসলো পরের লাইনের মাঝে। প্রতি লাইনের শেষে থমকে না দাঁড়িয়ে অমিত্রাক্ষরে আসল স্বচ্ছন্দ সাবলীল গতি। বাড়লো শব্দ ও ধ্বনিমাধুর্য। তবে এটা ঠিক, অমিত্রাক্ষরও ১৪ মাত্রার বাঁধন হতে বেরিয়ে আসতে পারলো না। গদ্য কবিতার মাঝেও অমিত্রাক্ষরের মতো সাবলীল প্রবাহ ও জযুঃযসরপ ঋষড়ি আছে।
রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতাকে পদ্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখেছেন। অর্থাৎ এ যেন অন্য প্রকারের কবিতা। ঠিক আক্ষরিক ছন্দহীন গদ্যের ছন্দে লিখিত কবিতা। তিনি বলেছেন—‘পরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়ের সৌন্দর্য নয়।’ গদ্য কবিতা ছন্দেবদ্ধ কবিতা থেকে একদম আলাদা কিছু নয়, শুধু মাত্রাগত ছন্দের মুক্তি। কবিতাকে সবসময় কবিতাই হতে হয় সে হউক পদ্য অথবা গদ্য। রবীন্দ্রনাথের মতো করে বল্লে—‘সাধারণত যাকে কাব্য বলি সেটা হচ্ছে বচন-অনির্বচনের সদ্য-মিলনের পরিভূষিত উৎসব।’
২)
এবার আসি গদ্যছন্দের কথায়। গদ্যের যে স্বাভাবিক ছন্দ বা গদ্যের যে ছন্দ তা ঠিক গদ্যছন্দের অনুরূপ নয়। পার্থক্যটা হলো— গদ্যের যে ছন্দ তা গদ্যের ছন্দ আর গদ্য কবিতার যে ছন্দ তা হলো গদ্যছন্দ। এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষ ‘গদ্যকবিতা ও অবনীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের ফুটনোটে লিখেছেন—‘সুরচিত গদ্যমাত্রেরই একটা ছন্দপ্রবাহ আছে। তার ধ্বনির উত্থান-পতনে, তার যতির হ্রস্বদীর্ঘতায়, তার শব্দব্যবহারের সুমিত বলয়ে— তৈরি হয় এই ছন্দ। এর কোন পূর্বনির্দিষ্ট নিরূপিত ধরণ নেই। একেই বলা যায় গদ্যের ছন্দ। এই ছন্দ শুনেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু একদিন মুগ্ধ হয়েছিল তার ছেলেবেলার পাঠশালায়, ভেবেছিল বড়ো হয়ে খুঁজে নেবে রামায়ণ-মহাভারতের দেশ। আর এর তুলনায় গদ্যছন্দ কথাটির প্রয়োগ একটু বিশেষিত। গদ্যকবিতা নামে চিহ্নিত যে বিশেষ রচনাশ্রেণীটি, এ হলো তার ছন্দ। এরও নেই কোন পূর্ব-নির্ধারিত রূপ। কিন্তু শ্রুতিতে বা অনুভবে বুঝে নেওয়া যার সাধারণ গদ্যের ছন্দের থেকে এর স্বতন্ত্র এক স্পন্দন, হয়তো খানিকটা ছোটো আর সুষমাময় হয়ে আসে এর শ্বাসপর্বগুলি।’ আগেই উল্লেখ করেছি গদ্যছন্দ মূলত ভাবের ছন্দ। কবিতাকে কবিতা বলার জন্য ছন্দ অথবা ছন্দহীনতা বড় বিষয় নয়। বড়ো বিষয় হলো কবিতাকে কবিতার নির্যাসে ধারন। সেই নির্যাস ধারনের একটি উপাদান হলো ছন্দ যেটা অনেককাল যাবৎ কবিতার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসাবে ছিল। কিন্তু গদ্য কবিতায় যাকে বাতিল করা হলো। আসলেই কী বাতিল করা হলো? মোটেই না। শুধু ছন্দের গণিত বাদ পড়লো। আসলো ভাবের আর বাক্যের প্রবাহমানতার ছন্দ। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানো কবির বরং কঠিনই হয়ে গেল! কবিত্ব কী দেখানোর জিনিস? উত্তর হবে না। কবিত্ব হয়ে ওঠার ব্যাপার। একজন কবি, কবি হয়ে ওঠার মাধ্যমে যা লাভ করে। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানোর সুযোগ আরো বেড়ে যায়। কারণ এখানে গাণিতিক ছন্দের হিসেব কষে কবিতা লিখতে হয় না। আবেগের ঘোড়াকে ভাবের ছন্দে বেঁধে গদ্য কবিতা আগায়। মঞ্চে নৃত্যরত রমণীর মতো ধরাবাঁধা ছকে নাচে না, চলার পথে নিজের খেয়াল খুশি মতো সে চলে। সুন্দর শব্দবাগানের মধ্যে হেঁটে যায় আর হরেকরকমের শব্দফুল সে মাথায় গুঁজে নেয়। সময়ে সময়ে সে বাহারি রূপ ধারণ করে এগিয়ে যায় গন্তব্যে। তৈরি হয় গদ্যছন্দ।
প্রাচীন যুগ হতে ছন্দের পাশাপাশি কবিতায় আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটা হলো অলঙ্কার। গদ্য কবিতা ছন্দ ত্যাগ করেছে বলে অলঙ্কারও কি ত্যাগ করেছে? অবশ্যই না। বরং ছন্দের জায়গায় অলঙ্কারটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বা পাওয়া উচিত বলে মনে হয়। ছোট বেলায় মায়ের মুখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় শুনেছি—‘সাজিলে গুঁজিলে বেডি আর লিপিলে পুঁছিলে মেডি’। এর চলতি রূপ হয়েছে—‘ সাজালো গোছালে নারী আর লেপ্লে পুঁছ্লে বাড়ী’। পরবর্তীতে সেটার পশ্চিম বাংলার রূপ পাই এভাবে—‘নিকালে চুকালে মাটি আর সাজালে গুছালে বিটি’ পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে কথাটির অর্থ পরিবর্তন হল খানিক। তবুও কাছাকাছি। মেয়ের বাস্তবিক রূপ কোন বিষয় নয়, একটু পার্লার থেকে ঘুরিয়ে আনলেই সে অতুলনীয়া হয়ে ওঠে। কারণ তার হাতে, গলায়, নাকে, কানে ও সিঁথিতে গয়না পরানো হয়। যা নারীকে করে তোলে অপরূপা। কবিতা কি নারীরই মতো? বিবিধ অলঙ্কারে সজ্জিত না করলে তার সৌন্দর্যের ভাটা পড়ে? যেটি কবিতা তার কোন কিছুরই অপরিহার্যতা নেই। কবিতাকে কবিতা বলতে তাকে গদ্য বা পদ্য কোন কিছুতেই ভাগ করার দরকার পড়ে না। ছন্দের মাপকাটিতে লেখা অনেক কবিতাই পৃথিবীতে আছে যাকে অন্তত কবিতা বলে চলে না। গদ্যের ক্ষেত্রে সেটা আরো প্রকট। তাই কবিতায় তাও আবার গদ্যে লেখা কবিতায় অলঙ্কার কবিতাকে আরো বেশি কবিতা করে তুলবে নিঃসন্দেহে। সুন্দরী নারীরাই দেখা যায় সাজুগুজু করে বেশি নিজেদের বেশি সুন্দর করে তোলার জন্য। কবিতার কথাগুলোকে আরো বেশি কবিতা করতে তাই কবিরা অলঙ্কার ব্যবহার করেন। অলঙ্কারের দুই ধরনের হতে পারে— শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার। মূলত শব্দের উচ্চারণের ধ্বনিতে যে অলঙ্কার নিহিত তাই শব্দালঙ্কার এবং শব্দের অর্থবোধকতার জন্য যে অলঙ্কার তৈরি হয় তাই অর্থালঙ্কার। কবিতায় যখন শব্দ উচ্চারিত হয় তখন তা আমাদের কানে এসে দোলা দেয়। এ দোলা হতে পারে কবিতার কোন একটি শব্দের ধ্বনিতে অথবা পুরো লাইনের সমন্বিত ধ্বনিতে। শব্দালঙ্কারের প্রথম যে বিষয়টা আমাদের সামনে আসে তা হলো অনুপ্রাস। সহজে বলতে হলে বলা যায়— একটা বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যদি বারবার বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হয় তাকে বলে অনুপ্রাস। উদাহরণ হিসেবে একটি প্রচলিত ছড়া— ‘কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ’ এখানে ‘ক’ বর্ণটি নয়বার ব্যবহৃত হয়েছে। এ কারণে বাক্যটিকে বিশেষ ধ্বনি সুষমা দিয়েছে। অনুপ্রাস আবার কয়েকরকম হতে পারে। সেদিকে আমি যাচ্ছি না। গদ্য কবিতায় কীভাবে অনুপ্রাসের প্রয়োগ নিচের কবিতা থেকে দেখা যাক—
রাতের বালিশে জড়ো হয় আঁধার। আক্ষরিক আকাশে ডানা
মেলে ধরে পাখি। পবিত্র পাপের সতো খুলে দেখায় আবেগী
বাগান। বিভোর বাতাস দোলে মনফুলে ভুলে।
আকাশে আকাশে বেড়েছে তুমুল-তাগিদ। পাখি আর ফুল
মশগুল মাতম মাতামাতি মধুর মাঠে। ফুলের কপট কাপড়
খুলে দগদগে ক্ষত দেখে বাঁধন মন ছিঁড়ে যায় পাখি। বেদনার
বালিশ জাগে বরষার রাত।
[ম্যাসেজ ও কথিত ফুলপাখি, প্রত্নচর্চার পাঠশালা]
এই কবিতায় নিম্নরেখাঙ্কিত শব্দ বা শব্দসমষ্টির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় একটি বর্ণের পরপর ব্যবহারের কারণে আলাদা ধ্বনিমাধুর্য এসেছে। পড়তে গেলে কানে আলাদা অনুভূতি আর শিহরণ জাগছে। শব্দালঙ্কারের আরো দুটি বিষয় আছে। একটি হলো যমক আর অন্যটি শ্লেষ। অল্পকথায় বল্লে যমক হলো কবিতায় একই শব্দ অনেকবার ব্যবহার করেও অর্থের ভিন্নতা প্রদান আর শ্লেষ হলো একটি শব্দ একবার মাত্র ব্যবহৃত হয়ে বিভিন্ন অর্থ সৃষ্টির কৌশল। যমকের একটি উদাহরণ হলো—
এসো তোমাকে চুষে খাই ওহে অদ্ভুত আঁধার
সেই থেকে পূর্ণিমা এলে
গায়ে চাঁদের গন্ধে আলোকিত মাতাল বুঝি না
কেন চাঁদ গোল হলে আঁধার ভালো লাগে, আর
তোমার গোলে হারিয়ে ফেলি অনাবিল মৌনতা।
[গোল চাঁদ, প্রত্নচর্চার পাঠশালা]
এই কবিতায় নিম্নরেখাঙ্কিক ‘গোল’ শব্দটি দুইবার ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু দুই স্থানে এর অর্থের পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম ‘গোল’ দিয়ে পূর্ণিমাকে বোঝানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় ‘গোল’ দিয়ে প্রিয়ার বিশেষ অঙ্গকে নির্দেশ করা হয়েছে। কবিতায় এটাই যমক।
কবিতায় শ্লেষের একটি উদাহরণ হলো—
কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল
ডাকে ধানের গোলায়। পরিপাটি ধুতির ভাঁজ, জ্বলে হাসি
সুখের বাতি। রঙিন আঁচলে দেখা দিঘির দীঘল ঘাট সব
জানে।
[লাখবাতি, প্রত্নচর্চার পাঠশালা]
এই কবিতায় ‘বাতি’ শব্দটি শ্লেষ উৎপন্ন করে। বাতি শব্দটি দ্বারা এখানে কোন প্রজ্জ্বলিত বাতিকে প্রকাশ করে। আবার একটি সুখের এবং সমৃদ্ধির সময়কেও নির্দেশ করে। এই যে ‘বাতি’ শব্দটির দুরকম প্রকাশ, এটাকে কবিতায় বলা হয় শ্লেষ।
এবার আসি অর্থালঙ্কারের কথায়। একজন নারীকে আমরা দুরকম গুন দিয়ে বিচার করি— রূপবতী ও গুণবতী। সাধারণত বাইরের সৌন্দর্য দিয়ে অর্থাৎ তার গায়ের রঙ আর পরিহিত বিভিন্ন অলঙ্কার দিয়ে আমরা রূপ নির্ধারণ করি। আর কখন আমরা গুণবতী বিশেষণটি লাগাই? নারীর লজ্জা, দয়া, নম্রতা, ক্ষমা, বিনয় ও জ্ঞান এসব দিয়েই আমরা গুণ বিচার করি। এসব ভেতরের বিষয়। ঠিক তেমনি কবিতায় বাক্যের ভেতরকার সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তার অর্থের কারণে। বিবাহযোগ্য নারীকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে আমরা হয় বাহ্যিক রূপকে প্রাধান্য দেই নয়তো ভেতরের গুণকে প্রাধান্য দেই। একটার আধিক্য হলে অন্যটির কম হলেও চলে। শব্দালঙ্কার আর অর্থালঙ্কার কবিতার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি। অনুপ্রাস, যমক ও শ্লেষ দিয়ে যেমন আমরা কবিতাকে বাহ্যিকভাবে শব্দালঙ্কারে সজ্জিত করি ঠিক তেমনি অর্থের শোভায় কবিতা অর্থালঙ্কারে সজ্জিত হয়। মূলত অর্থের আশ্রয় গ্রহণ করে কবিতায় যে অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাই অর্থালঙ্কার। কবিতা খুব সহজে শব্দের শাব্দিক অর্থ পাল্টে দিতে পারে। বাক্যে শব্দের সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে যা সম্ভব। অর্থালঙ্কারের একটি বিশেষ রূপ হচ্ছে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার। সাধারণত উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি হলো সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন রকম অলঙ্কার আছে যা অলঙ্কার শাস্ত্রে বিধৃত আছে। কবিতা মাত্রই এসবের আবশ্যকতা জরুরী। গদ্য কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। গদ্য কবিতায় বরং এসবের চাহিদা বেশি।
এবার আসি গদ্য কবিতার প্রবণতার দিকে। বিগত তিন দশকের কবিরা কিভাবে গদ্য কবিতা রচনা করছে তার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। কবি রিজোয়ান মাহমুদ আশির দশক হতে উজ্জ্বল কবিতা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো সমান সরব। নিগুঢ় দার্শনিক বোধ নিয়ে তিনি সাজিয়ে তুলেন কবিতার দেহ। অকপটে কবিতায় কথা বলার আশ্চর্যরকম শক্তি আছে তার। অব্যক্ত বোধকে নিমেষে ব্যক্ত করে দেন তার স্বাভাবিক সরলতায়। প্রেম ও কামকে তিনি কবিতায় ধরেন এক মুগ্ধ মাত্রায়। কবিতায় মানবিক চেতনাগুলোকে মিথের মোহগ্রস্থতার মাঝে উপস্থাপন করার শক্তি কবিকে করেছে আলাদা। তার একটি কবিতা এরকম—
সংখ্যালঘু পরমারা আর আমাদের পাড়ায় আসে না। ওর চোখ
বড় হয়ে লজ্জা হয়েছে দ্বিগুণ। সে শাড়ি পরেছে বারোহাত, চোখের
কাজলে বেঁধেছে অনেক পুণ্যবতী দিন ও রাত। আসবে কেন বা
একথা বলেছে মাস্টার মশাই। খুব বেশি দূরে নয়, বিগত দু’দশক
আগে এই গ্রাম ছিল সম্পূর্ণ তাদের। দুপুরের ঘনছায়া, মিঠেরোদ
স্নানের জলের ঘ্রাণে সুখী ছিল সব অন্ধকার। এরকম দিনে আমিও
পরমা পায়ে হেঁটে গেছি পরানপুরে, শানে বান্ধা ঘাট, থরো থরো
জল, সম্মুখে প্রাচীন রূপমহল। যে গীতার বাণী ওকে করেছে
আরাধ্য তা ভস্ম হয়েছে দুর্বৃত্তের হাতে। অন্ধচোখে মাস্টার মশাই
পরম মমতায় ছুঁতে পারে না পরমার মুখ।
[পরমার মুখ, গগনহরকরা ডাকে, রিজোয়ান মাহমুদ]
এখানে কবি পাশের গ্রামের পরমার কথা বলছেন। যে কবির শৈশবের খেলার সাথী। আস্তে আস্তে মনের সাথীও হয়ে উঠেছিল পরমার অজান্তে। যদিও দুজনের ধর্ম এক নয়। পরমারা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়, অত্যাচারিত হয়। দুর্বৃত্তের হাতে পরমারাও সেই অত্যাচারের শিকার হয়। পরমারা বড় হয়, সেলোয়ার কামিজ ছেড়ে বার হাত শাড়ি পড়ে। কিন্তু সেই আগের মতো কি কবির কাছে ছুটে আসতে পারে? তার চোখ বড়ো হয় অর্থাৎ তার দেহে বসন্ত আসে, লজ্জার বাড়ার পাশাপাশি তার ভয়ও বাড়ে। সেই দুর্বৃত্তের ভয়। কবি কী সুন্দর করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রের পাশাপশি কবির প্রেমময় শৈশবকে তুলে এনেছেন। কবি গদ্য কথনের দিকেই জোর দিয়েছেন বেশি। অর্থাৎ কবি কোন বাঁধা ধরা ছন্দে না গিয়ে গদ্যের দিকে ঝুঁকে কী কবিতাময় করে তুল্লেন কথাগুলো। তাই এটা গদ্য না হয়ে হয়ে যায় গদ্য কবিতা।
কবি এজাজ ইউসুফী যিনি কবিতা লিখতে এসে কবিতাকে নতুন করে দেখেছেন। কবিতার দর্শনে দিয়েছেন নতুন তত্ত্ব। বাংলাদেশের উত্তর আধুনিক কবিতার পুরোধা ব্যক্তি হিসাবে তাকেই আমরা পাই। আধুনিকতার উত্তরণ ঘটাতে গিয়ে তিনি কবিতাকে শেকড় সংলগ্ন করেছেন কবিতায় লোকায়ত কথা, মিথ ও ঐতিহ্যের সুষমায়। উত্তর আধুনিক কবিতা ছন্দের মুক্তি আশা করে। কবিতা করার তাগিদে ছন্দের ছেদ মিশিয়ে দিয়েছেন কথনের স্পন্দনে। কথনের সুর দিয়েছেন কবিতার ভাষায়। নিরেট গদ্যে তিনিও কবিতা লিখেছেন। তার একটি কবিতার কিছু অংশ এরকম—
ইচ্ছে করলেই ঘুরে থাকতে পারতাম। ইচ্ছে করলেই দূরে থাকতে পারতাম।
‘ক্রমাগতই সকালের আলোকদীপ্ত বুদ্বুদ সকল ইতস্তত: ভ্রাম্যমান’। তাই চোখ
কান খুলে রাখি। অস্থৈর্যের পায়রা হয়ে উড়ি। পায়রা হয়ে উড়ে যাই অদ্ভুত
দূরে। যেন বোধের জলাভূমি থেকে জল খসে পড়ে। ঊনোমুখে লেগে থাকে
কার্পাসের ভ্রুণ। নীল বোরাক থেকে নেমে পড়ি পথে। ক্রোটন বাকল ছিলে
রক্তমাখি গায়ে। মাভৈঃ রবে সিঁধ কেটে নীল সিগন্যাল পাড়ি মামদো মানুষ।
তবুও লোকটার স্ত্রীর শিশ্ন আমি দেখি। শিশ্ন হাতে সে আমার মনের মধ্যে
মুর্দার মতো হাঁটে। চোখ, মুখ, কর্ণ ছাড়া কি অপদার্থ মানুষ। অথচ আশ্চর্য
হাঁটাহাঁটি তার মেরুদ-হীণ। যেন এক ছুঁচাল আঁধার!
[ঠিকানা, স্বপ্নাদ্য মাদুলি, এজাজ ইউসুফী]
কবিতাটির শুরুতে লালনের একটি গানের কিছু অংশ উল্লেখ করে কবিতাটি শুরু করেন কবি। গানটি হলো— ‘কি কব সেই পড়শীর কথা/ও তার হস্তপদ স্কন্দ মাথা নাইরে,/ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর/ক্ষণেক ভাসে নীরে’। কবিতাটি এক অদ্ভুত ঘোরে ফেলে দেয়। গদ্যে লেখা কিন্তু ভিন্ন এক স্পন্দন দোলা দেয় গভীর বোধের ভেতর। লালনের সেই পড়শীর মতোই কবিতা ধরা দেয় না ছোঁয়া দেয় না তবুও যেন এক উজ্জ্বল আঁধার আমাদের দোলা দেয়। ঠিক মামদো মানুষের মতো। কবি যখন স্ত্রীর শিশ্নের কথা বলে তখন আমাদের বোধে কম্পন দিয়ে ওঠে। নারীর স্বাভাবিক শারীরিক গড়নে আমাদের কটকা লাগে। ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। চেতন ও অবচেতনের মাঝে যেন একটি সেতু তৈরি হয়। গদ্যটি আর গদ্য থাকে না। কবিতা হয়ে উঠে।
কবি ওমর কায়সার কবিতা লিখছেন আশি দশকের গোড়া হতে। দীর্ঘ সময় কবিতার পথে হেঁটেছেন। কবিতাকে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। এখনো লিখে যাচ্ছেন কবিতা। তার একটি কবিতা এরকম—
আজ একটা গোপন কথা প্রকাশ্যে বলি—
চলনবিলের ওই পুরোনো বটগাছের সাথে একবার বিয়ে হয়েছিল আমাদের শ্রাবন্তীর।
প্রপিতামহের বয়েসী বৃক্ষটি সক্ষম ছিল না। না দিতে পেরেছে কোনো সন্তান, অথবা
সংসার।
বৃক্ষ আর মানুষের দাম্পত্য জীবনে এমন অমিল আশ্চর্যের কিছু নয়। তবুও তো
বিয়ে হয়েছিল শ্রাবন্তীর। দূর-ভবিষ্যতে কোনো গবেষক বটের বাকলে লেখা
দীর্ঘশ্বাসে খুঁজে পাবে এ বিয়ের নিখুঁত দলিল।
[আজ একটা গোপন কথা, প্রাচীন প্রার্থনাগুলো, ওমর কায়সার]
এ কবিতাটি একদম একটি গদ্য কথা। আবার ঠিক যেন গদ্য নয় তার চেয়ে বেশি কিছু। কবি একটি গোপন কথা খুব সহজে বলতে চেয়ে কবিতা শুরু করলো। কিন্তু পুরো কবিতাটি পরে সে গোপন কথা কিন্তু ঠিক গোপনই রয়ে গেল। প্রকাশ পেলো কতটুকু? এখানেই কবিতা। এটা গদ্য হলে বলার পর তার রেশ আমাদের মনে দোলা দিত না। কিন্তু এ কবিতাটি পড়ে তার গোপন রেশ মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমাদের বটের বাকল খোলা অভিপ্রায় জাগছে। তাই এটি কবিতা।
কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরীও কবিতা লেখা শুরু করেছেন আশির দশকের গোড়া হতে। যিনি প্রেমের প্রাধান্য বিস্তার করে কবিতাকে করে তুলেন প্রেয়সীর মতো রমনীয়। কবির একটি কবিতার কিছু অংশ এরকম—
কত রাত কেটে গেছে দেহমূল্য হিসাব মেলাতে, একবার অনর্থক ডাকো, কালো
রাত্রি দিয়ে ঢেকে দাও লাল দুটি চোখ। জীবনে তোমারও প্রথমবার অর্গ্যাজম হবে,
যৌন— অনুরাগমোচন, যে শব্দের অর্থ তুমি কখনো জানবে না। এরপর যেতে দাও
তাকে, নিষেধ কোরো না। কাঁধের ঝোলার মধ্যে একটি নতুন কবিতা জমা হবে—
মাথামু-ু বোঝো বা না বোঝো, সম্মতি দাও; সে কি আর দীর্ঘজীবী হবে? তুমিও তো
বেশি বাঁচবে না। রাত্রির রাজপথ এমনই রহস্যময় সে তার বাসিন্দাকে গলা টিপে
মারে। তাহলে মৃত্যুর আগে কেন থাকবে না এই সামান্য সান্তনা— একটি মিলন
স্মৃতি কবিতায় বেঁচে যেতে পারে!
[কবিতা ও বেলিফুল, মাঠের ওপারে যাবে, লীলা?, বিশ্বজিৎ চৌধুরী]
কবি কবিতার খোঁজে হেঁটে বেড়ান রাতের শহরে। প্রত্যাশিত কোন নারীর সাথে মিলনের স্মৃতি নিয়ে কবিতায় বন্দি করতে চান। ক্ষণস্থায়ী জীবনে ছোট ছোট স্মৃতিগুলো কবিতার কারণে বেঁচে থাকে বা বেঁচে যায়। কবিতার অর্গ্যাজম অনবদ্য পুলক আনে কবির মনে। তাই চিরুনিতে লেগে থাক কোন রমনীর চুল বা বেণীচ্যুত শাদা বেলিফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠেন মিলনের সুবাসে। কবি গদ্যেই বলেছেন। কিন্তু প্রতিটি পদে কেমন এক গভীর মাদকতা ও ইঙ্গিত।
৩ )
কবি হাফিজ রশিদ খান আশির দশক এর গোড়া হতে কাব্য জগতে সরব বিচরণ করে এখনো লিখে চলেছেন স্বমহিমায়। মূলত আদিবাসী জীবনের নিগূঢ় বিষয়গুলো কবিতায় ফুটিয়েছেন নিজের মেধা ও মনন দিয়ে। যাকে আমরা আদিবাসী কবি হিসেবে সহজে সনাক্ত করতে পারি। তার একটি কবিতার কিয়দংশ এমন—
‘এই করেছ ভালো নিঠুর’ বলে দূরে সরে যাও মনোরম একাকিত্বে। ছরার জলধারায়
স্বচ্ছ নজর রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বুকে কলম তুলে নাও হাতে কবিতার
পক্ষে ট্রয়যুদ্ধের সেনানীর মতো। একই সময়ে তোমার ভুবন ভুলানো হাসিতে অটল
পাহাড়ের সবুজ ভাঁজ থেকে কোনো এক লালঝুঁটিঅলা হলুদ পাখি ঘিরে-ঘিরে নিয়ে
যায় তোমাকে নিবাসে— প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে।’
[লালঝুঁটিঅলা হলুদ পাখি, রোদের পোস্টার, হাফিজ রশিদ খান]
কবিতাটিতে কবি সহজ গদ্য কথনের মধ্যে সুন্দর করে একজন নারী কলম সৈনিক এর কথা বলেছেন। কবির প্রতি এক চাপা অভিমান ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের গানের একটি পদ ব্যবহার করে। গদ্য কথাগুলো পড়তে পড়তে যখন কবি বলে ওঠে ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘর’ এর কথা তখন আমাদের ভাবনাকে দোলা দেয়। কবি মৃত্তিকা চাকমার জন্মদিনে নিবেদিত কবিতাটি সুন্দর গদ্য কবিতা হয়ে ওঠে কবির ভুবন ভুলানো হাসির মতো।
কবি জিললুর রহমান উত্তর আধুনিক কাব্যত্বত্ত্বের ভেতর কবিতাকে করে তুলেছেন যেন নিবিড় মন্ত্র। এ মন্ত্রে ছন্দের বন্ধনের চেয়ে ছন্দের স্পন্দন আর কথার বন্ধনকে করেছেন সঙ্গী। আশির দশক হতে কবিতার নির্মোহ অবয়ব তৈরি করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তার একটি কবিতা এরকম—
লালনের ডেরা থেকে নদীতে ভাসে নৌকা— শিলাইদহ ঘাটে আমাদের প্রথম
পদচ্ছাপ। ভ্যান গাড়িতে পা দুলিয়ে দুবন্ধুর নিরব আলাপ— মেঠো পথ—
লাল মরিচের গালিচা বিছানো আবাহন! পৌঁছে দিলো শান বাঁধানো পুকুর
ঘাটে— দূরে লাল কুঠিবাড়ি— ধীরে অতি ফেলেছি তো পা— পাতার শব্দের
ফাঁকে বেজে ওঠে চেয়ারের পায়া…
তুমি কি রয়েছো কবি অন্তরালে? তোমার নিঃশ্বাস আমাকে গিয়েছে ছুঁয়ে…
আমি আর তোমাকে অতিক্রম করতে পারি না।
[শিলাইদহের যাত্রী, শাদা অন্ধকার, জিললুর রহমান]
এটি কবির কুঠিবাড়ি ভ্রমণের একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা কবিতা। লালনের ডেরা হতে নৌকা করে শিলাইদহ ঘাটে নেমে কুঠিবাড়ি যাবার যে পথ এবং কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে বেড়ানো ইত্যাদি কবিতার বিষয়। সহজ সাবলীলভাবে গদ্য কথনে কবিতাটি লেখা হলো। শেষের লাইনে এসে কবির মনের একটি গোপন আকাক্সক্ষার কথা বলে দিলেন নিমেষে। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের অর্থাৎ তার কবিত্বকে অতিক্রমের এক গোপন ইচ্ছা কবির ব্যর্থ হয়েছে বলে স্বীকার করে নেন।
কবি সাজিদুল হক আশি দশক হতে কবিতায় বিচরণ করে আসছেন তার প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানসিকতার মধ্য দিয়ে। উত্তর আধুনিক চেতানার ভেতরে এক সবলীল ও স্বাভাবিক বিদ্রোহ তার কবিতার মর্মমূলে প্রবাহমান। তিনি যেন মহলের কথা বলবেন না। বলবেন মহলের উল্টো দিকে কোন নিবিড় বসতির কথা অথবা ধান ক্ষেতের কথা। তার কাব্য বোধ দেশীয় পরিসর ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে বৈশ্বিক। তার একটি কবিতার কিছু অংশ এরকম—
বিতাড়িত শয়তান প্রতিশোধ নিল আদম হাওয়াকে স্বর্গচ্যুত করিয়া।
শয়তানের কাজ শয়তান করিল। তাহার জন্যে নির্ধারিত নরকের পৌরহিত্য।
স্ফূর্তির ডালপালা মেলিয়া উপভোগ করে মোরগের লড়াই, রক্তের
দগদগে ক্ষতের যে পুঁজ তার গন্ধে তৃতীয় ভূগোলের দুই-তৃতীয়াংশ যৌবন আফিমের
নেশায় বুঁদ।
জাতিসংঘ উঠিল নিলামে, কিনিল বাণিজ্য লক্ষ্মী। শয়তান ভীষণমুগ্ধ।
লজ্জা পাইলো এই বলিয়া,‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’।
[তৃতীয় ভূগোলের মানুষ, মহলের উল্টো দিকে, সাজিদুল হক]
কবিতাটি শুরু করেন কবি লালনের উক্তি দিয়ে ‘যথা যাই মানুষ দেখি মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি’। কিন্তু সেই মানুষের মাঝেই লুকিয়ে আছে যে শয়তান তাকেই কবি যখন দেখেন স্বর্গের মতো পৃথিবীকে নরক করে তুলছে শুধু বাণিজ্যের চাদরে তখন মানুষই লজ্জা পায় নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে। তৃতীয় ভূগোল বলতে কবি তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কথা বলেছেন। যাদের উপর সাম্রাজ্যজ্যবাদের কালো হাত মানুষকে করছে আদম হাওয়ার মতো স্বর্গচ্যুত।
কবি শিমুল মাহমুদ আশির দশক হতে কবিতায় জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলছেন সমহিমায়। তার কবিতায় জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, ন্যায়-অন্যায় ও প্রেম-কাম সহজে আসে সাবলীল ভাষায়। কিছু অসংগতি সহজে ফুটিয়ে তুলেন নিজ কাব্য শক্তির মধ্য দিয়ে। তার একটি কবিতা এরকম—
মেঘ আমার বোন। ওর বয়স ১০। মসজিদের হুজুর ওকে কোরআন শিক্ষা দেয়;
মসজিদের হুজুর ওর মুখে গামছা গুজে দেয়; মসজিদের হুজুর ওর হাতে পাজামা
পেচিয়ে দেয়।
তারপর মেঘ, এক খ- জীবনঘেঁষা মেঘ, মেঘ আমার বোন। কোরআন পাঠের
পাতায় পাতায় মেঘ আমার বোন। পাখির পাখা ঝাপটানো শব্দে মেঘের সচকিত
চোখ, ভয়কাতর বাতাস। বাতাস, সখা আমার, মেঘেদের মামাতো ভাই, এই
সংবাদ বহন করে নিয়ে যাও সপ্ত আসমান, আল্লার আরশ।
মেঘ, একজন বালিকার নাম। মেঘ আমার আশ্রয়প্রার্থী বিনম্র স্নেহের নাম।
[মেঘ আমার বোন, আবহাওয়াবিদগণ জানেন, শিমুল মাহমুদ]
কবি খুব সহজ সরল ইঙ্গিতময় বাক্যের মাধ্যমে এক ধর্ষিতা কিশোরীর কথা বলেছেন, যে আমাদেরই কারো বোন। মসজিদের কোরআন শিক্ষক হুজুর যখন কিশোরীর মুখে গামছা গুজে দিয়ে তাকে ধর্ষণ করে তখন কিশোরীর কাছে হুজুর নামের এক দানবকে সে কীভাবে দেখবে? এ সংবাদ বাতাসে ছড়িয়ে যায়, পৌঁছে যায় চারপাশে। কিন্তু সেই বোন মেঘ অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস হারিয়ে দেবতারূপী কোন মানুষের কাছেই আশ্রয় নেয় যেখানে রয়েছে বোনের স্নেহ। কবি সরল গদ্যের মাধ্যমে একটা ঘটনাকে সুন্দর করে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। স্বাভাবিক গদ্য কথন কী সুন্দর কবিতা হয়ে যায়। ধর্ষণ শব্দটি কোথাও তিনি একবারও ব্যবহার করেননি। কিন্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি দুইবার ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এখানেই গদ্য কবিতা রচনায় কবির স্বার্থকতা।
কবি সুহিতা সুলতানা কবিতা লিখছেন আশির দশক হতে। তার কবিতায় তিনি জীবনের বহুবিধ ধারনার কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। তার কবিতায় দেখা যায় এক নারীবাদি স্বর। নারী সম্পর্কে পুরুষের ধারনাগুলোকে বদলে দেয়ার মতো অনুভূতি কবিতায় তুলে আনেন অকপটে। তার একটি কবিতা এরকম—
আগুন ও মাংস পোড়ানোর ইতিহাস দৃশ্যধারনের ধ্রুপদী কাঠামো শৈশবের কাছে নিয়ে
যায় সেই পথ এখন না আমার না আমাদের। জগতের সব অসংযুক্ত বিচ্ছিন্নবাদীরা প্রিয়
পথের ওপর নিষিদ্ধ প্ল্যাকার্ড সেঁটে প্রাচীন ক্রীতদাসের মতো বাজপাখির ঝলসানো
মাংস আর মদে চূর হয়ে থাকে। পথে পথে ঝুলে থাকে স্বপ্নহীন নির্মমতা বিষণ্ণ সংগীত
ঘোরলাগা সন্ধ্যায় অপচ্ছায়া হাঙরের ঢেউ হয়ে খেয়ে ফ্যালে প্রিয় দিন রাত্রি বসন্ত ভোর
নীলাভ জল আর আমার একান্ত অপেক্ষসমূহ। কলাভবনের বারান্দায় কে গেয়ে ওঠে
অর্ধোন্মাদ গান… দক্ষিণ সমীরণে… কে তুমি পথিক? বিনিদ্র রমণীর অপেক্ষাতুর
চোখের ভেতর হীমযুগের মৃত জোনাক পোকার হাহাকার ছুঁড়ে দাও? এই শ্রাবণ মেঘের
দিনে লাশকাটা ঘরে হৃদয়বিহীণ শুয়ে আছো কত যুগ হলো? বলো দেখি? বেড়ালের
নির্জন চোখের ভেতরে অন্য জীবন খেলা করে… কবে তুমি আবার পাখি হয়ে
পৃথিবীতে এলে? এ য্যানো মৃত্যুর মতো বিস্ময়। একমাত্র কবিই পারে সব স্তব্ধতাকে
অনুভব করতে
[আটত্রিশ : স্বপ্নবৃত্তান্ত, স্বপ্নবৃত্তান্ত, সুহিতা সুলতানা]
টানা গদ্যে লেখা এটি। কিন্তু এর প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে যেন এক অন্যরকম ঘোর। ঘোরলাগা সন্ধ্যার মতো বিষয় আর বিমূর্ততার মাঝে কবিতাটি পড়তে থাকি। কিছু প্রশ্নবাণ আমাদের ভাবিয়ে তুলে। চারপাশের ঘটনার বিবরণ যেন কবিই দিতে পারেন কবিতার মাধ্যমে। শেষের লাইনে কবি নিজেই বলে দেন সব স্তব্ধতাকে অনুভব করতে পারেন কবিই।
কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া নব্বই দশকের শুরু হতে কবিতার শরীরে তুলির আঁচড় দিয়ে যাচ্ছেন শিল্পিত মন নিয়ে। তিনি কবিতায় বিভিন্ন সম্পর্কের অবস্থা ও পরিবর্তন বা তার চ্যুতি-বিচ্যুতি, মনের অন্তর্গত ভাব ও ভালোবাসার নিবিড় সমীকরণ, পরিণত স্মৃতি রোমন্থন ও তা হতে তুলে আনা অমীমাংসিত বেদনা ও ভয়, জন্মান্তরবাদ, শেকড়ের ঘ্রাণ নিয়ে সভ্যতার দিকে ছুটে চলা, বিকৃত বিশ্বায়ন, মানসিক আকাক্সক্ষা ও প্রাপ্তির হিসেব, নদীমগ্নতা, লোকায়ত ধারণা ও মনের বিবিধ বিচরণ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়কে তিনি জীবনের পাঠশালায় মনোযোগী ছাত্র হয়ে নিবিড়ভাবে তুলে ধরেছেন কবিতায়। তার একটি কবিতা এরকম—
শহরে আসার সময় যখন হয়— বাবা প্রায়ই নীরবে চোখের জল মুছে আর ভাঙা
স্বরে বলে— জয়ের জন্য নাড়ি ছিঁড়ে যাও…আশায় বসতি গড়ি, হৃদয়ের ঘুড়ি ওড়ে
নীলাভ আকাশে, আনন্দ-লগন দেখি— চোখ রাখি দূরবর্তী মেঘে, জল পড়ে খোলা
বুকে— মেঘের জাতক।
নির্জনে কত কথা বলি— শুনি বিচিত্র ধ্বনি— দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাক
ছাপিয়ে অগুনতি আওয়াজ। মনে ভিড় করে মাঠের পর মাঠ শস্যদানা ধানখেত
সরষেফুল আর আমার বাবা…
হঠাৎ একদিন ঝিম ধরা দুপুরে মেঘের শরীরে বাবা ডাকে…
ডাক শুনি— গভীর গভীরতম ডাক
আর আমি দশ দিকে সাড়া দিতে মেঘদলে ভেসে ভেসে পাখি হয়ে উড়ি…
[বাবা, অপর পৃষ্ঠার বৃত্তান্ত, ভাগ্যধন বড়ুয়া]
কবিতায় শহরে যাবার জন্য ছেলেকে বিদায় দিতে গিয়ে চোখের জল মোছার মতো একটি আবেগঘন দৃশ্যের কথা বলেছেন কবি। বিশেষ কিছু অর্জন আর কোন কিছু জয় করতে হলে যেন শহরেই আসতে হবে সকলকে। কিন্তু বাবা চায় ছেলেকে কাছে কাছে রাখতে, চোখে চোখে রাখতে কিন্তু বাবাতো পরিবার ও পেশার বন্ধন ভেঙে গ্রাম ছাড়তে পারে না। কিন্তু ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে পাঠাতেই হয়। তাই বাবা বারবার ছেলেকে মনে করিয়ে দেয় শহরে যাবার কারণ। ছেলে শহরে এসে পরিচিত গ্রাম, শস্যক্ষেত, সরষেফুল আর বাবাকে প্রতিনিয়ত অনুভব করে আর নির্জনে শোকগাথা আওড়ায়। কিন্তু শহরে ছেলে যখন খাপ খাইয়ে নেয় নিজেকে তখন একদিন বাবা ঠিক চলে যায় না পেরার দেশে। সন্তান তখন মেঘের গর্জনে বাবাকে খোঁজেন অবিরত। এ গদ্য কবিতাটি আমাদের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। নগরায়নের প্রবল চিত্র ও গ্রামীণ স্নেহ মমতা ছবি ফুটে উঠে।
কবি মুজিব ইরম নব্বই দশকে কবিতার রাজ্যে প্রবেশ করেন। তার কবিতা সংস্কার ও কু-সংস্কারের মাঝে যেন অন্যকিছুর কথা বলে। তিনি কবিতাকে লালনের পড়শির মতো খুঁজে বেড়ান প্রতিনিয়ত। তার গদ্য কবিতায় অন্য রকম একটা সুর আছে, ভাবের দোলার সাথে আছে শব্দের নিবিষ্ট উচ্চারণ। গ্রাম বাংলার বিবিধ দৃশ্য ও দর্শনের ভেতর তিনি কবিতার ক্যানভাস রচনা করেন। তার একটি কবিতা এরকম—
আর কিছু ধন চাই না মুর্শিদ— থাকা খাওয়ার সঙ্গ দিও…পথ ছাড়িয়া অপথ
ধরি— বাওবাতাস সব বুঝিয়ে দিও…রাতের আন্ধার যেমন-তেমন দিনের আন্ধার
তুমি জানো…ধরলে তরি ভরের রোদে— রোদবেরোদে বাঁচিয়ে রেখো…আমি তো
হায় চুকুমভোদাই… বেআকুল আমি…দিনের কানা…রাতবিরাতে তোমায় ডাকি…
দিনটা কেবল ভালো রোখো…আর কিছু ধন চাই না মুর্শিদ— একটা নারী বুঝতে
দিও।
[মোনাজাত, ভাইবে মুজিব ইরম বলে, মুজিব ইরম]
কবিতাটি গদ্য কবিতা। কিন্তু তার প্রতিটি লাইনে লাইনে কেমন সুরের মাদকতা। যেন কবি কবিতায় এক অবুঝ মানুষের কথা বলছেন এক অনবদ্য সুরের মাঝে। কবিতাটি একবার পড়ার পর যেন বারবার পড়তে ইচ্ছে করছে। এর দুটি কারণ আবিষ্কার করলাম। প্রথমত কবিতাটি গদ্যে লেখা হলেও এর মাঝে একটা নিবিড় সুর আছে এবং দ্বিতীয়ত এর ভাবের একটা দোলা আছে যা আমাদের ভাবায়।