যদি
কোন
রাজার এমন হতো যে, সবকিছু শুরুর সঠিক সময় সে সর্বদাই আগে থেকে জানত, যদি জানত তার
কথা মেনে চলবে এমন সঠিক মানুষটি কে এবং কাকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং সর্বোপরি,
রাজা
যদি সর্বদাই জানত কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে শুরু করতে
হবে, তাহলে
সে রাজা কোন কিছুতেই বিফল হতো না এবং আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে
পারতো।
প্রতিনিয়ত
এই চিন্তা রাজার মাথায় ঘুরতে লাগলো, রাজা তার রাজ্য জুড়ে এই বলে ঢোল পেটাল
যে, রাজা
সেই ব্যাক্তিকে
পুরস্কৃত করবে যে তাকে বলতে পারে, কিভাবে সে বুঝতে পারবে প্রত্যেক কাজ
শুরুর সঠিক সময় কোনটি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে, এবং সে
কিভাবে জানতে পারবে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে করতে হবে।অনেক জ্ঞানি পন্ডিত ব্যাক্তিরা রাজার কাছে আসল এবং বিভিন্নভাবে তার প্রশ্নের জবাব দিল। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বললো, প্রত্যেকটি কাজ সঠিক সময়ে করতে চাইলে অবশ্যই আগে থেকে একটি পরিকল্পনা চার্ট বানাতে হবে, প্রতিটি দিনের জন্য এমনকি প্রতিটি মাস ও বছরের জন্যেও এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। তারা বললো, এইভাবে সবকিছুই সঠিক সময়ে করা সম্ভব। অন্যরা বললো, প্রতিটি কাজের সঠিক সময় আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু নিজে কোন অলস সময় কাটানো ঠিক নয়, একজন অবশ্যই চলমান সময়ের প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করা এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করা উচিত। আবার অন্যরা বললো ঠিক উল্টো, রাজা যতোই চলমান সময়ের প্রতি মনোযোগী হউক না কেন প্রতিটি কাজের সঠিক সময় বের করা সত্যিই কঠিন কিন্তু তার একজন জ্ঞানি ব্যাক্তির পরামর্শ প্রয়োজন যে তাকে প্রত্যেকটা কাজের সঠিক সময় নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু পরে অন্যরা বললো, পরামর্শ দেয়ার আগ মুহূর্তে কিছু কাজ থাকবে যা অপেক্ষা করবে না। কিন্তু কে ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এ কাজটি করবে নাকি করবে না। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একজনকে অবশ্যই জানতে হবে কি ঘটতে যাচ্ছে। একজন জাদুকরই তা জানে অতএব প্রতিটি কাজের সঠিক সময় জানার জন্য অবশ্যই একজন জাদুকরের পরামর্শ দরকার।
একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিল। কেউ বললো, যে লোকটির রাজার খুব দরকার সে হলো পরামর্শদাতা। অন্যরা বললো, একজন পুরোহিত। অন্যরা বললো, একজন ডাক্তার, যখন কিছুলোক বললো সৈনিকরা হলো একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তৃতীয় প্রশ্ন : কোন কাজটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এর উত্তরে কেউ বললো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে বিজ্ঞান। অন্যরা বললো তা হলো যুদ্ধে ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং অন্যরা আবার বললো, তা হলো ধর্মীয় আচার আচরণ করা।
প্রত্যেকটি উত্তর ভিন্ন ভিন্ন। রাজা কারো সাথে একমত হতে পারলো না এবং কাউকে পুরস্কৃত করতে পারলেন না কিন্তু এখনো সে সঠিক উত্তরের আশা ছাড়লো না। রাজা সিদ্ধান্ত নিল সে একজন তপস্বীর পরামর্শ নিবে যে কিনা তার জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত। তপস্বী বাস করে ঝামেলামুক্ত একটি পরিবেশে যা কখনো সে ছেড়ে যায় না এবং সাধারণ মানুষ ছাড়া কারো সাথে দেখা করে না। তাই রাজা সাধারণ পোশাক পরে গেলেন এবং একটু দূরে ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর দেহরক্ষীকে পেছনে রেখে একা গেলেন।
যখন রাজা তপস্বীর কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি তাঁর কুঁড়ে ঘরের সামনে মাটি খনন করছিলেন। তাঁকে দেখেই রাজা সম্ভাষণ জ্ঞাপন করে খনন স্থলে গেলেন। তপস্বীর অবস্থা বেশ নাজুক ও দুর্বল ছিল। কোদালের প্রতিটি কোপে সামান্য পরিমাণ মাটি তুলে আনছেন এবং জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। রাজা তার পাশে গিয়ে বললো, হে জ্ঞানী তপস্বী আমি অপনার কাছে এসেছি তিনটি প্রশ্নের উত্তরের আশায়। প্রশ্ন তিনটি হলো - কিভাবে আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারবো? কোন মানুষটিকে আমার খুব প্রয়োজন এবং আমাকে কার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি?, অতএব তাকে বাকিদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটাকে আমি প্রথমেই গুরুত্ব দেব?
তপস্বী রাজার কথা শুনছিলেন কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। সে কোদাল হাতে পুনরায় মাটি খনন শুরু করলেন। রাজা বললো, আপনি ক্লান্ত। আপনি কোদালটা আমাকে দিন আমি আপনার হয়ে কিছুক্ষণ খনন করে দেই। তপস্বী ধন্যবাদ দিয়ে কোদাল রাজার হাতে তুলে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ খননের পর রাজা কাজ থামিয়ে পুনরায় প্রশ্নগুলো আবার করলেন। এবারও তপস্বী কোন উত্তর দিলেন না। বসা থেকে উঠে তপস্বী রাজার দিকে কোদালের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো আমাকে একটু কাজ করতে দাও।
কিন্তু রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে খনন চালিয়ে যেতে লাগলেন। এক ঘণ্টা অতিবাহিত হল, আরো একঘণ্টা পার হলো, সূর্যটা দূরে গাছের পেছনে ডুবে গেল। অবশেষে রাজা কোদালটা মাটিতে ফেলে বললো, হে জ্ঞান তাপস আমি এখানে এসেছি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে। যদি আপনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তবে বলেন আমি ফিরে যাই।
তপস্বী বললো -কেউ এদিকে দৌড়ে আসছে, চলো দেখি কে সে ।
রাজা চারপাশে থাকালো এবং দেখলো একটা দাড়িওয়ালা লোক দৌড়ে এ দিকে আসছে। তার হাত দিয়ে লোকটি তার তলপেট চেপে ধরে আছে এবং হাতের নিচ দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছিল। যখন লোকটি রাজার নিকট আসল তখন সে মৃদু গোঙাতে গোঙাতে মূর্ছা গেল। রাজা ও তপস্বী লোকটির গায়ের কাপড় ঢিলঢিলে করে দিল। তার তলপেটে গভীর ক্ষত দেখতে পেল। রাজা যতটুকু সম্ভব ভাল করে ধৌত করে নিল এবং হাতের কাপড় ও তপস্বীর তোয়ালে দিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিল। কিন্তু রক্ত প্রবাহ সহজে বন্ধ হলো না। রাজা বারংবার তার তপ্ত রক্তে ভেজা ব্যন্ডেজ খুলে নতুন করে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগলেন। অবশেষে যখন লোকটির শরীর হতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলো লোকটি চেতনা ফিরে পেল এবং কিছু পানিয় চাইলেন। রাজা পরিষ্কার পানি নিয়ে আসলেন এবং তাকে খেতে দিলেন। এরমধ্যে সূর্য ডুবে গেল এবং চারদিক ঠান্ডা হয়ে এলো। সেজন্য রাজা তপস্বীর সহায়তায় আহত লোকটিকে তপস্বীর কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গেল এবং বিছানায় শুয়ে দিলেন। বিছানায় শুয়ে লোকটি চোখ বুজে শান্ত হয়ে গেল। রাজা তার কাজকর্মে পরিশ্রান্ত হয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়লো এবং গ্রীষ্মের ছোট রাত কখন শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারলো না। সকালে যখন রাজা জেগে ওঠল তার অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল যে সে কোথায় আছে সেটা বুঝতে এবং তার পাশে বিছানায় শুয়ে থাকা অগন্তুক দাড়িওয়ালা লোকটিইবা কে? যে কিনা স্থির দৃষ্টিতে বড়ো বড়ো চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে ক্ষমা করুন- দুর্বল কণ্ঠে বললো দাড়িওয়ালা লোকটি যখন সে দেখতে পেল রাজা জেগে উঠেছিল এবং তার দিকে তকিয়ে ছিল।
রাজা বললো - আমি তোমাকে চিনি না এবং এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে।
আপনি আমাকে চিনেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি আপনার সে শত্রু যে কিনা আপনার উপর প্রতিশোধ নিব বলে শপথ করেছিলাম কারণ আপনি আমার ভাইকে গ্রেপ্তার করে তার সকল সম্পত্তি জব্দ করেছিলেন। আমি শুনেছিলাম যে আপনি একা এ তপস্বীকে দেখতে আসবেন এবং আমি ভেবে রেখেছি আপনি ফেরার পথে আপনাকে হত্যা করবো। কিন্তু সে দিনটি চলে গেল কিন্তু আপনি ফিরলেন না। তাই আপনাকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য আমি এদিকে আসছিলাম এবং হঠাৎ আপনার বডিগার্ড আমাকে অক্রমণ করে বসলো এবং তারা আমাকে চিনতে পেরে আমাকে আহত করলো। আমি তাদের কাছ হতে পালিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার সেবা না পেলে আমি মারা যেতাম। আমি অপনাকে হত্যা করতে এসেছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে রক্ষা করলেন। এখন আমি যদি বাঁচি এবং আপনি যদি চান, আমি আপনার বিশ্বস্ত কৃতদাস হতে চাই এবং আমার সন্তানদেরও তাই করতে আদেশ করবো। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করুণ। রাজা খুব সহজে তাঁর শত্রুকে বন্ধু করতে পেরে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না তার কৃতদাসকে পাঠিয়ে রাজার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ডেকে পাঠালেন এবং তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
আহত ব্যাক্তি হতে বিদায় নিয়ে রাজা বারান্দা হতে বেরিয়ে তপস্বীর খোঁজে চারপাশে তাকালেন। চলে যাবার পূর্বে অন্তত আরেকবার যদি সে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় ভেবে। তপস্বী বাইরেই আছেন। হাঁটু
গেড়ে বীজতলায় বীজ বপনে রত যেখানে গতদিন খনন করা হয়েছিল।
রাজা তাঁর দিকে গেলেন এবং বললেন - হে জ্ঞান তাপস শেষবারের মতো আমি অপনার কাছে প্রশ্নগুলোর উত্তর আশা করছি।
তপস্বী বললো তুমি এর মধ্যেই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছ। এখনো তিনি অবনত হয়ে রাজার সামনে কাজ করে যেতে লাগলেন।
কিভাবে উত্তর পেলাম? আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?- রাজা বললেন। তুমি দেখনি? বললো তপস্বী। গতকাল তুমি যদি আমার ক্লান্তি দেখে আমাকে মাটি খননে সাহায্য না করতে এবং তুমি ফিরে চলে যেতে এই লোকটি তোমাকে আক্রমণ করতো এবং তুমি অনুশোচনা করতে কেন তুমি আমার সাথে থাকলে না ভেবে। সুতারাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে যখন তুমি বীজতলা খনন করছিলে এবং আমিই ছিলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমাকে সাহায্য করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এবং এর ঠিক পরে যখন আহত লোকটি আমাদের দিকে এলো তখন গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল তার কাজে লাগা। যদি তুমি তাকে সঠিক সেবা না দিতে তাহলে সে তোমার বন্ধু না হয়ে মারা যেত। সুতারাং সে হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি এবং তার জন্য তুমি যা করেছ সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখন মনেকরে দেখ। শুধু বর্তমান সময়টাই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ এখন আমাদের কিছু শক্তি আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হলো যে তোমার সামনেই আছে কারণ মানুষ জানে না সে কার সাথে কাজ করতে বা দেখা করতে যাচ্ছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সমুখের লোকটির জন্য ভালো কিছু করা কারণ এজন্যেই মানুষকে একা এ জীবনে পাঠানো হয়েছে!
(লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) রাশিয়ান লেখক, গদ্যকার ও দার্শনিক। যিনি তার মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘‘ওয়ার এন্ড পিস’’ এর জন্য বিখ্যাত।)