শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

অনুবাদ গল্প : তিনটি প্রশ্ন : মূল : লিও তলস্তয় : অনুবাদ : শেখর দেব


যদি কোন রাজার এমন হতো যে, সবকিছু শুরুর সঠিক সময় সে সর্বদাই আগে থেকে জানত, যদি জানত তার কথা মেনে চলবে এমন সঠিক মানুষটি কে এবং কাকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং সর্বোপরি, রাজা যদি সর্বদাই জানত  কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে শুরু করতে হবে, তাহলে সে রাজা কোন কিছুতেই বিফল হতো না এবং আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতো
প্রতিনিয়ত এই চিন্তা রাজার মাথায় ঘুরতে লাগলো, রাজা তার রাজ্য জুড়ে এই বলে ঢোল পেটাল যে, রাজা সেই ব্যাক্তিকে পুরস্কৃত করবে যে তাকে বলতে পারে, কিভাবে সে বুঝতে পারবে প্রত্যেক কাজ শুরুর সঠিক সময় কোনটি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে, এবং সে কিভাবে জানতে পারবে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে করতে হবে
অনেক জ্ঞানি পন্ডিত ব্যাক্তিরা রাজার কাছে আসল এবং বিভিন্নভাবে তার প্রশ্নের জবাব দিলপ্রথম প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বললো, প্রত্যেকটি কাজ সঠিক সময়ে করতে চাইলে অবশ্যই আগে থেকে একটি পরিকল্পনা চার্ট বানাতে হবে, প্রতিটি দিনের জন্য এমনকি প্রতিটি মাস ও বছরের জন্যেও এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবেতারা বললো, এইভাবে সবকিছুই সঠিক সময়ে করা সম্ভবঅন্যরা বললো, প্রতিটি কাজের সঠিক সময় আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু নিজে কোন অলস সময় কাটানো ঠিক নয়, একজন অবশ্যই চলমান সময়ের প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করা এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করা উচিতআবার অন্যরা বললো ঠিক উল্টো, রাজা যতোই চলমান সময়ের প্রতি মনোযোগী হউক না কেন প্রতিটি কাজের সঠিক সময় বের করা সত্যিই কঠিন কিন্তু তার একজন জ্ঞানি ব্যাক্তির পরামর্শ প্রয়োজন যে তাকে প্রত্যেকটা কাজের সঠিক সময় নির্ধারণে সাহায্য করতে পারেকিন্তু পরে অন্যরা বললো, পরামর্শ দেয়ার আগ মুহূর্তে কিছু কাজ থাকবে যা অপেক্ষা করবে না কিন্তু কে ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এ কাজটি করবে নাকি করবে না কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একজনকে অবশ্যই জানতে হবে কি ঘটতে যাচ্ছে একজন জাদুকরই তা জানে অতএব প্রতিটি কাজের সঠিক সময় জানার জন্য অবশ্যই একজন জাদুকরের পরামর্শ দরকার
একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিলকেউ বললো, যে লোকটির রাজার খুব দরকার সে হলো পরামর্শদাতা অন্যরা বললো, একজন পুরোহিতঅন্যরা বললো, একজন ডাক্তার, যখন কিছুলোক বললো সৈনিকরা হলো একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মানুষতৃতীয় প্রশ্ন : কোন কাজটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এর উত্তরে কেউ বললো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে বিজ্ঞানঅন্যরা বললো তা হলো যুদ্ধে ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং অন্যরা আবার বললো, তা হলো ধর্মীয় আচার আচরণ করা
প্রত্যেকটি উত্তর ভিন্ন ভিন্নরাজা কারো সাথে একমত হতে পারলো না এবং কাউকে পুরস্কৃত করতে পারলেন না কিন্তু এখনো সে সঠিক উত্তরের আশা ছাড়লো নারাজা সিদ্ধান্ত নিল সে একজন তপস্বীর পরামর্শ নিবে যে কিনা তার জ্ঞানের জন্য বিখ্যাততপস্বী বাস করে ঝামেলামুক্ত একটি পরিবেশে যা কখনো সে ছেড়ে যায় না এবং সাধারণ মানুষ ছাড়া কারো সাথে দেখা করে নাতাই রাজা সাধারণ পোশাক পরে গেলেন এবং একটু দূরে ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর দেহরক্ষীকে পেছনে রেখে একা গেলেন
যখন রাজা তপস্বীর কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি তাঁর কুঁড়ে ঘরের সামনে মাটি খনন করছিলেনতাঁকে দেখেই রাজা সম্ভাষণ জ্ঞাপন করে খনন স্থলে গেলেনতপস্বীর অবস্থা বেশ নাজুক ও দুর্বল ছিল কোদালের প্রতিটি কোপে সামান্য পরিমাণ মাটি তুলে আনছেন এবং জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেনরাজা তার পাশে গিয়ে বললো, হে জ্ঞানী তপস্বী আমি অপনার কাছে এসেছি তিনটি প্রশ্নের উত্তরের আশায়প্রশ্ন তিনটি হলো - কিভাবে আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারবো? কোন মানুষটিকে আমার খুব প্রয়োজন এবং আমাকে কার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি?, অতএব তাকে বাকিদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবকোন কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটাকে আমি প্রথমেই গুরুত্ব দেব?
তপস্বী রাজার কথা শুনছিলেন কিন্তু কোন উত্তর দিলেন নাসে কোদাল হাতে পুনরায় মাটি খনন শুরু করলেনরাজা বললো, আপনি ক্লান্তআপনি কোদালটা আমাকে দিন আমি আপনার হয়ে কিছুক্ষণ খনন করে দেইতপস্বী ধন্যবাদ দিয়ে কোদাল রাজার হাতে তুলে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেনকিছুক্ষণ খননের পর রাজা কাজ থামিয়ে পুনরায় প্রশ্নগুলো আবার করলেনএবারও তপস্বী কোন উত্তর দিলেন নাবসা থেকে উঠে তপস্বী রাজার দিকে কোদালের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো আমাকে একটু কাজ করতে দাও
কিন্তু রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে খনন চালিয়ে যেতে লাগলেনএক ঘণ্টা অতিবাহিত হল, আরো একঘণ্টা পার হলো, সূর্যটা দূরে গাছের পেছনে ডুবে গেলঅবশেষে রাজা কোদালটা মাটিতে ফেলে বললো, হে জ্ঞান তাপস আমি এখানে এসেছি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতেযদি আপনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তবে বলেন আমি ফিরে যাই
তপস্বী বললো -কেউ এদিকে দৌড়ে আসছে, চলো দেখি কে সে
রাজা চারপাশে থাকালো এবং দেখলো একটা দাড়িওয়ালা লোক দৌড়ে এ দিকে আসছেতার হাত দিয়ে লোকটি তার তলপেট চেপে ধরে আছে এবং হাতের নিচ দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছিল যখন লোকটি রাজার নিকট আসল তখন সে মৃদু গোঙাতে গোঙাতে মূর্ছা গেলরাজা ও তপস্বী লোকটির গায়ের কাপড় ঢিলঢিলে করে দিলতার তলপেটে গভীর ক্ষত দেখতে পেলরাজা যতটুকু সম্ভব ভাল করে ধৌত করে নিল এবং হাতের কাপড় ও তপস্বীর তোয়ালে দিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিলকিন্তু রক্ত প্রবাহ সহজে বন্ধ হলো নারাজা বারংবার তার তপ্ত রক্তে ভেজা ব্যন্ডেজ খুলে নতুন করে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগলেনঅবশেষে যখন লোকটির শরীর হতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলো লোকটি চেতনা ফিরে পেল এবং কিছু পানিয় চাইলেনরাজা পরিষ্কার পানি নিয়ে আসলেন এবং তাকে খেতে দিলেনএরমধ্যে সূর্য ডুবে গেল এবং চারদিক ঠান্ডা হয়ে এলোসেজন্য রাজা তপস্বীর সহায়তায় আহত লোকটিকে তপস্বীর কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গেল এবং বিছানায় শুয়ে দিলেনবিছানায় শুয়ে লোকটি চোখ বুজে শান্ত হয়ে গেলরাজা তার কাজকর্মে পরিশ্রান্ত হয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়লো এবং গ্রীষ্মের ছোট রাত কখন শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারলো নাসকালে যখন রাজা জেগে ওঠল তার অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল যে সে কোথায় আছে সেটা বুঝতে এবং তার পাশে বিছানায় শুয়ে থাকা অগন্তুক দাড়িওয়ালা লোকটিইবা কে? যে কিনা স্থির দৃষ্টিতে বড়ো বড়ো চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে
আমাকে ক্ষমা করুন- দুর্বল কণ্ঠে বললো দাড়িওয়ালা লোকটি যখন সে দেখতে পেল রাজা জেগে উঠেছিল এবং তার দিকে তকিয়ে ছিল
রাজা বললো - আমি তোমাকে চিনি না এবং এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে
আপনি আমাকে চিনেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনিআমি আপনার সে শত্রু যে কিনা আপনার উপর প্রতিশোধ নিব বলে শপথ করেছিলাম কারণ আপনি আমার ভাইকে গ্রেপ্তার  করে তার সকল সম্পত্তি জব্দ করেছিলেনআমি শুনেছিলাম যে আপনি একা এ তপস্বীকে দেখতে আসবেন  এবং আমি ভেবে রেখেছি আপনি ফেরার পথে আপনাকে হত্যা করবো কিন্তু সে দিনটি চলে গেল কিন্তু আপনি ফিরলেন নাতাই আপনাকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য আমি এদিকে আসছিলাম এবং হঠা আপনার বডিগার্ড আমাকে অক্রমণ করে বসলো এবং তারা আমাকে চিনতে পেরে আমাকে আহত করলোআমি তাদের কাছ হতে পালিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার সেবা না পেলে আমি মারা যেতামআমি অপনাকে হত্যা করতে এসেছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে রক্ষা করলেনএখন আমি যদি বাঁচি এবং আপনি যদি চান, আমি আপনার বিশ্বস্ত কৃতদাস হতে চাই এবং আমার সন্তানদেরও তাই করতে আদেশ করবোঅনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করুণরাজা খুব সহজে তাঁর শত্রুকে বন্ধু করতে পেরে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না তার কৃতদাসকে পাঠিয়ে রাজার ব্যক্তিগত চিকিসককে ডেকে পাঠালেন এবং তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন
আহত ব্যাক্তি হতে বিদায় নিয়ে রাজা বারান্দা হতে বেরিয়ে তপস্বীর খোঁজে চারপাশে তাকালেনচলে যাবার পূর্বে অন্তত আরেকবার যদি সে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় ভেবেতপস্বী বাইরেই আছেনহাঁটু
গেড়ে বীজতলায় বীজ বপনে রত যেখানে গতদিন খনন করা হয়েছিল
রাজা তাঁর দিকে গেলেন এবং বললেন - হে জ্ঞান তাপস শেষবারের মতো আমি অপনার কাছে প্রশ্নগুলোর উত্তর আশা করছি
তপস্বী বললো তুমি এর মধ্যেই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছএখনো তিনি  অবনত হয়ে রাজার সামনে কাজ করে যেতে লাগলেন
কিভাবে উত্তর পেলাম? আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?- রাজা বললেনতুমি দেখনি? বললো তপস্বীগতকাল তুমি যদি আমার ক্লান্তি দেখে আমাকে মাটি খননে সাহায্য না করতে এবং তুমি ফিরে চলে যেতে এই লোকটি তোমাকে আক্রমণ করতো এবং তুমি অনুশোচনা করতে কেন তুমি আমার সাথে থাকলে না ভেবেসুতারাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে যখন তুমি বীজতলা খনন করছিলে এবং আমিই ছিলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমাকে সাহায্য করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এর ঠিক পরে যখন আহত লোকটি আমাদের দিকে এলো তখন গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল তার কাজে লাগাযদি তুমি তাকে সঠিক সেবা না দিতে তাহলে সে তোমার বন্ধু না হয়ে মারা যেতসুতারাং সে হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি এবং তার জন্য তুমি যা করেছ সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজএখন মনেকরে দেখশুধু বর্তমান সময়টাই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কারণ এখন আমাদের কিছু শক্তি আছেসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হলো যে তোমার সামনেই আছে কারণ মানুষ জানে না সে কার সাথে কাজ করতে বা দেখা করতে যাচ্ছেএবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সমুখের লোকটির জন্য ভালো কিছু করা কারণ এজন্যেই মানুষকে একা এ জীবনে পাঠানো হয়েছে!
(লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) রাশিয়ান লেখক, গদ্যকার ও দার্শনিকযিনি তার মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘‘ওয়ার এন্ড পিস’’ এর জন্য বিখ্যাত।)

শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প । কিছু স্লোগান আর এক টুকরো প্রেম

কিছু স্লোগান আর এক টুকরো প্রেম
শেখর দেব

সোনা ধরলে ছাই হয়ে যায়, কাছে গেলে দূরে যায় সব। চারপাশটা আজ খুব নিরব নিরব লাগছে আবিরের। কিছুই যখন ভালো লাগে না, চোখে যখন অন্ধকার দেখে তখন আবির সন্ধ্যায় চলে আসে জামালখান। জামালখানে এখন প্রতিদিন মেলা। প্রাণের মেলা। দাবির মেলা। বর্ণের ধারাপাত জামালখান জুড়ে। ক তে হয় কাদের মোল্লা, স তে সাঈদী...। আবিরের একটু একটু ভালো লাগে। ঝাপসা চোখের ঠুলি খুলে যায়। স্পষ্ট দেখতে পায় তারুণ্যের দাবির মেলা। দূরের মানুষ কাছে আসতে থাকে, কাঁধে কাঁধ মিলায়, স্বরে স্বর। আবিরের মনের ছাইগুলো সব সোনা হয়ে যায়। আবির চিৎকার করে স্লোগান ধরতে চায় কিন্তু মুখ ফুটে তা বাহিরে আসে না। আবিরের জীবনে যা ঘটে গেল তাতে কারো মুখ ফোটার কথা না। আজ তার মনের অবস্থা সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে না। স্লোগানে স্লোগানে মুখর জামালখানে দাঁড়িয়ে থাকে আবির। মনে মনে স্লোগান ধরে ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই। অবশ্য চিৎকার করে স্লোগান ধরার শক্তিও তার নেই। তার শরীরে যে হাজার বছরের ক্লান্তি। মনের অবস্থা ভালো না থাকলে যে মানুষ এত দুর্বল হয়ে যায় সে আগে বুঝতে পারেনি। সে হাঁটে বিভিন্ন বয়সী মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড দেখে আর দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের রাজাকারের পোস্টারে থুথু দেয়ার দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে। সেও একাত্তরের পশুগুলোর গালে থুথু দেয়। তার শান্তি লাগে, হালকা হয়ে আসে মন।
আবিরের আফসোস হয় কেন সারাদিন এখানে কাটাতে পারে না। নতুন চাকরি নিয়ে বড় বিপাকে আছে। কাজ আর কাজ। অফিস শেষ করে আবির চেষ্টা করে জামালখানে চলে আসতে। স্লোগান শুনতে শুনতে আবির হারিয়ে যায়। কোলাহল আবিরকে বড়ো বেশি চুপচাপ করে তোলো। প্রতিদিন উৎফুল্ল চিত্তে এ প্রতিবাদের স্রোতে ভাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু আজ মনের উপর বিশাল একঝড় বয়ে গেল, মলিন মুখ নিয়ে সে চেষ্টা করে প্রতিদিনের মতো উৎফুল্ল হতে কিন্তু পারে না। বারবার সম্পার কথা মনে পড়ছে। সম্পার মনের কী হাল হয়েছে তা ভাবতেও অবাক লাগছে। আবির মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে বিকেল থেকে। নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন। কে জানে-এতক্ষণে হয়তো একশোবার ট্রাই করেছে। না পেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। কিন্তু আবির আর কী করবে? এছাড়া অন্য কোন পথ যে খোলা নেই। পথ একটা আছে। সে পথ সুখের বলে মনে হয় না। মা বাবাকে বাদ দিয়ে কিভাবে সে বাকি জীবন চিন্তা করবে। যারা তাকে শত কষ্টের মাঝেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। চার ভাইয়ের মধ্যে আবিরই শুধু পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছে । অন্যরা কেউ কিছুটা করেছে অথবা একদমই পড়ে নি। কত কষ্ট করে বাবা আবিরকে মানুষ করেছে। বাবার তো আশা আছে ছেলে চাকরি করে বুড়ো বয়েসে সুখে রাখবে। এখন আবির সম্পার জন্য কিভাবে সব নিমেষে ছেড়ে দিবে। হয়তো তিন বছরের সম্পর্ক তবুও কিভাবে মা বাবাকে ছাড়া সম্পাকে নিয়ে সুখি হবে। বাবার সাফ জবাব-ওকে বিয়ে করলে ভাববো আমাদের ছেলে ছোটটা নেই, আমারতো আরো তিন ছেলে আছে, একটা ছেলে মারা গেলে কিছু যায় আসবে না। এরকম পরিস্থিতিতে কিভাবে সম্পর্কটাকে ধরে রাখবে আবির। সম্পা মেয়েটার জন্যও কষ্ট হচ্ছে খুব, কিছুই চিনে না শুধু আবির ছাড়া। কেন যে সম্পার সাথে সম্পর্কটায় জড়ালাম-ভাবতে ভাবতে হাঁটে।
চারপাশের হট্টগোল হঠাৎ নিমেষে হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে জামালখানের স্লোগানে। স্লোগান ভালো লাগে না আবিরের। ম্যাকিয়াভেলির একটা কথা মনে পড়ে যায় আবিরের-মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তুমুল স্লোগানের চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয়টা খুব জরুরী হয়ে গেল! আবিরের নিজের স্বার্থপরতা দেখে নিজের খারাপ লাগলো। তবু মন বলে কথা। সম্পার সাথে মনের লেনদেন হয়েছিল। সম্পাকে একদম ভুলে যেতে হবে। বাবাকে অলরেড়ি বলা হয়ে গেছে সম্পার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না। এখন বাস্তবায়নটা একান্ত নিজের উপর। কিন্তু আবির কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন মোবাইল বন্ধ রেখেছে এখবর জানতে পারলে সম্পার মনেই বা কী আসবে আবিরকে নিয়ে। সব কিছু গুবলেট হয়ে যাচ্ছে আবিরের মাথায়। আবির মাথাটা একটু ফ্রি করতে চাইল। আবার মনোযোগী হলো স্লোগানের ভেতর। আওয়ামী লীগ কি পারবে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে? বা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য কি যুদ্ধাপরাধের বিচার করা? নাকি পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া। বিএনপি কি আদর্শহীন রাজনীতি টেনে নিয়ে যেতে পারবে? সময় হয়তো এসবের সব সমাধান দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কী হবে? সম্পার কী হবে? একটি কথা মনে পড়ছে খুব-টাইম ইস দ্যা বেস্ট মেডিসিন। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে? তবে এটা নিশ্চিত সম্পা মেয়েটা জীবনেও আমাকে ক্ষমা করবে না। আবির বারবার চাইছে সম্পার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। বাবা মায়ের হঠাৎ উল্টে যাবার কাহিনীটিও তার বিশ্বাস হচ্ছে না । কী সুন্দর সব ঠিকঠাক করে আসলাম সবাইকে নিয়ে। সম্পার বাবা-মা-ই বা কী মনে করছে? কী ধারণা পোষণ করছে আমার পরিবার নিয়ে? তবে এ সত্যটা আবির আজ বুঝেছে পরিবারে প্রত্যেকের একটা আলাদা আলাদা মতামত দেয়ার অধিকার আছে এবং সে অধিকার ঠিক মতো তারা কায়েম করে। পরিবারে আবিরের মতো পড়ালেখা জানা আর কেউ নেই। আবিরের সিদ্ধান্তকে সবাই প্রাধান্য দিয়ে আসছে আজ-অব্দি কিন্তু হঠাৎ করে তার সিদ্ধান্তকে সবাই বাতিল করে দিবে একদম কল্পনাই করতে পারে না। আজ আবিরের ভুল ভাঙলো। কোথায় যে গলদ ছিল তার। সব কিছু গুছিযে এনেও সব চুরমার হয়ে গেল। আবির হাঁটতে হাঁটতে ডিসি হিল চলে এলো। ভাবলো মন্দিরে যাই, ঈশ্বরের কাছে যাই, মনটাকে স্থির করি। মন খারাপ থাকলে আবির মন্দিরে যায়। ভগবানের কীর্তন করে। নাম-কীর্তনে মনে প্রশান্তি আসে। সেদিন মায়ের মন্তব্যে খুব কষ্ট পেয়েছিল আবির- সে তো কৃষ্ণ নামের বদলে এখন সম্পা সম্পা করে কীর্তন করে ভগবানের কথাতো একদম ভুলে গেছে । গীতায় ভগবান বলেছেন আমার চার রকমের ভক্ত আছে তাদের মধ্যে এক প্রকার হচ্ছে যারা বিপদে পড়লে আমাকে স্মরণ করে। আবির ভাবলো-আমি তাদের দলে। বিপদে বা মানসিক অশান্তি না হলে ভগবানের কাছে আসি না। তাই-তো ভক্ত!

২.
সময়টাই এমন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবকিছু সহজ হয়ে আসছে মানুষের কাছে। প্রেমটাও খুব সহজ হয়ে গেছে। সবার হাতে হাতে মোবাইল। আন্দাজে কয়েকটা নম্বর ছাপলেই একটি মনের মানুষ মিলেও যায় খুব দুর্ভাগা না হলে। তখন আবির সদ্য পড়ালেখা শেষ করেছে। এই সোনার দেশ আজ ডিজিটাল, প্রেম করা খুব সহজ কিন্তু একটা চাকরি পাওয়া খুব কঠিন হয়ে ওঠেছে। বেকার প্রচুর কিন্তু চাকরি নাই তেমন। ভিশন-২০২১ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সদ্য বেকার আবির চাকরির পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। টিউশন করে যা পায় তাই দিয়ে চলছে মোটামুটি। এত বছর পড়াশুনার পর একটা চাকরির জন্য সবাই হা করে আছে আবিরের দিকে। একটার পর একটা পরীক্ষা দিচ্ছে। বড়জোর ভাইভা পর্যন্ত, চাকরি সোনার হরিণ হয়ে থেকে যায়। জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সুমি নামের একটি মেয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে তাঁর বুকে এসেছিল কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে চাকরিজীবী এক ছেলের বউ হয়ে অন্যের ঘরণি হয়েছে মাস ছয় হলো। সে শোক মোটামুটি কাটিয়ে উঠেছে আবির। অবশ্য সুমির সাথে সম্পর্কটা তেমন জমে ওঠেনি। বেকার জীবনে প্রেম তেমন নেশা ধরাতে পারে না হয়তো। চাকরি কি সত্যি সত্যি হবে না। এমন ঘোর টেনশানে দিন কাটাতে থাকে। একদিন রাতে মোবাইলে ম্যাসেজ আসে-ভালোবাসার কথা লেখা। আবির মোবাইল বেক করে প্রুথম সম্পার কণ্ঠটা শুনেছিল। মিষ্টি বেশ, চিনির চেয়ে একটু বেশি। ভুল করেই নাকি ম্যাসেজটা এসেছিল। পরে জানতে পারে এটা একদমই পরিকল্পিত একটা ম্যাসেজ ছিল। আবিরের এক ছাত্রের বান্ধবী সম্পা। বয়স অল্প সবে মাত্র এইচএসসি ভর্তি হয়েছে। এসব তথ্য জানতে আবিরের বছর খানেক সময় ব্যয় করতে হয়েছিল এই অপরিচিত সম্পার সাথে। মোবাইলে মোবাইলে সম্পর্ক। দেখা হয়নি তখনো দুজনার। বেকার জীবনের প্রতিটি সময়ে সম্পা আবিরকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা ছোট হলে কি হবে ওর কথা শুনলে মনেই হয় না সে সদ্য এইচএসসি ভর্তি হয়েছে। ঈশ্বর মেয়েদের পরিণত হবার আশ্চার্য শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া আবির মাঝে মাঝে যে সব বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত সম্পার কাছে ছিল তার সুন্দর সমাধান। আস্তে আস্তে সুমি নামের মেয়েটার জায়গা দখল করে নিল সম্পা। সম্পার একটাই সমস্যা সে কোন মতেই দেখা করতে চায় না। আবির বুঝতে পারে না কেন সম্পা তার সাথে দেখা করতে চায় না। দেখা করতে বল্লে, সে বলে চাকরি পাবার পর দেখা করবে। আবিরের প্রার্থীত জিনিসের মধ্যে এটাই প্রথমে। আবির মেনে নেয়, আগে চাকরি পেয়ে নিই তারপর দেখা। ভালোবাসা জমে ওঠে দিন দিন। দিনের কয়েক ঘণ্টা সেলুলারে চলে প্রেম। প্রেমটা ইদানীং মোবাইল প্রণয়ে রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিন ডজন খানেক সেলুলার চুমু না দিলে আবিরের ও সম্পার কারো ঘুম আসে না।
এভাবে চলছে অনেক দিন। এর মধ্যে চাকরি হলো আবিরের। ব্যাংকের চাকরি। বর্তমান সময়ে মেয়ের বাবাদের সবচেয়ে পছন্দের চাকরি। বর হিসেবে ব্যাংকার মেয়েদেরও প্রথম পছন্দ। এবার সম্পার সাথে দেখা করার পালা। আবির-তো আর সময় পায় না। নতুন চাকরি তার উপর বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং। এসব নিয়ে ব্যস্ত আবির। তাছাড়া সম্পাদের বাড়ি শহরে না। শহর থেকে অনতিদূরে কোন গ্রামে। সম্পা মেয়েটা কিছু বিষয় আবিরের কাছ হতে লুকিয়েছে। তার মধ্যে তাদের গ্রামে নাম। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল আবির কিন্তু সম্পা না বলায় পরে আর জিজ্ঞেস করেনি। সম্পা মেয়েটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট হলো সে একদম দেখা করার কথা বলে না। বাসর রাতে দেখা করলে যেন তার সবচেয়ে ভালো হয় এমন ভাব আছে তার কথায়। কিন্তু আবিরের এত ব্যস্ততার মাঝেও চায় তার সাথে একটু দেখা করি। যার সাথে অনেক কথা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনা। এমনকি বিয়ের পর হানিমুনের কথাও। চাকরি পাবার পর দেখা করার কথা থাকলেও সম্পার মুখে দেখা করার কোন আওয়াজ সে পায় না। একদিন আবির তাকে খুব চেপে ধরল দেখা করার জন্য। সিদ্ধান্ত হলো পহেলা বৈশাখ দেখা করবে। সম্পা কিন্তু এখনো দ্বিধা রেধে দিয়েছে কথার মধ্যে। আবির কোন মতেই সিউর হতে পারে নি আসলেই কি সে দেখা করবে?

৩.
এর মধ্যে তিন চার বার দেখা হয়েছে সম্পার সাথে। আবির খুব খুশি হতে পারেনি প্রথম দেখাতে । তবুও ভালোবাসর কথা ভেবে বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেয় নি। সিদ্ধান্ত নেয় সম্পাতো অনেক ভালোবাসে । বাকি জীবনটা না হয় তার সাথেই কাটিয়ে দিবে। সম্পাই আবিরের ফ্যামেলির সবাইকে তাকে দেখে যাবার জন্য তাগিদ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আবির রাজি হয় এবং তার ফ্যামেলির সবাইকে মেয়ে দেখতে যাবার জন্য মোটিভেট করে। আবিরের মা-বাবা একমাত্র শিক্ষিত ছেলের কথায় সম্পাকে দেখতে যায়। সাথে মেজো ভাই। মেজো ভাইয়ের কারণে আজ গণেশ উল্টে গেল। সম্পার মা-বাবাকে কথা দিয়ে আসে একবছর পরে বিয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরে মেজদার উক্তি ছিল-আমরাতো পড়ালেখা করিনি, তোমাদের পড়ালেখা জানা ছেলের রুচি যে এত নিচু তা কিভাবে জানি? এ মেয়ে ঘরে আনলে সবাই বলবে মেয়ের বাবা থেকে কয় লাখ টাকা নিয়েছি। এ প্রশ্নের জবাব কী দিব? এই মেয়ে বিয়ে করলে আমি তার সাথে নেই। একই সুর মিলালো মা-বাবা। এর পর থেকে মোবাইলটা বন্ধ রেখে উদ্দেশ্যহীন ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে জামালখান। উত্তাল স্লোগান। আবিরের মন খারাপ। দুই দিন মোবাইল বন্ধ । আজ আবির তার কোছের বন্ধু সুমনকে ফোন দিল ফোনের বুথ থেকে। সম্পা এ বন্ধুর ফোন নাম্বার জানত। বন্ধু বললো সম্পার ফোন আমি রিসিভ করিনি দুই দিন। আজ একটা আন-নোন নাম্বার থেকে ফোন এলো সম্পা নাকি বিষ খেয়েছে।