মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

এলিস মুনরোর সাক্ষাৎকার : অনুবাদ : শেখর দেব

এলিস মুনরোর সাক্ষাৎকারএটা এক টুকরা কাহিনী


ডিকলার আওয়ানো
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
এটা এক টুকরা কাহিনী এলিস মুনরোর সাক্ষাৎকার
২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন কানাডিয়ান সাহিত্যিক এলিস মুনরো। তিনি মূলত গল্পকার। ৮২ বছর বয়স্ক মুনরো ১১০তম নোবেল বিজয়ী, একই সঙ্গে মুনরো ১৩তম নারী সাহিত্যিক হিসেবে নোবেল বিজয়ের গৌরব অর্জন করেছেন। এলিস ‍মুনরোর ‘ডিয়ার লাইফ’ নামের গল্প সংকলনটি প্রকাশের পরে লিসা ডিকলার আওয়ানো’র নেওয়া সাক্ষকারটি বাংলানিউজের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন শেখর দেব।

আওয়ানো: আপনার লেখার রসায়ন সম্পর্কে বলবেন?

মুনরো: আমি ধীরে ধীরে কাজ করি, এ কাজটা কঠিন বা সর্বদাই কঠিনের কাছাকাছি। বিশ বছর বয়স হতেই নিয়মিত লিখছি, সত্যিকার অর্থেই লিখছি, এখন আমার বয়স ৮১। এখন নিত্যদিনের রুটিন হলো সকালো ওঠা, এক কাপ কফি খাওয়া আর লিখতে শুরু করা। অল্প কিছুক্ষণ পর একটু বিরতি নিয়ে কিছু খাই আবার লেখা চালিয়ে যাই। সকালেই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি লিখিত হয়। সকালের শুরুতেই বেশি সময় কাজে লাগাবো এরকম ভাবি না। হয়তো সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা কাজে লাগাই। অনেক লেখা পুনর্বার লিখি, এরপর ভাবি এইতো হলো লেখাটি, এরপরও এটা নিয়ে ভাবি, পুনর্বার নতুন কিছু সংযুক্ত করি। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় কিছু শব্দগুচ্ছ হয়তো সংযোজন করা উচিত, আবার তা লেখাটিতে অর্ন্তভুক্ত করি। উপন্যাস লেখার চিন্তা নিয়ে লেখা শুরু করি কিন্তু লিখেছি ছোটগল্পগুলোই কারণ এভাবে আমি আমার সময়গুলো কাজে লাগাতে পারি। এতে গৃহের এবং সন্তান দেখাশোনার কাজগুলো করতে পারতাম, উপন্যাস লিখলে সে সময়গুলো পেতাম না। লিখতে লিখতে অল্প কিছু পরে আমি গল্পের ফর্ম পেয়ে যেতাম, গল্পের গতানুগতিক ফর্ম নয়, একটু দীর্ঘ গল্পের ফর্ম দিতাম, মূলত যা আমি করতে চেয়েছিলাম। গল্পের এ আয়তনে বলতে পারতাম ঠিক যা আমি বলতে চেয়েছিলাম। প্র্রথমে এটা কঠিন ছিল কারণ গল্প বলতে মানুষ একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ফর্মকে বুঝতো। তার চায় ছোটগল্প। আমার গল্প তারা যা চায় ঠিক তেমন নয় একটু ভিন্ন এবং তোমাকে তারা ভিন্ন কিছু বলবে। অন্ততপক্ষে এটা আমি কখনো জানিনি গল্প শুধু একটি নির্দিষ্ট আয়তনের হবে। আমি অবাক হইনি গল্পটি কতো বড়ো দেখে, কারণ গল্প যে আয়তন চেয়েছে আমি সেটাই দিয়েছি। যাই হউক, আমি এখন কি লিখছি- এটা কি গল্প বা এটাকে কেউ গল্প বলছে কিনা এটা নিয়ে ভাবি না। এটা এক টুকরা কাহিনী- এটা যা ঠিক তাই।

আওয়ানো: আপনি একজন গীতধর্মী লেখক। আপনি কি এখনো কবিতা লেখেন?

মুনরো: ওহ, হ্যাঁ, কখনো সখনো লিখি। কবিতার ধারণাগুলো আমার ভালো লাগে কিন্তু তুমি জানো যখন তুমি গদ্য লিখ, আমি মনে করি তুমি সচেতনভাবেই কাব্যিকতাকে পরিহার করো। গদ্য চায় কিছু সোজাসাপ্টা তীব্রতা, এবং এখন এভাবেই লিখি। এমনভাবে লিখতে চাই যে পদ্ধতিটি আমি জানি না। এ কথায় পাঠককে আতঙ্কিত করা হবে?

আওয়ানো: আমার এটা মনে হয়েছে যে আপনি লোকাচার বিষয়ে খুব আগ্রহী।

মুনরো: হুম, তবে এটা তুমি কখনো জানবে না যে তুমি কিসে আগ্রহী হতে যাচ্ছো, যা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পার না। হঠাৎ করেই তুমি বুঝতে পারবে এটাই সেটা যেটা তুমি লিখতে চাচ্ছো। তাই নিজে নিজে এরকমটি চিন্তা করতাম না কিন্তু মানুষের বলা অনেক গল্প আমি শুনি এবং তার মধ্যে একটি রিদম খুঁজে পাই এবং লিখতে চেষ্টা করি। আমি চিন্তা করি কেন এ ধরনের গল্পগুলো মানুষের কাছে প্রয়োজনীয়? আমি মনে করি, তুমি এখনো মানুষের মুখ হতে অনেক গল্প শুনে থাকবে যা মানুষের জীবনের অবাক করা কিছু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হওয়ার কথা। আমি ঐ গল্পগুলোকে তুলে আনতে চাই এবং দেখি তারা কিভাবে গল্পগুলো বলছে অথবা আমি গল্পগুলোকে কিভাবে পরিচালনা করছি।


আওয়ানো : আমি কোথায় পড়েছি যে, লোকাচার নিয়ে গল্প বলাটা নারীদের ফর্ম বলে চিন্তা করা হতো।

মুনরো: আমি মনে করি এটা সেই নারীদের জন্য সত্য যাদের গুরুত্বের সহিত নেয়া হয়নি, এমনকি নারীরা লিখতে শিখার পরেও, তারা লিখতও, সম্ভবত তারা তখনো গল্পগুলোই বলছিল। তুমি জানো নারীরা অনেক সময় একসাথে অপচয় করেছে অথবা তারা ব্যবহারও করেছে। আমি মনে করতে পারি সেসব কাজগুলো, যেগুলো তোমরা একসাথে করেছিলে, যখন পুরুষ মানুষগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কতটা ভুগেছিলে। তারা হয়তো মাঠে কাজ করতো এবং তারা যখন ঘরে আসতো- যেটা আমার শিশুকালে দেখেছি- তোমরা তাদের প্রচুর খাবার পরিবেশন করতে। খাবারের প্রাচুর্যতা ও রান্নার গুণগতমান কতোটা ভালো হলো এটা নিয়েই ছিল নারীদের মধ্যে গর্বের বিষয় এবং পরক্ষণেই একগাদা থালা-বাসন পরিষ্কার করতে। এবং সবসময় একে অপরের সাথে কথা বলতে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অবশ্যই এসব কিছু এখন নাই। এটা পুরনো প্রক্রিয়া- গ্রামীণ প্রক্রিয়া এবং আমি জানি না নারীরা এখনো এভাবে কথা বলে কিনা। নারীরা কি একে অপরের সাথে কথা বলে? একে অপরকে উৎসাহিত করে, নাকি করে না? কিন্তু নারীরা যেখানে মিলিত হউক, তাদেরকে গল্প বলার উৎসাহ থাকা দরকার, এবং তা বলতে একে অপরকে উৎসাহিত করা দরকার যে, ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে তুমি কি ভাবছো? এটা বলা ভয়ানক ব্যাপার নয়? অথবা গল্পটি কি বুঝায়? সম্ভবত মহিলাদের একটা ঝোঁক আছে জীবনকে মুখে প্রকাশ করার। অনেক পুরুষ মানুষ এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতে নারাজ এটা আমি জানি বা জেনেছিলাম। তারা ভাবতো এগিয়ে যাওয়াই ভালো, যেভাবে মোকাবিলা করেছি সেভাবেই মোকাবিলা করা উচিত জীবনকে এবং এটা নিয়ে বেশি বিস্মিত হতে নেই।

আওয়ানো: আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে এটাই যদি আপনার অন্তর্গত বিষয় হয় আপনি কেন ছোট গল্পের ফর্মটি বেছে নিয়েছেন- নাকি এটিই আপনাকে বেছে নিয়েছে?

মুনরো: এটাও হতে পারে। আমি ভালোবাসি মানুষের সাথে কাজ করতে, মানুষের কথোপকথন নিয়েও এবং মানুষ থেকে আসা বিস্ময় নিয়ে। আমার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তা গ্রহণ করোনি তাতে কি হয়েছে। আমার একটি গল্পে (পলায়ন) একজন মহিলা তার বিয়ের ব্যাপারে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে তার স্বামীকে ছেড়ে যাবে এবং এ ব্যাপারে বয়স্ক বিচক্ষণ মহিলারা উৎসাহ দিয়েছে এবং সে সেটা করে। অতঃপর যখন সে ছেড়ে যায় সে বুঝতে পারে তার এটা করা উচিত নয়। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। হয়তো এটা করার পেছনে তার কাছে অনেক কারণ থাকতে পারে কিন্তু সে এটা করতে পারে না। কিভাবে আসে? এই ধরনের বিষয়গুলো আমি লিখি। কারণ আমি জানি না এই ‘কিভাবে আসাটা’। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই এটার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখানে এমন কিছু আছে যেটা মনোযোগ আশা করে।

আওয়ানো: আপনার গল্প সংগ্রহে দেখেছি গল্পগুলোর মাঝে একটি বন্ধন আছে এবং থিমেরও রিপিটেশান দেখি। আমি মনে করি ‘পলায়ন’ গল্পের পর্যায়ক্রমিক ঘটনা আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্প সংগ্রহের কিছু গল্পের সাথে মিলে যায় যেমন ‘ট্রেইন’ গল্পটি।

মুনরো: ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ গল্পটি আমাকে খুব আকর্ষণ করে কারণ আমি মনে করি মাঝে মাঝে মানুষ বুঝতে পারে না তাকে কি করতে হবে। আমি এটা বলতে চাচ্ছি যে, লোকটি (জ্যাকসন, মূল চরিত্র) জীবনের ব্যক্তিগত ঝামেলা হতে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। সে জানে না কেন। যখন তারা কাছে এলো, এটাই ওটা। সেখানে ছিল কিছু যৌন উপাদান কিন্তু এটাই একমাত্র বিষয় নয়। আমি মনে করি এখানের মানুষগুলোও সে রকম।

আওয়ানো: আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্পে আপনার মা-বাবার সাথে আপনার সম্পর্কের বিষয়ে স্ববিরোধী বিষয়ের অবতারণা করেছেন।

মুনরো: এটা ভালোবাসা, ভীতি ও অপছন্দের ব্যাপার। এ সব কিছু মিলেই এটা।

আওয়ানো: আপনি শুধু পেছনেই ফিরছেন, আপনার বিগত কাজগুলোতে, আপনার সাথে আপনার বাবার সম্পর্ক, যে একজন সম্পূর্ণ লেখক, খুব বেশি স্পর্শকাতর মানুষ, তার নিজের পুরো জীবনের একজন পাঠক।

মুনরো: হয়তোবা সে এরকম ছিল।


আওয়ানো: আপনার মায়ের সাথেও আপনার স্ববিরোধী সম্পর্ক ছিল।

মুনরো: এ ক্ষেত্রে সম্পর্কটি খুব জটিল কারণ আমি মূলত আমার বাবাকে বেশি পছন্দ করতাম। আমি আমার মাকে পছন্দ করতাম না এটা তার জন্য খুব দুঃখজনক ছিল।

আওয়ানো: তার অসুস্থতার কারণে কি?

মুনরো: না, আসলে তার অসুস্থতার জন্য নয়। সম্পর্কটি খারাপ হয় সম্ভবত তার অসুস্থতার আগে হতে। কিন্তু সত্যিকারভাবে সে একজন সুন্দর কন্যা সন্তান চেয়েছিল যে মান্য করে চলবে, যে কিনা চালাক ছিল কিন্তু সবকিছু মেনে চলতে পারলো না, সবকিছুর ফিরিস্তি গেয়েছে, প্রশ্ন করেনি।

আওয়ানো: এবং তখনো সে তার সময়কে নিয়ে চলছিল বিভিন্ন পথ ধরে।

মুনরো: হ্যাঁ, বিভিন্ন পথে সে ছিল। সে নারী অধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার ছিল এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও। সে খুব বেশি শুদ্ধিবাদী ছিল অর্থ্যাৎ গোঁড়ামি পছন্দ করত না যা তার সময়ের অনেক মহিলার মধ্যেই ছিল না।

আওয়ানো: আমার মনে হয় আপনার মাকে নিয়ে হতাশার জায়গা হল সেক্স নিয়ে তার ধারণাটি।

মুনরো: হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু তখন, অবশ্যই এটা কোথা থেকে আসছে ঈশ্বর জানে। বেশির ভাগ নারীরা, আমি মনে করি যারা ছিল খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তারা অনুভব করতো সেক্স হচ্ছে শত্রু। বিয়ের মাধ্যমে সব কিছুর ইতি ঘটে। আমি বলতে চাচ্ছি- সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটি একজন মহিলার জীবনে ঘটে, তাদের বলতে শুনতাম, অবশ্যই বিয়ে করতে হবে এবং অবশ্যই তাতে যৌন মিলন থাকবে, এবং যৌন মিলন হলো এমন একটি ব্যাপার যা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা হলো এটাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

আওয়ানো: আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্পে স্মৃতির গৃহের নবায়নের ধারণা ব্যবহার করেছেন। আপনি কি বলবেন কিভাবে আপনি ভাবেন স্মৃতির প্রকৃতি নিয়ে।

মুনরো: কি ঘটছে এটা খুব মজার, আপনি বুড়ো হচ্ছেন কারণ আপনার স্মৃতি প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল হচ্ছে, বিশেষত দূরের স্মৃতিগুলো। কিন্তু আমি স্মৃতি দিয়ে সবকিছু চেষ্টা করি না, কিন্তু এটা সবসময় ওখানেই থাকে। আমি জানি না আমি এটা নিয়ে যা ভাবি তার চেয়ে বেশি লিখছি কিনা। নিঃসন্দেহে শেষের গল্পগুলোতে স্মৃতির চেতনা কাজ করেছে, এবং আমি সবসময় এ রকমটি করি না কারণ আমি মনে করি তুমি যদি সত্যিকারভাবে খুব মনোযোগের সাথে তোমার পিতা-মাতা ও শিশুকাল নিয়ে লিখতে যাও তোমাকে যতোটা সম্ভব সৎ হতে হবে। তোমাকে অবশ্যই ভাবতে হবে সত্যিকারভাবেই কি ঘটেছিল, না হয় তোমার গল্পগুলো তোমার স্মৃতিকে খেয়ে ফেলবে। অবশ্যই তুমি এটা করতে পারো না। তাই অবশ্যই তোমাকে বলতে হবে- ভালো, এটাই আমার জীবনের গল্প- যেটা আমি স্মরণ করতে পারি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৩
এমজেএফ/জেসিকে

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

অনুবাদ গল্প : তিনটি প্রশ্ন : মূল : লিও তলস্তয় : অনুবাদ : শেখর দেব


যদি কোন রাজার এমন হতো যে, সবকিছু শুরুর সঠিক সময় সে সর্বদাই আগে থেকে জানত, যদি জানত তার কথা মেনে চলবে এমন সঠিক মানুষটি কে এবং কাকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং সর্বোপরি, রাজা যদি সর্বদাই জানত  কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে শুরু করতে হবে, তাহলে সে রাজা কোন কিছুতেই বিফল হতো না এবং আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতো
প্রতিনিয়ত এই চিন্তা রাজার মাথায় ঘুরতে লাগলো, রাজা তার রাজ্য জুড়ে এই বলে ঢোল পেটাল যে, রাজা সেই ব্যাক্তিকে পুরস্কৃত করবে যে তাকে বলতে পারে, কিভাবে সে বুঝতে পারবে প্রত্যেক কাজ শুরুর সঠিক সময় কোনটি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে, এবং সে কিভাবে জানতে পারবে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তাকে আগে করতে হবে
অনেক জ্ঞানি পন্ডিত ব্যাক্তিরা রাজার কাছে আসল এবং বিভিন্নভাবে তার প্রশ্নের জবাব দিলপ্রথম প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বললো, প্রত্যেকটি কাজ সঠিক সময়ে করতে চাইলে অবশ্যই আগে থেকে একটি পরিকল্পনা চার্ট বানাতে হবে, প্রতিটি দিনের জন্য এমনকি প্রতিটি মাস ও বছরের জন্যেও এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবেতারা বললো, এইভাবে সবকিছুই সঠিক সময়ে করা সম্ভবঅন্যরা বললো, প্রতিটি কাজের সঠিক সময় আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু নিজে কোন অলস সময় কাটানো ঠিক নয়, একজন অবশ্যই চলমান সময়ের প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করা এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করা উচিতআবার অন্যরা বললো ঠিক উল্টো, রাজা যতোই চলমান সময়ের প্রতি মনোযোগী হউক না কেন প্রতিটি কাজের সঠিক সময় বের করা সত্যিই কঠিন কিন্তু তার একজন জ্ঞানি ব্যাক্তির পরামর্শ প্রয়োজন যে তাকে প্রত্যেকটা কাজের সঠিক সময় নির্ধারণে সাহায্য করতে পারেকিন্তু পরে অন্যরা বললো, পরামর্শ দেয়ার আগ মুহূর্তে কিছু কাজ থাকবে যা অপেক্ষা করবে না কিন্তু কে ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এ কাজটি করবে নাকি করবে না কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একজনকে অবশ্যই জানতে হবে কি ঘটতে যাচ্ছে একজন জাদুকরই তা জানে অতএব প্রতিটি কাজের সঠিক সময় জানার জন্য অবশ্যই একজন জাদুকরের পরামর্শ দরকার
একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিলকেউ বললো, যে লোকটির রাজার খুব দরকার সে হলো পরামর্শদাতা অন্যরা বললো, একজন পুরোহিতঅন্যরা বললো, একজন ডাক্তার, যখন কিছুলোক বললো সৈনিকরা হলো একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মানুষতৃতীয় প্রশ্ন : কোন কাজটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এর উত্তরে কেউ বললো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে বিজ্ঞানঅন্যরা বললো তা হলো যুদ্ধে ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং অন্যরা আবার বললো, তা হলো ধর্মীয় আচার আচরণ করা
প্রত্যেকটি উত্তর ভিন্ন ভিন্নরাজা কারো সাথে একমত হতে পারলো না এবং কাউকে পুরস্কৃত করতে পারলেন না কিন্তু এখনো সে সঠিক উত্তরের আশা ছাড়লো নারাজা সিদ্ধান্ত নিল সে একজন তপস্বীর পরামর্শ নিবে যে কিনা তার জ্ঞানের জন্য বিখ্যাততপস্বী বাস করে ঝামেলামুক্ত একটি পরিবেশে যা কখনো সে ছেড়ে যায় না এবং সাধারণ মানুষ ছাড়া কারো সাথে দেখা করে নাতাই রাজা সাধারণ পোশাক পরে গেলেন এবং একটু দূরে ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর দেহরক্ষীকে পেছনে রেখে একা গেলেন
যখন রাজা তপস্বীর কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি তাঁর কুঁড়ে ঘরের সামনে মাটি খনন করছিলেনতাঁকে দেখেই রাজা সম্ভাষণ জ্ঞাপন করে খনন স্থলে গেলেনতপস্বীর অবস্থা বেশ নাজুক ও দুর্বল ছিল কোদালের প্রতিটি কোপে সামান্য পরিমাণ মাটি তুলে আনছেন এবং জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেনরাজা তার পাশে গিয়ে বললো, হে জ্ঞানী তপস্বী আমি অপনার কাছে এসেছি তিনটি প্রশ্নের উত্তরের আশায়প্রশ্ন তিনটি হলো - কিভাবে আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারবো? কোন মানুষটিকে আমার খুব প্রয়োজন এবং আমাকে কার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি?, অতএব তাকে বাকিদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবকোন কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটাকে আমি প্রথমেই গুরুত্ব দেব?
তপস্বী রাজার কথা শুনছিলেন কিন্তু কোন উত্তর দিলেন নাসে কোদাল হাতে পুনরায় মাটি খনন শুরু করলেনরাজা বললো, আপনি ক্লান্তআপনি কোদালটা আমাকে দিন আমি আপনার হয়ে কিছুক্ষণ খনন করে দেইতপস্বী ধন্যবাদ দিয়ে কোদাল রাজার হাতে তুলে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেনকিছুক্ষণ খননের পর রাজা কাজ থামিয়ে পুনরায় প্রশ্নগুলো আবার করলেনএবারও তপস্বী কোন উত্তর দিলেন নাবসা থেকে উঠে তপস্বী রাজার দিকে কোদালের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো আমাকে একটু কাজ করতে দাও
কিন্তু রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে খনন চালিয়ে যেতে লাগলেনএক ঘণ্টা অতিবাহিত হল, আরো একঘণ্টা পার হলো, সূর্যটা দূরে গাছের পেছনে ডুবে গেলঅবশেষে রাজা কোদালটা মাটিতে ফেলে বললো, হে জ্ঞান তাপস আমি এখানে এসেছি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতেযদি আপনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তবে বলেন আমি ফিরে যাই
তপস্বী বললো -কেউ এদিকে দৌড়ে আসছে, চলো দেখি কে সে
রাজা চারপাশে থাকালো এবং দেখলো একটা দাড়িওয়ালা লোক দৌড়ে এ দিকে আসছেতার হাত দিয়ে লোকটি তার তলপেট চেপে ধরে আছে এবং হাতের নিচ দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছিল যখন লোকটি রাজার নিকট আসল তখন সে মৃদু গোঙাতে গোঙাতে মূর্ছা গেলরাজা ও তপস্বী লোকটির গায়ের কাপড় ঢিলঢিলে করে দিলতার তলপেটে গভীর ক্ষত দেখতে পেলরাজা যতটুকু সম্ভব ভাল করে ধৌত করে নিল এবং হাতের কাপড় ও তপস্বীর তোয়ালে দিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিলকিন্তু রক্ত প্রবাহ সহজে বন্ধ হলো নারাজা বারংবার তার তপ্ত রক্তে ভেজা ব্যন্ডেজ খুলে নতুন করে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগলেনঅবশেষে যখন লোকটির শরীর হতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলো লোকটি চেতনা ফিরে পেল এবং কিছু পানিয় চাইলেনরাজা পরিষ্কার পানি নিয়ে আসলেন এবং তাকে খেতে দিলেনএরমধ্যে সূর্য ডুবে গেল এবং চারদিক ঠান্ডা হয়ে এলোসেজন্য রাজা তপস্বীর সহায়তায় আহত লোকটিকে তপস্বীর কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গেল এবং বিছানায় শুয়ে দিলেনবিছানায় শুয়ে লোকটি চোখ বুজে শান্ত হয়ে গেলরাজা তার কাজকর্মে পরিশ্রান্ত হয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়লো এবং গ্রীষ্মের ছোট রাত কখন শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারলো নাসকালে যখন রাজা জেগে ওঠল তার অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল যে সে কোথায় আছে সেটা বুঝতে এবং তার পাশে বিছানায় শুয়ে থাকা অগন্তুক দাড়িওয়ালা লোকটিইবা কে? যে কিনা স্থির দৃষ্টিতে বড়ো বড়ো চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে
আমাকে ক্ষমা করুন- দুর্বল কণ্ঠে বললো দাড়িওয়ালা লোকটি যখন সে দেখতে পেল রাজা জেগে উঠেছিল এবং তার দিকে তকিয়ে ছিল
রাজা বললো - আমি তোমাকে চিনি না এবং এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে
আপনি আমাকে চিনেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনিআমি আপনার সে শত্রু যে কিনা আপনার উপর প্রতিশোধ নিব বলে শপথ করেছিলাম কারণ আপনি আমার ভাইকে গ্রেপ্তার  করে তার সকল সম্পত্তি জব্দ করেছিলেনআমি শুনেছিলাম যে আপনি একা এ তপস্বীকে দেখতে আসবেন  এবং আমি ভেবে রেখেছি আপনি ফেরার পথে আপনাকে হত্যা করবো কিন্তু সে দিনটি চলে গেল কিন্তু আপনি ফিরলেন নাতাই আপনাকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য আমি এদিকে আসছিলাম এবং হঠা আপনার বডিগার্ড আমাকে অক্রমণ করে বসলো এবং তারা আমাকে চিনতে পেরে আমাকে আহত করলোআমি তাদের কাছ হতে পালিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার সেবা না পেলে আমি মারা যেতামআমি অপনাকে হত্যা করতে এসেছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে রক্ষা করলেনএখন আমি যদি বাঁচি এবং আপনি যদি চান, আমি আপনার বিশ্বস্ত কৃতদাস হতে চাই এবং আমার সন্তানদেরও তাই করতে আদেশ করবোঅনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করুণরাজা খুব সহজে তাঁর শত্রুকে বন্ধু করতে পেরে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না তার কৃতদাসকে পাঠিয়ে রাজার ব্যক্তিগত চিকিসককে ডেকে পাঠালেন এবং তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন
আহত ব্যাক্তি হতে বিদায় নিয়ে রাজা বারান্দা হতে বেরিয়ে তপস্বীর খোঁজে চারপাশে তাকালেনচলে যাবার পূর্বে অন্তত আরেকবার যদি সে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় ভেবেতপস্বী বাইরেই আছেনহাঁটু
গেড়ে বীজতলায় বীজ বপনে রত যেখানে গতদিন খনন করা হয়েছিল
রাজা তাঁর দিকে গেলেন এবং বললেন - হে জ্ঞান তাপস শেষবারের মতো আমি অপনার কাছে প্রশ্নগুলোর উত্তর আশা করছি
তপস্বী বললো তুমি এর মধ্যেই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছএখনো তিনি  অবনত হয়ে রাজার সামনে কাজ করে যেতে লাগলেন
কিভাবে উত্তর পেলাম? আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?- রাজা বললেনতুমি দেখনি? বললো তপস্বীগতকাল তুমি যদি আমার ক্লান্তি দেখে আমাকে মাটি খননে সাহায্য না করতে এবং তুমি ফিরে চলে যেতে এই লোকটি তোমাকে আক্রমণ করতো এবং তুমি অনুশোচনা করতে কেন তুমি আমার সাথে থাকলে না ভেবেসুতারাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে যখন তুমি বীজতলা খনন করছিলে এবং আমিই ছিলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমাকে সাহায্য করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এর ঠিক পরে যখন আহত লোকটি আমাদের দিকে এলো তখন গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল তার কাজে লাগাযদি তুমি তাকে সঠিক সেবা না দিতে তাহলে সে তোমার বন্ধু না হয়ে মারা যেতসুতারাং সে হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি এবং তার জন্য তুমি যা করেছ সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজএখন মনেকরে দেখশুধু বর্তমান সময়টাই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কারণ এখন আমাদের কিছু শক্তি আছেসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হলো যে তোমার সামনেই আছে কারণ মানুষ জানে না সে কার সাথে কাজ করতে বা দেখা করতে যাচ্ছেএবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সমুখের লোকটির জন্য ভালো কিছু করা কারণ এজন্যেই মানুষকে একা এ জীবনে পাঠানো হয়েছে!
(লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) রাশিয়ান লেখক, গদ্যকার ও দার্শনিকযিনি তার মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘‘ওয়ার এন্ড পিস’’ এর জন্য বিখ্যাত।)

শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গল্প । কিছু স্লোগান আর এক টুকরো প্রেম

কিছু স্লোগান আর এক টুকরো প্রেম
শেখর দেব

সোনা ধরলে ছাই হয়ে যায়, কাছে গেলে দূরে যায় সব। চারপাশটা আজ খুব নিরব নিরব লাগছে আবিরের। কিছুই যখন ভালো লাগে না, চোখে যখন অন্ধকার দেখে তখন আবির সন্ধ্যায় চলে আসে জামালখান। জামালখানে এখন প্রতিদিন মেলা। প্রাণের মেলা। দাবির মেলা। বর্ণের ধারাপাত জামালখান জুড়ে। ক তে হয় কাদের মোল্লা, স তে সাঈদী...। আবিরের একটু একটু ভালো লাগে। ঝাপসা চোখের ঠুলি খুলে যায়। স্পষ্ট দেখতে পায় তারুণ্যের দাবির মেলা। দূরের মানুষ কাছে আসতে থাকে, কাঁধে কাঁধ মিলায়, স্বরে স্বর। আবিরের মনের ছাইগুলো সব সোনা হয়ে যায়। আবির চিৎকার করে স্লোগান ধরতে চায় কিন্তু মুখ ফুটে তা বাহিরে আসে না। আবিরের জীবনে যা ঘটে গেল তাতে কারো মুখ ফোটার কথা না। আজ তার মনের অবস্থা সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে না। স্লোগানে স্লোগানে মুখর জামালখানে দাঁড়িয়ে থাকে আবির। মনে মনে স্লোগান ধরে ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই। অবশ্য চিৎকার করে স্লোগান ধরার শক্তিও তার নেই। তার শরীরে যে হাজার বছরের ক্লান্তি। মনের অবস্থা ভালো না থাকলে যে মানুষ এত দুর্বল হয়ে যায় সে আগে বুঝতে পারেনি। সে হাঁটে বিভিন্ন বয়সী মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড দেখে আর দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের রাজাকারের পোস্টারে থুথু দেয়ার দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে। সেও একাত্তরের পশুগুলোর গালে থুথু দেয়। তার শান্তি লাগে, হালকা হয়ে আসে মন।
আবিরের আফসোস হয় কেন সারাদিন এখানে কাটাতে পারে না। নতুন চাকরি নিয়ে বড় বিপাকে আছে। কাজ আর কাজ। অফিস শেষ করে আবির চেষ্টা করে জামালখানে চলে আসতে। স্লোগান শুনতে শুনতে আবির হারিয়ে যায়। কোলাহল আবিরকে বড়ো বেশি চুপচাপ করে তোলো। প্রতিদিন উৎফুল্ল চিত্তে এ প্রতিবাদের স্রোতে ভাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু আজ মনের উপর বিশাল একঝড় বয়ে গেল, মলিন মুখ নিয়ে সে চেষ্টা করে প্রতিদিনের মতো উৎফুল্ল হতে কিন্তু পারে না। বারবার সম্পার কথা মনে পড়ছে। সম্পার মনের কী হাল হয়েছে তা ভাবতেও অবাক লাগছে। আবির মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে বিকেল থেকে। নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন। কে জানে-এতক্ষণে হয়তো একশোবার ট্রাই করেছে। না পেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। কিন্তু আবির আর কী করবে? এছাড়া অন্য কোন পথ যে খোলা নেই। পথ একটা আছে। সে পথ সুখের বলে মনে হয় না। মা বাবাকে বাদ দিয়ে কিভাবে সে বাকি জীবন চিন্তা করবে। যারা তাকে শত কষ্টের মাঝেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। চার ভাইয়ের মধ্যে আবিরই শুধু পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছে । অন্যরা কেউ কিছুটা করেছে অথবা একদমই পড়ে নি। কত কষ্ট করে বাবা আবিরকে মানুষ করেছে। বাবার তো আশা আছে ছেলে চাকরি করে বুড়ো বয়েসে সুখে রাখবে। এখন আবির সম্পার জন্য কিভাবে সব নিমেষে ছেড়ে দিবে। হয়তো তিন বছরের সম্পর্ক তবুও কিভাবে মা বাবাকে ছাড়া সম্পাকে নিয়ে সুখি হবে। বাবার সাফ জবাব-ওকে বিয়ে করলে ভাববো আমাদের ছেলে ছোটটা নেই, আমারতো আরো তিন ছেলে আছে, একটা ছেলে মারা গেলে কিছু যায় আসবে না। এরকম পরিস্থিতিতে কিভাবে সম্পর্কটাকে ধরে রাখবে আবির। সম্পা মেয়েটার জন্যও কষ্ট হচ্ছে খুব, কিছুই চিনে না শুধু আবির ছাড়া। কেন যে সম্পার সাথে সম্পর্কটায় জড়ালাম-ভাবতে ভাবতে হাঁটে।
চারপাশের হট্টগোল হঠাৎ নিমেষে হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে জামালখানের স্লোগানে। স্লোগান ভালো লাগে না আবিরের। ম্যাকিয়াভেলির একটা কথা মনে পড়ে যায় আবিরের-মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তুমুল স্লোগানের চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয়টা খুব জরুরী হয়ে গেল! আবিরের নিজের স্বার্থপরতা দেখে নিজের খারাপ লাগলো। তবু মন বলে কথা। সম্পার সাথে মনের লেনদেন হয়েছিল। সম্পাকে একদম ভুলে যেতে হবে। বাবাকে অলরেড়ি বলা হয়ে গেছে সম্পার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না। এখন বাস্তবায়নটা একান্ত নিজের উপর। কিন্তু আবির কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন মোবাইল বন্ধ রেখেছে এখবর জানতে পারলে সম্পার মনেই বা কী আসবে আবিরকে নিয়ে। সব কিছু গুবলেট হয়ে যাচ্ছে আবিরের মাথায়। আবির মাথাটা একটু ফ্রি করতে চাইল। আবার মনোযোগী হলো স্লোগানের ভেতর। আওয়ামী লীগ কি পারবে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে? বা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য কি যুদ্ধাপরাধের বিচার করা? নাকি পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া। বিএনপি কি আদর্শহীন রাজনীতি টেনে নিয়ে যেতে পারবে? সময় হয়তো এসবের সব সমাধান দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কী হবে? সম্পার কী হবে? একটি কথা মনে পড়ছে খুব-টাইম ইস দ্যা বেস্ট মেডিসিন। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে? তবে এটা নিশ্চিত সম্পা মেয়েটা জীবনেও আমাকে ক্ষমা করবে না। আবির বারবার চাইছে সম্পার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। বাবা মায়ের হঠাৎ উল্টে যাবার কাহিনীটিও তার বিশ্বাস হচ্ছে না । কী সুন্দর সব ঠিকঠাক করে আসলাম সবাইকে নিয়ে। সম্পার বাবা-মা-ই বা কী মনে করছে? কী ধারণা পোষণ করছে আমার পরিবার নিয়ে? তবে এ সত্যটা আবির আজ বুঝেছে পরিবারে প্রত্যেকের একটা আলাদা আলাদা মতামত দেয়ার অধিকার আছে এবং সে অধিকার ঠিক মতো তারা কায়েম করে। পরিবারে আবিরের মতো পড়ালেখা জানা আর কেউ নেই। আবিরের সিদ্ধান্তকে সবাই প্রাধান্য দিয়ে আসছে আজ-অব্দি কিন্তু হঠাৎ করে তার সিদ্ধান্তকে সবাই বাতিল করে দিবে একদম কল্পনাই করতে পারে না। আজ আবিরের ভুল ভাঙলো। কোথায় যে গলদ ছিল তার। সব কিছু গুছিযে এনেও সব চুরমার হয়ে গেল। আবির হাঁটতে হাঁটতে ডিসি হিল চলে এলো। ভাবলো মন্দিরে যাই, ঈশ্বরের কাছে যাই, মনটাকে স্থির করি। মন খারাপ থাকলে আবির মন্দিরে যায়। ভগবানের কীর্তন করে। নাম-কীর্তনে মনে প্রশান্তি আসে। সেদিন মায়ের মন্তব্যে খুব কষ্ট পেয়েছিল আবির- সে তো কৃষ্ণ নামের বদলে এখন সম্পা সম্পা করে কীর্তন করে ভগবানের কথাতো একদম ভুলে গেছে । গীতায় ভগবান বলেছেন আমার চার রকমের ভক্ত আছে তাদের মধ্যে এক প্রকার হচ্ছে যারা বিপদে পড়লে আমাকে স্মরণ করে। আবির ভাবলো-আমি তাদের দলে। বিপদে বা মানসিক অশান্তি না হলে ভগবানের কাছে আসি না। তাই-তো ভক্ত!

২.
সময়টাই এমন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবকিছু সহজ হয়ে আসছে মানুষের কাছে। প্রেমটাও খুব সহজ হয়ে গেছে। সবার হাতে হাতে মোবাইল। আন্দাজে কয়েকটা নম্বর ছাপলেই একটি মনের মানুষ মিলেও যায় খুব দুর্ভাগা না হলে। তখন আবির সদ্য পড়ালেখা শেষ করেছে। এই সোনার দেশ আজ ডিজিটাল, প্রেম করা খুব সহজ কিন্তু একটা চাকরি পাওয়া খুব কঠিন হয়ে ওঠেছে। বেকার প্রচুর কিন্তু চাকরি নাই তেমন। ভিশন-২০২১ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সদ্য বেকার আবির চাকরির পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। টিউশন করে যা পায় তাই দিয়ে চলছে মোটামুটি। এত বছর পড়াশুনার পর একটা চাকরির জন্য সবাই হা করে আছে আবিরের দিকে। একটার পর একটা পরীক্ষা দিচ্ছে। বড়জোর ভাইভা পর্যন্ত, চাকরি সোনার হরিণ হয়ে থেকে যায়। জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সুমি নামের একটি মেয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে তাঁর বুকে এসেছিল কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে চাকরিজীবী এক ছেলের বউ হয়ে অন্যের ঘরণি হয়েছে মাস ছয় হলো। সে শোক মোটামুটি কাটিয়ে উঠেছে আবির। অবশ্য সুমির সাথে সম্পর্কটা তেমন জমে ওঠেনি। বেকার জীবনে প্রেম তেমন নেশা ধরাতে পারে না হয়তো। চাকরি কি সত্যি সত্যি হবে না। এমন ঘোর টেনশানে দিন কাটাতে থাকে। একদিন রাতে মোবাইলে ম্যাসেজ আসে-ভালোবাসার কথা লেখা। আবির মোবাইল বেক করে প্রুথম সম্পার কণ্ঠটা শুনেছিল। মিষ্টি বেশ, চিনির চেয়ে একটু বেশি। ভুল করেই নাকি ম্যাসেজটা এসেছিল। পরে জানতে পারে এটা একদমই পরিকল্পিত একটা ম্যাসেজ ছিল। আবিরের এক ছাত্রের বান্ধবী সম্পা। বয়স অল্প সবে মাত্র এইচএসসি ভর্তি হয়েছে। এসব তথ্য জানতে আবিরের বছর খানেক সময় ব্যয় করতে হয়েছিল এই অপরিচিত সম্পার সাথে। মোবাইলে মোবাইলে সম্পর্ক। দেখা হয়নি তখনো দুজনার। বেকার জীবনের প্রতিটি সময়ে সম্পা আবিরকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা ছোট হলে কি হবে ওর কথা শুনলে মনেই হয় না সে সদ্য এইচএসসি ভর্তি হয়েছে। ঈশ্বর মেয়েদের পরিণত হবার আশ্চার্য শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া আবির মাঝে মাঝে যে সব বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত সম্পার কাছে ছিল তার সুন্দর সমাধান। আস্তে আস্তে সুমি নামের মেয়েটার জায়গা দখল করে নিল সম্পা। সম্পার একটাই সমস্যা সে কোন মতেই দেখা করতে চায় না। আবির বুঝতে পারে না কেন সম্পা তার সাথে দেখা করতে চায় না। দেখা করতে বল্লে, সে বলে চাকরি পাবার পর দেখা করবে। আবিরের প্রার্থীত জিনিসের মধ্যে এটাই প্রথমে। আবির মেনে নেয়, আগে চাকরি পেয়ে নিই তারপর দেখা। ভালোবাসা জমে ওঠে দিন দিন। দিনের কয়েক ঘণ্টা সেলুলারে চলে প্রেম। প্রেমটা ইদানীং মোবাইল প্রণয়ে রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিন ডজন খানেক সেলুলার চুমু না দিলে আবিরের ও সম্পার কারো ঘুম আসে না।
এভাবে চলছে অনেক দিন। এর মধ্যে চাকরি হলো আবিরের। ব্যাংকের চাকরি। বর্তমান সময়ে মেয়ের বাবাদের সবচেয়ে পছন্দের চাকরি। বর হিসেবে ব্যাংকার মেয়েদেরও প্রথম পছন্দ। এবার সম্পার সাথে দেখা করার পালা। আবির-তো আর সময় পায় না। নতুন চাকরি তার উপর বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং। এসব নিয়ে ব্যস্ত আবির। তাছাড়া সম্পাদের বাড়ি শহরে না। শহর থেকে অনতিদূরে কোন গ্রামে। সম্পা মেয়েটা কিছু বিষয় আবিরের কাছ হতে লুকিয়েছে। তার মধ্যে তাদের গ্রামে নাম। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল আবির কিন্তু সম্পা না বলায় পরে আর জিজ্ঞেস করেনি। সম্পা মেয়েটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট হলো সে একদম দেখা করার কথা বলে না। বাসর রাতে দেখা করলে যেন তার সবচেয়ে ভালো হয় এমন ভাব আছে তার কথায়। কিন্তু আবিরের এত ব্যস্ততার মাঝেও চায় তার সাথে একটু দেখা করি। যার সাথে অনেক কথা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনা। এমনকি বিয়ের পর হানিমুনের কথাও। চাকরি পাবার পর দেখা করার কথা থাকলেও সম্পার মুখে দেখা করার কোন আওয়াজ সে পায় না। একদিন আবির তাকে খুব চেপে ধরল দেখা করার জন্য। সিদ্ধান্ত হলো পহেলা বৈশাখ দেখা করবে। সম্পা কিন্তু এখনো দ্বিধা রেধে দিয়েছে কথার মধ্যে। আবির কোন মতেই সিউর হতে পারে নি আসলেই কি সে দেখা করবে?

৩.
এর মধ্যে তিন চার বার দেখা হয়েছে সম্পার সাথে। আবির খুব খুশি হতে পারেনি প্রথম দেখাতে । তবুও ভালোবাসর কথা ভেবে বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেয় নি। সিদ্ধান্ত নেয় সম্পাতো অনেক ভালোবাসে । বাকি জীবনটা না হয় তার সাথেই কাটিয়ে দিবে। সম্পাই আবিরের ফ্যামেলির সবাইকে তাকে দেখে যাবার জন্য তাগিদ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আবির রাজি হয় এবং তার ফ্যামেলির সবাইকে মেয়ে দেখতে যাবার জন্য মোটিভেট করে। আবিরের মা-বাবা একমাত্র শিক্ষিত ছেলের কথায় সম্পাকে দেখতে যায়। সাথে মেজো ভাই। মেজো ভাইয়ের কারণে আজ গণেশ উল্টে গেল। সম্পার মা-বাবাকে কথা দিয়ে আসে একবছর পরে বিয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরে মেজদার উক্তি ছিল-আমরাতো পড়ালেখা করিনি, তোমাদের পড়ালেখা জানা ছেলের রুচি যে এত নিচু তা কিভাবে জানি? এ মেয়ে ঘরে আনলে সবাই বলবে মেয়ের বাবা থেকে কয় লাখ টাকা নিয়েছি। এ প্রশ্নের জবাব কী দিব? এই মেয়ে বিয়ে করলে আমি তার সাথে নেই। একই সুর মিলালো মা-বাবা। এর পর থেকে মোবাইলটা বন্ধ রেখে উদ্দেশ্যহীন ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে জামালখান। উত্তাল স্লোগান। আবিরের মন খারাপ। দুই দিন মোবাইল বন্ধ । আজ আবির তার কোছের বন্ধু সুমনকে ফোন দিল ফোনের বুথ থেকে। সম্পা এ বন্ধুর ফোন নাম্বার জানত। বন্ধু বললো সম্পার ফোন আমি রিসিভ করিনি দুই দিন। আজ একটা আন-নোন নাম্বার থেকে ফোন এলো সম্পা নাকি বিষ খেয়েছে।

মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

কবি শেখর দেব এর সাক্ষাৎকার



চিন্তা ও চেতনার কাছে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারলে কবিতা বৃষ্টির মতো ঝড়তে থাকে: শেখর দেবের সাথে অনলাইন আলাপ ও তার কবিতা



দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

শেখর দেব: কবিতা লেখার তাগিদ কাজ করে ভেতরে তাই লিখি


দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

শে: প্রস্তুতি নিয়ে কবিতা লেখা যায় নাকবিতা এমনি আসার ব্যাপার কিন্তু মাঝে মাঝে কবিতা কাঁচা ফর্মে আসে যাকে পাকা করে নিতে হয়তবে চিন্তা ও চেতনার কাছে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারলে কবিতা বৃষ্টির মতো ঝড়তে থাকে কবির কলমে


দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

শে: অনেকের কবিতা ভালো লাগেএকজন কবির সব কবিতা ভালো হয় না এবং লাগেও নাথাই নাম বলা শক্ত ব্যাপারতবে ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে প্রচুর


দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

শে: সব ভালো কবিরও খারাপ কবিতা থাকেভালো কবি সব সময় ভালো কবিতা লিখবে কথা নেইতবে যারা ভালো কবিতা লিখেন তারা একটি ফর্মে ফেলে দেয় কবিতাকেস্বর সৃষ্টি হয়  খারাপ কবিতা সনাক্ত করার কোন স্কেল নেইতবে যে কবিতা মনকে নাড়া দিতে পারে না এবং সুন্দর বোধ দৃশ্যমান না হলে কবিতা খারাপ হয়নাম ধরে বাছাই করা মুশকিল


দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেনএ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শে: দশকে দশকে নতুন কবি ও কবিতা হাজির হয় আমাদের সাহিত্যেপ্রশ্নটা পরিষ্কার নাদশক কিভাবে মূল্যায়ন করি নাকি দশকের কবিতা কিভাবে মূল্যায়ন করি? দশকের কথা বললে দশক দিয়ে কবিতা আলাদা করা যায় না বা ঠিক নয়কবিকে দশকে বন্দি না করলে ভালোনব্বই দশকের কবিতা নিয়ে বলতে গেলে-এই সময়ে কবিতা অনেক Compact স্বল্প কথার কবিতা তখন পূর্ণতা পায়কবিতায় নতুন একটি ধারনা আসে এই দশকে - উত্তর আধুনিকতাযা চট্রগ্রাম হতে সারা বাংলাদেশ ছড়িয়ে পরেযা চট্রগ্রাম সবুজ হোটেলের আড্ডার ফসলশূন্য দশকের কথা আসলে বলতে হয় এ দশকে কবিরা নানান পরিক্ষা নিরীক্ষা মধ্য দিয়ে কাব্য কে একটা নুতন মাত্রা দিতে প্রয়াস চালিয়েছেনযা অব্যাহত আছে


দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

শে: কবিতা কবিতাই তা পশ্চিমবঙ্গের হউক বা বাংলাদেশের হউকতবে দু'দেশের কবিতার মধ্যে চিন্তাগত তারতম্য রয়েছেআমার মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের কবিতার মধ্যে বিচ্ছিনতার মাত্রা বেশিআমদের কবিতা পশ্চিমবঙ্গের কবিতার চেয়ে আমাদের কবিতার মান ভালো বলে মনে করি, এটি আমার বাক্তিগত ধারনা


দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

শে: ব্লগ সাহিত্য সম্পর্কে আমি তেমন অবগত নয়তবে তরুন সমাজ এ বিষয়ে উৎসাহী বলে মনে হয়তবে ব্লগ সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে নতুন মাত্রা দিতে পারে


দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শে: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় নাকারন বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পথে থাকলেও আমাদের অনেকে তেমন ডিজিটাল হয়ে উঠতে পারেনি বা সুযোগ পায়নিতবে সময়ের সাথে এ ধারনার পরিবর্তন হতে পারেএকদিন হয়ত ব্লগ গুরুত্ব পাবে বেশি লিটলম্যাগের চাইতে


দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

শে: দৈনিকে সাহিত্য কিছু মানুষের কাছে জিম্মিসম্পাদকের অনুগ্রহ এখানে জরুরি, সাহিত্যের মান কদাচিৎ গুরুত্ব পায়এ সাহিত্যে দল সৃষ্টি হয় যার কেন্দ্রে থাকে সম্পাদক



শেখর দেব এর কবিতা

গুলজারের মোড়ে মৃত্যু বিষয়ক


নিজেকে দেখতে গিয়ে অন্ধ হয়েছি সেদিন
চারদিক আধাঁর কিলবিল
স্মৃতির আল বেয়ে আসে অতীত-আলো
ভেসে ওঠে লাল, সবুজ কতো বাহারি চরাচর

গুলজারের মোড়ে রমণীয় তিলোত্তমারা নেমে এলে
নন্দনকাননে ফোটে সুদৃশ্য ফুল
বিজ্ঞাপনি মেয়ের চোখে চোখ রেখে
পটু ইন্দ্রের দল তুলে নেয় ফুলের শিশির
খোঁজে মদির মমতা; সাইবার খুঁনসুটি 

নিজের ভেতর অন্য প্রাণের শিহরণে মৃত্যু হয়েছে আমার
রঙিন দিনগুলো ক্রমশঃ দূরে সরে গেলে
অত্মজা এক প্রাণ ছোটে পেছন পেছন

পুনর্জন্ম হলে
নিশ্চল পাথর হয়ে সুরম্য ইমারতে
সাক্ষী হব এসবের




পালশঠোঁটে বসন্ত


অলস বিকেলে কলম ছুঁড়ে পেয়েছি কাঙ্খিত পরশ
অসমাপ্ত স্কেচ্ আকাশে উড়িয়ে বেঘোর বিছানায়
নামে পাখিসুদূর প্রান্তর হতে বর্ষীয়ান দরবেশ
আনে কথার ফুলঝুরিভাবিচিত্রের বাস্তবায়নে
বাস্তবতা যায় দূরেশ্রবণাতীত শব্দের প্রতিফলনে
মাপি স্নিগ্ধ স্বপ্নের গভীরতাপ্রগাঢ় যমুনাজল ভাসায়
স্বপ্ন অতলান্তে হারায়

রক্তিম পলাশ তার পাপড়ি মেলে ওড়ায় আমাকে
পলাশঠোঁটে নরোম ছোঁয়া-পাতা ঝরায় গোপন মাতমে
মাতাল মন পলাশ পলাশ ডাকে-আসে বসন্ত


বাটালি হিলের মোলায়েম মেঘ


তোমাদের সব নির্জন রাত
                         
ভরিয়ে দেবো পূর্ণিমার আনন্দে
বিগত বর্ষার স্মৃতি নিয়ে
                   
যেতে পারো বাটলি হিল
ছুঁয়ে আসো মোলায়েম মেঘ
পাখির অভ্যর্থনায়
           
ফুলেরা খুলে দেবে পেলব পাপড়ি

প্রিয়ার চোখ দেখিনি কোনদিন
                   
ডুবে গেছি রক্তের আনন্দে
এখানে কান্ত শহর
                   
তার ঘানি টেনে টেনে
অবসাদের রাতে তোমাকে দেবো
                   
বাটালি হিলের নিরবতা

শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

গল্প : তনুতে চপল মন

তনুতে চপল মন
শেখর দেব
একা হবার মাঝে মজা আছে। কেমন মজা সেটা? পৃথিবীর সবকিছুই একা। এ গ্রহটিকে সঙ্গ দেয়ার জন্য অন্য কোনো গ্রহ কি তার বুকে এসেছিল? সবাই তফাতে তফাতে চলছে যে যার মতো। পৃথিবীর মতো সবকিছুই ভীষণ একা। তনুর ইদানীং খুব একা লাগছে। এখন সে একাকিত্বের মজা খুঁজতে ব্যাকুল। জনমানবশূন্য কোনো স্থানে একা নয় বরং অপরিচিত মুখের ভিড়ে একা। তনুকে কেউ চিনে না, সেও কাউকে চিনে না। ছোটবেলায় মা-বাবার বকা খেয়ে এরকম কোন স্থানে চলে আসতে ইচ্ছে হতো তার। আজ মা-বাবাই তাকে আদর করে এরকম জায়গায় পাঠিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত ও ব্যর্থ মানুষরা একা হতে চায়। তবে এটাও ঠিক, ব্যর্থতা বা সফলতা দুটুই হতাশা আনায়নের বাহক হতে পারে। মন বলে কথা! মনের মৌনতা কিংবা সরবতা দেখে মনকে বোধগম্য করা কঠিন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠীকে বক রূপি যম প্রশ্ন করেছিল পৃথিবীতে কোনো জিনিসের গতি সবচেয়ে বেশি? যুধিষ্ঠীর উত্তর ছিল মন। প্রশ্নের সঠিক উত্তরে খুশি হয়ে যমরাজ মৃত্যুপথযাত্রী ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহাভারতের গল্প এটি। মনের গতি সত্যিই অকল্পনীয়। তনু চাইলেই সে তার তরুছায়া সুনিবিড় গ্রাম ঘুরে আসতে পারে নিমেষে, তনু চোখ বন্ধ করলো, এই সেই মাটির দু'তলা বাড়ি, সামনে উঠোন, শান বাঁধানো ঘাট, উঠোনের কোনায় গন্ধরাজের বাগান, দাওয়ায় বসে গন্ধরাজের ঘ্রাণে মন মাতাল হয়ে আসে। উঠোনজুড়ে নানান খেলা। তনুর মন তার গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে। তনু ভাবলো আমিতো ছোট নই। এই বয়সে গ্রামে গেলে আমি কি ঠিক আগের মতো মাতাল হবো? মিশে যেতে পারবো মাটির সাথে? মনে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তনু একজনকে খুব ভালোবাসে। অনেকদিন সে ফোন করে না। তনু হয়তো তাই একা অনুভব করছে খুব, একাকিত্ব নিয়ে মোটামুটি একটি থিসিস রেডি করছে যেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে করা থিসিসের চেয়েও যেন এটা কঠিন।

তনু কিছুদিন হলো চাকরিসূত্রে ঢাকা এসেছে। জীবনের প্রথম চাকরি বলে কথা। চারদিকে অপরিচিত মুখ। পরিচিত মুখগুলো ফেলে জীবিকার টানে চলে আসা। এ দেশে চাকরির যে হাল : ব্যাংকের চাকরি বলে কথা। ঢাকা অদ্ভুত শহর তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার কথা মনে হলো তার 'শহর শহর ঢাকা শহর/আজব শহর ঢাকা'। মানুষ আর মানুষ। আসলেই আজব। শুধু মাথা আর মাথা কারো মুখ কেউ দেখার ফুরসত নেই। তনু মাঝে মাঝে চুপ মেরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর ছুটে চলা দেখে। কি নিরন্তন ছুটে চলা। মৃত্যু হয়তো এর শেষ গন্তব্য। ফুটপাতে দিনাতিপাতে রত হাজারো মানুষ। কেউ ছুটছে কোটি টাকার পেছনে আবার কেউ শুধু একা থালা ভাত। ফুটপাতে কি দুর্বিষহ জীবন মানুষের। মৌলিক চাহিদার ছিটে ফোঁটাও তারা পায় না। বাংলাদেশ। এই দেশটির কি কোনো পরিবর্তন হবে না? রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে তনুর ঘেন্না হয়। নেতানেত্রীরা নোংরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। হাসিনা আর খালেদা নামের দুটি পথে জনগণ শুধু চলছে তো চলছে। কখনো খালেদার কাছে আবার কখনো হাসিনার কাছে কিন্তু দেশ সেই একই হালে যেই লাউ সেই কদু্। বাঙালির বুক ভরা আবেগ। জাতির পিতা হতে উত্তরাধিকার সূত্রে এ আবেগ পেয়েছে। কখন বাঙালি ভালো থাকে বা মন্দে থাকে তাদের নিজেদের কাছেও বোধগম্য নয়। চারদিকের মানুষগুলো যেন মুখোশ। মুখোশের এক রূপ, খুলে দিলে অন্য রূপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি সব চিন্তা করে যাচ্ছে তনু। চারদিকে প্রচুর হট্টগোলের মাঝেও যেন তার মাঝে অনাবিল নীরবতা। এতোক্ষণ পর তার কানে লাগলো এসব হট্টগোল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো মানিব্যাগটি আছে কিনা। এ শহরে কখন পকেট থেকে মানিব্যাগ চলে যাবে তার ইয়ত্তা নাই। বেমালুম দাঁড়িয়ে থাকার পরে পকেটে মানিব্যাগটা আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তনু। কি যানজট! গাড়িগুলো কেমন বেপরোয়া কখন কার গায়ে তুলে দেয় ঠিক নাই। মাঝে মাঝে তনুর গাছ হতে ইচ্ছে করে। ঠাই দাঁড়িয়ে ব্যস্ত মানুষের দৌড় ঝাঁপ দেখে যেন মজাই লাগবে।

দুই. মন এক চঞ্চল মেয়ে। তনু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। চাকরি পাবার পর তার সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির পর মেয়েটা তনুকে ফোন দেয় না। প্যান্টের পকেটে বারবার হাত দেয় তনু। ভাবে হয়তো মোবাইলটা ভাইভ্রেট হচ্ছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। মোবাইলটা বের করে দেখে আসলেই কোনো কল আসেনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তনু। চারদিক উজ্জ্বল নিয়ন আলোতে আলেকিত হয়ে আছে শহর। তনু উঠেছে বন্ধুর কাছে। এসেই বাসা পাওয়া শক্ত ব্যাপার। ঢাকা শহর বলে কথা। বন্ধু পুলিশের চাকরি করে, তার ব্যারাকে উঠেছে। ব্যারাক বললে কেমন তাঁবু তাঁবু লাগে। এদের তো সুরম্য ভবন। পুলিশ টেলিকম ভবন। সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে বন্ধুর টেবিলে বসেছে। মোবাইলটায় যে মায়ের কল ছাড়া আর কোনো কল আসার চান্স নেই সেটা বুঝতে পেরে ডেস্কে রেখে দিল। তনুর কবিতা লেখার শখ অনেকদিনের। একটা কাগজ ও কলম নিয়ে বসেছে কিন্তু কোনো লাইনই তার কলম দিয়ে বের হচ্ছে না। বিরহে থাকলে নাকি কবিতা হয়। কোথায় কিছুইতো আসছে না তনুর কলমে। অবশ্য কবিতা এমন এক ব্যাপার। লিখতে চাইলেই ধুম করে লেখা যায় না। কলম হাতে নিলে শব্দের পর শব্দ আসে। আসে বাক্যের পর বাক্য কিন্তু কবিতা হয় না। চিন্তা কবিতার মোক্ষম শক্তি। চিন্তার সুষম বণ্টন তনুর অনেকদিন হচ্ছে না। চিন্তাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন যেন মৌলিকতা হারাচ্ছে। কবিতা না হলেও আজ তনুর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই সে লিখবে। গদ্য অন্তত হচ্ছে। অবশ্য গদ্যের মধ্যেও চিন্তার সুবণ্টন থাকা জরুরি। এতক্ষণ ধরে যা সে লিখলো তাতে নিজেই অসন্তুষ্ট। লেখাতে চিন্তার সুষম বণ্টন লন্ঠন জ্বালিয়েও খুঁজতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিন্তা করলো কেনইবা লিখছি? আমি না লিখলেও বাংলায় লেখার মানুষ কম নাই। কাগজটা হাতে মুচড়ে হাতের তালুতে গুঁজে নিল। ছোটবেলার মতো এই মোছড়ানো কাগজটা নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে ইচ্ছে করছে খুব। না তা করলো না, জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে কলমের দিকে চোখ রেখে সে বসে রইল। এভাবে থাকতেই হয়তো ভালো লাগছে। চিন্তা করছে জীবনে সে কতো কলম শেষ করেছে লিখতে লিখতে। স্কুলে থাকা অবস্থায় পরীক্ষার সময় গুনে গুনে শেষ হওয়া কলমগুলো জমিয়ে রাখতো। দেখতো কয়টা কলম শেষ করেছে এ পরীক্ষায়। লিখতে লিখতে হাতের মধ্যমাতে কলমের ভারে দাগ বসে যেত। আর এ কলমটি যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। অবশ্য এখনতো আর পরীক্ষা দিতে হয় না। তবু এ কলমটির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি তার চাকরি জীবনের প্রথম কলম। এটি দিয়ে কতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলে প্রতিদিন কিন্তু একটা কবিতা হয় না। এটাই তার কাছে দুঃখের। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। তনু বুঝতে পারলো মা-ই হবে। মন ফোন করবে না । মন মেয়েটার মন কঠিন শক্ত। ফোন করবেই না। ঝগড়া হবার পর তনু কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু মন রিসিভ করেনি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো মা-ই ফোন করেছে। মা শব্দটা সন্তানের জন্য কতোটা আশীর্বাদের তা বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক মতো খাচ্ছি কিনা? শরীর খারাপ করেনি তো? সারাদিন একটা ফোন দিসনি? এসব প্রশ্নের ধীরে ধীরে উত্তর দিতে লাগলো তনু। তনু নিচু স্বরে কথা বলছে শুনেও মায়ের উৎকন্ঠা। কি হয়েছে তোর এভাবে কথা বলছিস কেন? কোনো সমস্যা হয়নিতো? পৃথিবীতে এই একজন মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসে।

মা হারালেই পৃথিবীতে সন্তান যেন সব হারায়। তনু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার মায়ের মৃত্যু যেন সে না দেখে। তার আগেই যেন সে চলে যায়। তনুর এক বিবাহিত বন্ধুর বলা স্ত্রী ও মা নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার। বন্ধুটি ঢাকা থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গ্রামে ফেরার পর প্রথম দেখাতে মা বলেছিল। 'পথে কোনো সমস্যা হয়নিতো? হাত মুখ ধুয়ে আয় কিছু খেয়ে নেয় আর অন্যদিকে স্ত্রী প্রথম দেখাতে বললো_ঢাকা থেকে আসছ আমার জন্য কি এনেছ? এ হলো মা ও স্ত্রীর পার্থক্য। দুজনই কিন্তু বন্ধুটিকে খুব ভালোবাসে এটাই স্বাভাবিক। কার ভালোবাসা কিসে সেটা বলা যায় না। অবশ্য সবাইতো এক না। মানুষভেদে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তনু চিন্তা করলো বিয়েই করবে না কোনোদিন। সে নিজেকে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা তার খুব মনে পড়ছে- 'জীবনে হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও । সুখী হতে চাইলে বিয়ে করো আর বিয়ে না করলে মহৎ হবার পথ খোলা।' মায়ের ফোনটা রাখার পর তার আর বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। রাতের ঢাকার ফুটপাত বেয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হলো তনুর। তার পুলিশ বন্ধু এখনো ডিউটিতে আছে। রাতও হয়ে আসছে বেশ।

ব্যারাকের খাবার, সিদ্ধ চালের ভাত একদম ভালো লাগে না। বের হলে একেবারে হোটেল থেকে খেয়ে আসতে পারবে।

ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকার বাহারি বাতি ভালোই লাগে। রাজারবাগ টেলিকম ভবন হতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল, ফুটপাতে কিছু মহিলা তাঁবুতে রুটি ছেঁকে বিক্রি করছে। রিকশাওয়ালা এসে জঠরাগি্ন নিভিয়ে আবার কাজে নেমে পড়ছে। রুটিগুলো বড় বড় দেখতে ভালোই লাগছে। তনু ভাবলো একদিন এখানে বসে রুটি খেতে হবে, ভাজি দিয়ে। ঘর্মাক্ত এক রিকশাওয়ালা কি মজা করেই না খাচ্ছে। আর মহিলাটি পান চিবুতে চিবুতে একটার পর একাটা গরম রুটি নামিয়েই যাচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিশাল প্রশস্ত মাঠটি দেখতে ভালোই লাগছে। ফুটপাতের পাশেই একটি সুদৃশ্য মন্যুমেন্ট। নিয়ন আলোতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এটি একটি স্মৃতির ফলক, একাত্তরের ১৭ মার্চ এখানে সশস্ত্র বিদ্রোহে অনেক বাঙালি সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে এ মন্যুমেন্ট নির্মিত। তনু ভাবলো ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ গিয়ে ডিনারটা সেরে নেবে। ফুটপাতে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত। মরণ ফাঁদ যেন। পরিকল্পিত কোনো কিছুই যেন বাংলাদেশে হওয়ার নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাইবা কে করে? লুটেপুটে খাওয়ার তালে সবাই। আর একটু হলে তনু হয়তো গর্তে পড়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে কখন মালিবাগ মোড়ে চলে এসেছে তনু বুঝতেই পরেনি, ঢাকা শহরে একটাই জ্বালা। সব রাস্তা প্রায় একই ধরনের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো এটা মালিবাগ। একটা ছোট হোটেলে আগে খেয়েছিল সে। ওঠাতে যেতে হলে রাস্তাটা পার হতে হবে। যেই পার হতে যাবে হঠাৎ একটা ট্রাক এসে তনুর গা ঘেঁষে ব্র্যাক করলো। তনু যেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো। কোনো মতে রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে চিন্তা করলো মরে গেলেই ভালো হতো। মনের কথা মনে পড়ল। মানুষ একা থাকা ভালো। প্রেম করে একা হবার মতো জ্বালা যেন আর কিছুই নেই। হয়তো সে কথা মাথায় আসতে সে এরকমটি ভাবছে। তনুর ভাবতে ভালো লাগছে।

সত্যিই যদি মরে যেতাম তাইলে কি কি হতো। মায়ের জন্যই তার বেশি খারাপ লাগতো। মা কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিত। মন মেয়েটা হয়তো একটু আফসোস করতো। পত্রিকায় খবর ছাপা হতো। মানিব্যাগে সুন্দর ছবি আছে পত্রিকায় ছাপাতো। পরিচিত জন আফসোস করতো। আমি মরে গেলে খুশি হতো এমন কেউকি পৃথিবীতে আছে? কারো ক্ষতি করার চিন্তা করিনি কোনোদিন। এসব চিন্তা করতে করতে একটা লোক গায়ে প্রায় ধাক্কা দিয়েই হেঁটে গেল। তনুর সম্বিৎ ফিরে আসলো। হোটেলে ডুকে তনুর ভাত আর খেতে ইচ্ছে হলো না। দুটি রুটি খেয়েই চলে আসলো পুলিশ বন্ধুর কোয়ার্টারে।

তিন.

আজ শনিবার। ব্যাংক বন্ধ। সকাল হতেই তনুর সবকিছু অন্যরকম লাগছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘুম ভাঙালো । শীত আসি আসি করে এখনো আসছে না। তবে শীতের একটি আমেজ যেন এ মিষ্টি রোদে। তনুর মনের সকল অনুভূতিতে গ্রাম খেলা করে। গ্রামে কাটানো শীতের দিনগুলো খুব মনে পড়ছে তনুর। এখন হয়তো গ্রামে শীত পড়ছে বেশ। শুধু ঢাকা শহরে শীত ঘেঁষতে পারছে না নাগরিক চাপে। তবুও আজকের সকালটা তনুকে বেশ আমোদ দিল। মনটা বেশ ফুরফুরে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মনকে একটা ফোন দিতে। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছেও করছে না আবার। আজ সারাদিন শহরে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে তনু। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরে সকালেই বেরিয়ে গেল। মনের সাথে তনুর প্রেমের প্রথম দিকের সময়গুলোর কথা মনে পড়ছে আজ। পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতেও তার খুব ভালো লাগছে। আকাশে নিবিড় তুলো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ফয়ে'স লেকের পাহাড়গুলোতে ঝিরিঝিরি হাওয়া। মনকে তনুর সেই প্রথম কিস্- অন্যরকম অনুভূতি খেলে যাচ্ছে দুজনার মাঝে। সেই প্রথম মন তনুর বুকে মাথা রেখে ভালবাসার গান শুনেছিল। অনেকক্ষণ কাটিয়েছে। ঐ দিনের অনুভূতি হয়তো কাউকে প্রকাশ করতে পারবে না। এসব চিন্তা করতে করতে তনু রাজারবাগ থেকে শান্তিনগর চলে এসেছে।

সে চিন্তা করলো আজ বেইলি রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পর্যন্ত চলে যাবে, আরো হাঁটতে ইচ্ছে করলে শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে ফুটপাতে বসে চা খেয়ে আসবে। এত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলল তনু। মন মেয়েটির মন কতো শক্ত কে জানে। একটা ফোনও কি দিতে পারে না। আবার তনুর মন খারাপ হয়ে গেল। যখন ঝগড়া হয় দুপক্ষেরই দোষ থাকে কম বেশি। শুধু তনুর দোষ তাতো নয়। তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মনেরও খুব কষ্ট হচ্ছে তার মতো। তনু পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে একটি এসএমএস দিল। 'কেমন আছে। তুমি অনেক নিষ্ঠুর। একটুও কি আমার খবর নিতে পারো না? ঢাকা এতো বড় শহর। কি করছি। কোথায় আছি। কেমন আছি। কিছুই কি জানতে ইচ্ছে করে না? ভালো থেকো।'

হাঁটতে হাঁটতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ফেলে, মিনিস্টারদের বাসভবন ফেলে একটা ব্যস্ততম রোডের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাটি পার হলেই ওপাশে রমনা পার্কের গেট। রাস্তাটি পার হতে গিয়ে যেই রাস্তার মাঝখানে, তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মন এর ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে গিয়ে হঠাৎ পা আগাতে ভুলে যায় তনু। রিসিভ বাটনে ক্লিক করতেই একটি কার সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। তনু রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। মন একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো । মন হ্যালো হ্যালো করতেই ফোনটা কেটে গেলো।