ষোলই ডিসেম্বর। অগ্রাহায়নের শেষ, পৌষের শুরু এমন কোন এক দিন। ফসলের মাঠে পাকা ধানের ঘ্রাণ। কিছু কাটা হয়েছে, কিছুতে পাকার রঙ লাগছে। ভোরের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরের রোদঝলমল খেলা। বাড়ির পাশেই স্কুল। বিজয়ের গান ভেসে আসছে স্কুল মাঠ হতে। চারদিকে বিজয়ের ঘ্রাণ। কী অদ্ভুত টানে গানের কথায় ও সুরে মগ্ণ হয়ে থাকা বাড়ির দাওয়ায়। রোদের উষ্ণ তাপে এ যেন নতুন আঁচ লাগায় মনে ওপ্রাণে। ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো খুলতে থাকে অপরিপক্ক মনের ঝাপসা ক্যানভাসে ।
আমাদের শৈশবে বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। আমাদের কৈশোর নব্বই দশকে গণতান্ত্রিক সময়ে। তখনো বুঝি না স্বৈরশাসন কী বা গণতন্ত্রই বা কী। হয়তো সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে মাত্র গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছি। তাও পরীক্ষায় পাশের জন্য কিছু মুখস্থ বুলি ছাড়া কিছুই নয়। স্কুলের এত্ত এত্ত বই আর পড়াশোনা শুধু পরীক্ষা পাসের জন্যই ভেবেছি পুরো স্কুল জীবনে। এখন এসে মনে হয় স্কুলের পাঠ যে শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নয় এই সত্যটি উপলব্ধি করাতে আমাদের শিক্ষকরা ব্যর্থ ছিলেন।
দাওয়া হতে রোদ নেমে গেছে উঠোনে। শিমুল তুলো গাছের ফাঁকে রোদের রেখাগুলো উঠোন জুড়ে আলোর ফুলে সাজিয়ে দিয়েছে। রোদের আঁচের আশায় আমরাও বসার মাদুরসমেত নেমে যেতাম উঠোনে। ততক্ষণে স্কুল কম্পাউন্ড হতে একটি বজ্রকন্ঠ ভেসে আসতো। গা শিউরে উঠা সব কথা। সেই ভাষণ থেকে একটা শব্দ কানে লাগতো খুব। সংগ্রাম। মা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতো। সংগ্রামের কথা। স্বাধীনতার কথা। পাকিস্তান আমলের শাসন ও শোষনের কথা। পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কথা। আমরা ছিলাম পরাধীন। আজ আমরা পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত যে সংগ্রামের মাধ্যমে এটাই সেই সংগ্রাম। স্কুলে লাগানো মাইকে সেই সংগ্রামের আহবান ভেসে আসছে। যিনি আহবান করছেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর কণ্ঠ কিশোর শরীরে প্রবাহিত রক্তে কেমন ঢেউ খেলে যায়।
ঠাকুরদিদি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতো দুচোখে টলমল জল নিয়ে। বলতো আমি মরে গেলে আমাকে পুড়িও না, কবরও দিও না। আমরা অবাক হতাম, বিস্মিত হয়ে জানতে চাইতাম, মরে গেলে তোমাকে কী করবে ঠাকুরদি? দিদি ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিতেন, আমাকে বাড়ির সামনে বয়ে যাওয়া খালে ভাসিয়ে দিও। আমি ভেসে ভেসে তোদের ঠাকুরদার কাছে চলে যাবো। তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতো ঠাকুরদা কোথায় থাকেন। বাড়ির সামনে বয়ে যাওয়া খালটাই বা কোথায় গেছে। মাঝে মাঝে খালের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে খালের সমাপ্তি খুঁজতাম। ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। শীতকালে খালটি শুকিয়ে যায়। এখানে সেখানে টুকটাক পানি জমে থাকতো। আমরা সেই পানি সেঁচে মাছ ধরতাম। ঠাকুরদিদিকে বলতাম তুমি শীতকালে মারা যেও না। শীতকালে তোমাকে ভাসানোর মত পানি খালে থাকবে না। কোন বর্ষায় তুমি মরে গেলে ভালো করে ভাসিয়ে দিতে পারবো। ভাসতে ভাসতে ঠাকুরদার কাছে চলে যেতে পারবে। আচ্ছা ঠাকুরদা কি কখনো ফিরবে না? ঠাকুরদা খাল বেয়ে কোথায় চলে গেছে? সাগরে? সাগরে কেন গেছে?
এত এত প্রশ্নের ফাঁকে ঠাকুরদিদির চোখ দিয়ে আরো কিছু জল ঝরে যেত। ঠাকুরদার গল্প বলতো চোখ মুছতে মুছতে। এ গল্প ঠাকুরমার ঝুলি থেকে নেয়া রূপকথা নয় বরং ঠাকুরদার বাস্তব গল্প। যে গল্পে মিশে আছে রক্তের ¯্রােত ও আগুনের লেলিহান শিখা।
ঠাকুরদা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতেন। বিষয়টি রাজাকাররা যেদিন জেনে গেল সেদিন রাতে পুড়ে দেয়া হল বাড়ি। চোখের সামনেই ছারখার হয়ে যেতো দেখলো ঠাকুরদিদির গোছানো সংসার। সেই আগুনের মরণ থাবা হতে বাবাদের বাঁচিয়ে ঠাকুরদি পালিয়ে গেল বনে বাদাড়ে। সেদিন থেকে ঠাকুরদার খোঁজ পায় না দিদি। পরে একদিন শুনলো ঠাকুরদাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আরেকদিন শুনলো ঠাকুরদাকে জবাই করে দিয়েছে রাজাকাররা।
ঠাকুরদিদি এসব বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন ভোরে পূর্ব দিগন্তে রক্তাভ সূর্য উঠছিল। চারদিকে খবর ছড়িয়ে গেছে, বিজয় আসন্ন। ঠিক তখনই ঠাকুরদিদিকে বিশ্বাস করতে হলো ঠাকুরদা আর নেই।
ঠাকুরদার সাথে আরো দুজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। সে দুজন লোকের সাথে দেখা হলো ঠাকুরদিদির। তারা বললেন, জীবন বাঁচানোর জন্য একবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে কী হয়? সে বলবেই না। আমরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে ফিরে এসেছি রাজাকারদের হাত থেকে। আমাদের গাছের ডালে মাথা নিচের দিকে দিয়ে উপরে পা বেঁধে রেখেছিল। সবাইকে বাঁচার শেষ সুযোগ হিসেবে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলেছিল। সে কি না বললো, ‘আমি মরে গেলেও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবো না। আমি স্বাধীন বাংলাদেশ হয়তো দেখবো না কিন্তু আমার নাতি পুতি একদিন ঠিকই দেখবে।’যখন তাকে জবাই করছিল তখনও সে বলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ।
ঠাকুরদার গলাকাটা লাশটি খালের পাড়ে জাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। ঠাকুরদিদি আর বাবারা অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেয়েছিল লাশটি। তখন আর লাশের সৎকার করার অবস্থায় ছিল না। সেই খালেই ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল দেহাবশেষ । সাগরের কোন মাছ নিশ্চই ঠাকুরদাকে ছিঁড়ে-ছুঁড়ে খেয়েছে। ঠাকুরদার কলিজা খাওয়া মাছটির সাহস দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এই দেশের জন্য নিজের প্রাণটি বিলিয়ে দিতে। এমন মহৎ মৃত্যু কজনের হয়?
মাইকে ভেসে আসা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ এর ভাষণ আমাকে উলটপালট করে দেয়। আমি স্কুলের দিকে ছুটে যেতে চাই। ততক্ষণে ঠাকুর দিদির দুচোখে শীতে শুকিয়ে যাওয়া খালের মতো জল প্রবাহিত হয়। আমি সেই জলে চেতনার মাছ ধরি। চোখের সামনে ভেসে উঠে ঠাকুরদার গলাকাটা খ-বিখ- লাশ ভাসছে সাগরে। আর দিদি মৃত লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছি খালের জলে। খাল বেয়ে ঠাকুরিদি চলে যাচ্ছে ঠাকুরদার কাছে। দেখি ঠাকুরদা হাতছানি দিয়ে ডাকছে দিদিকে। আমাদের চোখে ঠাকুরদা হয়তো দেখছে স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশের জল হাওয়ায় আমরা যখন নিশ^াস নিই ঠাকুরদার বুকটাও ফুলে ওঠে।
আজ বিজয় দিবস। স্কুলে ক্লাস নেই। র্যালি হবে। বিজয় র্যালি। মাইকে গান বাজে, এক নদী রক্ত পেরিয়ে... ঠাকুরদিদিকে ভাসিয়ে দেয়া খালের জল লাল হয়ে যায়। আমি দেখি লাল রক্তের উপর ঠাকুরদি ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে। সেই লাল জল হঠাৎ করে সবুজ হয়ে যায়। দেখি সবুজ জলের উপর ভাসছে দিদি। সবুজ স্কুল ড্রেসে আমাদের র্যালির লম্বা লাইন জলের মত ঢেউ খেলে হাঁটে। আমাদের র্যালি স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে সড়কে চলে আসে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের গান গাই, বিজয়ের স্লোগান দিই। আমাদের র্যালি গমগম আওয়াজ নিয়ে ছুটে চলে, খালে যেন ঢল নেমেছে। সেই ঢলে আমিও চলতে থাকি। আমার শহীদ ঠাকুরদাকে মনে পড়ে, বাংলাদেশ নাম মুখে নিতে নিতে যার শেষ নিশ্বাস পড়েছিল এই মাটিতে। সেই মাটির দিকে তাকাই, বিজয়ের গান গাই।
র্যালি স্কুল কম্পাউন্ডে ফিরে আসে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন স্কুল শিক্ষকরা। বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে পেতাম পুরস্কার। গমগম স্কুল মাঠ। উৎসবের আমেজ। সেই উৎসবের কোলাহলে আমি কেমন উদাস হয়ে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো আমাকে আরো উদাস করে দিত। কখনোই আমার ঠাকুরদার এই আত্মত্যাগকে মন থেকে মুছতে পারতাম না। বিজয়ের আনন্দ উৎসব অন্যরকম বেদনায় মোড়া থাকতো।
বঙ্গবন্ধুর বজ্র কন্ঠ, ঠাকুরদার রক্ত আর ঠাকুরদিদির চোখের জল আমাকে বন্দি করে রাখে। দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী একটি শব্দও আজ সহ্য করতে পারি না। কিন্তু শুনতাম স্বাধীনতা বিরোধী কিছু মানুষ তখনো বাংলাদেশের জল হাওয়ায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের রাজনীতি অনেক অন্ধকার গলি ধরে হেঁটে আজকের এই দিনে এসেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জন নেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা বিরোধী সেসব মানুষদের বিচারের আওতায় এনে মৃত্যু দ- কার্যকর করেছেন। কলঙ্ক মুক্ত করেছেন জাতিকে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাই আগামীর বাংলাদেশে। সেই চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাবার মধ্যেই নিহিত আছো লাখো শহীদের আত্মার শান্তি। যাঁর এই বাংলাদেশ নামের ভূখ-ের জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন করেছিলেন। তাঁদের বিসর্জনের ফল স্বরূপ আজকের মাতৃভূমি। সেই মাতৃভূমির জন্য আমরা জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত থাকবো এই প্রতিজ্ঞা করা উচিত সকল কিশোর ও যুবকদের। কারণ তাদের হাতেই রইলো ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে শহীদের রক্তস্নাত এই মাটি বা দেশের ভার। বিজয় দিবস অনেক আনন্দের উদযাপন, অনেক ত্যাগের উদযাপন। আমাদের এই আনন্দ ও ত্যাগের মহিমা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে যাবো ভবিষ্যত উন্নত বাংলাদেশের দিকে, যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন থাকবে না, সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা থাকবে সবার, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে সব ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হতে উন্নত দেশের দিকে যাত্রা করেছি। সেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার হাতে। দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগও আমরা নষ্ট করবো না এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা উচিত আজকের বিজয় উৎসবে।শহীদদের রক্তের ঋণ হয়তো রক্ত দিয়ে শোধ করতে পারবো না। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে শ্রমে-ঘামে দেশের জন্য কাজ করে গেলেই শহীদদের এ মহৎ আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে পারবো।
আমাদের শৈশবে বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। আমাদের কৈশোর নব্বই দশকে গণতান্ত্রিক সময়ে। তখনো বুঝি না স্বৈরশাসন কী বা গণতন্ত্রই বা কী। হয়তো সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে মাত্র গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছি। তাও পরীক্ষায় পাশের জন্য কিছু মুখস্থ বুলি ছাড়া কিছুই নয়। স্কুলের এত্ত এত্ত বই আর পড়াশোনা শুধু পরীক্ষা পাসের জন্যই ভেবেছি পুরো স্কুল জীবনে। এখন এসে মনে হয় স্কুলের পাঠ যে শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নয় এই সত্যটি উপলব্ধি করাতে আমাদের শিক্ষকরা ব্যর্থ ছিলেন।
দাওয়া হতে রোদ নেমে গেছে উঠোনে। শিমুল তুলো গাছের ফাঁকে রোদের রেখাগুলো উঠোন জুড়ে আলোর ফুলে সাজিয়ে দিয়েছে। রোদের আঁচের আশায় আমরাও বসার মাদুরসমেত নেমে যেতাম উঠোনে। ততক্ষণে স্কুল কম্পাউন্ড হতে একটি বজ্রকন্ঠ ভেসে আসতো। গা শিউরে উঠা সব কথা। সেই ভাষণ থেকে একটা শব্দ কানে লাগতো খুব। সংগ্রাম। মা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতো। সংগ্রামের কথা। স্বাধীনতার কথা। পাকিস্তান আমলের শাসন ও শোষনের কথা। পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কথা। আমরা ছিলাম পরাধীন। আজ আমরা পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত যে সংগ্রামের মাধ্যমে এটাই সেই সংগ্রাম। স্কুলে লাগানো মাইকে সেই সংগ্রামের আহবান ভেসে আসছে। যিনি আহবান করছেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর কণ্ঠ কিশোর শরীরে প্রবাহিত রক্তে কেমন ঢেউ খেলে যায়।
ঠাকুরদিদি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতো দুচোখে টলমল জল নিয়ে। বলতো আমি মরে গেলে আমাকে পুড়িও না, কবরও দিও না। আমরা অবাক হতাম, বিস্মিত হয়ে জানতে চাইতাম, মরে গেলে তোমাকে কী করবে ঠাকুরদি? দিদি ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিতেন, আমাকে বাড়ির সামনে বয়ে যাওয়া খালে ভাসিয়ে দিও। আমি ভেসে ভেসে তোদের ঠাকুরদার কাছে চলে যাবো। তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতো ঠাকুরদা কোথায় থাকেন। বাড়ির সামনে বয়ে যাওয়া খালটাই বা কোথায় গেছে। মাঝে মাঝে খালের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে খালের সমাপ্তি খুঁজতাম। ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। শীতকালে খালটি শুকিয়ে যায়। এখানে সেখানে টুকটাক পানি জমে থাকতো। আমরা সেই পানি সেঁচে মাছ ধরতাম। ঠাকুরদিদিকে বলতাম তুমি শীতকালে মারা যেও না। শীতকালে তোমাকে ভাসানোর মত পানি খালে থাকবে না। কোন বর্ষায় তুমি মরে গেলে ভালো করে ভাসিয়ে দিতে পারবো। ভাসতে ভাসতে ঠাকুরদার কাছে চলে যেতে পারবে। আচ্ছা ঠাকুরদা কি কখনো ফিরবে না? ঠাকুরদা খাল বেয়ে কোথায় চলে গেছে? সাগরে? সাগরে কেন গেছে?
এত এত প্রশ্নের ফাঁকে ঠাকুরদিদির চোখ দিয়ে আরো কিছু জল ঝরে যেত। ঠাকুরদার গল্প বলতো চোখ মুছতে মুছতে। এ গল্প ঠাকুরমার ঝুলি থেকে নেয়া রূপকথা নয় বরং ঠাকুরদার বাস্তব গল্প। যে গল্পে মিশে আছে রক্তের ¯্রােত ও আগুনের লেলিহান শিখা।
ঠাকুরদা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতেন। বিষয়টি রাজাকাররা যেদিন জেনে গেল সেদিন রাতে পুড়ে দেয়া হল বাড়ি। চোখের সামনেই ছারখার হয়ে যেতো দেখলো ঠাকুরদিদির গোছানো সংসার। সেই আগুনের মরণ থাবা হতে বাবাদের বাঁচিয়ে ঠাকুরদি পালিয়ে গেল বনে বাদাড়ে। সেদিন থেকে ঠাকুরদার খোঁজ পায় না দিদি। পরে একদিন শুনলো ঠাকুরদাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আরেকদিন শুনলো ঠাকুরদাকে জবাই করে দিয়েছে রাজাকাররা।
ঠাকুরদিদি এসব বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন ভোরে পূর্ব দিগন্তে রক্তাভ সূর্য উঠছিল। চারদিকে খবর ছড়িয়ে গেছে, বিজয় আসন্ন। ঠিক তখনই ঠাকুরদিদিকে বিশ্বাস করতে হলো ঠাকুরদা আর নেই।
ঠাকুরদার সাথে আরো দুজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। সে দুজন লোকের সাথে দেখা হলো ঠাকুরদিদির। তারা বললেন, জীবন বাঁচানোর জন্য একবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে কী হয়? সে বলবেই না। আমরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে ফিরে এসেছি রাজাকারদের হাত থেকে। আমাদের গাছের ডালে মাথা নিচের দিকে দিয়ে উপরে পা বেঁধে রেখেছিল। সবাইকে বাঁচার শেষ সুযোগ হিসেবে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলেছিল। সে কি না বললো, ‘আমি মরে গেলেও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবো না। আমি স্বাধীন বাংলাদেশ হয়তো দেখবো না কিন্তু আমার নাতি পুতি একদিন ঠিকই দেখবে।’যখন তাকে জবাই করছিল তখনও সে বলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ।
ঠাকুরদার গলাকাটা লাশটি খালের পাড়ে জাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। ঠাকুরদিদি আর বাবারা অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেয়েছিল লাশটি। তখন আর লাশের সৎকার করার অবস্থায় ছিল না। সেই খালেই ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল দেহাবশেষ । সাগরের কোন মাছ নিশ্চই ঠাকুরদাকে ছিঁড়ে-ছুঁড়ে খেয়েছে। ঠাকুরদার কলিজা খাওয়া মাছটির সাহস দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এই দেশের জন্য নিজের প্রাণটি বিলিয়ে দিতে। এমন মহৎ মৃত্যু কজনের হয়?
মাইকে ভেসে আসা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ এর ভাষণ আমাকে উলটপালট করে দেয়। আমি স্কুলের দিকে ছুটে যেতে চাই। ততক্ষণে ঠাকুর দিদির দুচোখে শীতে শুকিয়ে যাওয়া খালের মতো জল প্রবাহিত হয়। আমি সেই জলে চেতনার মাছ ধরি। চোখের সামনে ভেসে উঠে ঠাকুরদার গলাকাটা খ-বিখ- লাশ ভাসছে সাগরে। আর দিদি মৃত লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছি খালের জলে। খাল বেয়ে ঠাকুরিদি চলে যাচ্ছে ঠাকুরদার কাছে। দেখি ঠাকুরদা হাতছানি দিয়ে ডাকছে দিদিকে। আমাদের চোখে ঠাকুরদা হয়তো দেখছে স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশের জল হাওয়ায় আমরা যখন নিশ^াস নিই ঠাকুরদার বুকটাও ফুলে ওঠে।
আজ বিজয় দিবস। স্কুলে ক্লাস নেই। র্যালি হবে। বিজয় র্যালি। মাইকে গান বাজে, এক নদী রক্ত পেরিয়ে... ঠাকুরদিদিকে ভাসিয়ে দেয়া খালের জল লাল হয়ে যায়। আমি দেখি লাল রক্তের উপর ঠাকুরদি ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে। সেই লাল জল হঠাৎ করে সবুজ হয়ে যায়। দেখি সবুজ জলের উপর ভাসছে দিদি। সবুজ স্কুল ড্রেসে আমাদের র্যালির লম্বা লাইন জলের মত ঢেউ খেলে হাঁটে। আমাদের র্যালি স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে সড়কে চলে আসে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের গান গাই, বিজয়ের স্লোগান দিই। আমাদের র্যালি গমগম আওয়াজ নিয়ে ছুটে চলে, খালে যেন ঢল নেমেছে। সেই ঢলে আমিও চলতে থাকি। আমার শহীদ ঠাকুরদাকে মনে পড়ে, বাংলাদেশ নাম মুখে নিতে নিতে যার শেষ নিশ্বাস পড়েছিল এই মাটিতে। সেই মাটির দিকে তাকাই, বিজয়ের গান গাই।
র্যালি স্কুল কম্পাউন্ডে ফিরে আসে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন স্কুল শিক্ষকরা। বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে পেতাম পুরস্কার। গমগম স্কুল মাঠ। উৎসবের আমেজ। সেই উৎসবের কোলাহলে আমি কেমন উদাস হয়ে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো আমাকে আরো উদাস করে দিত। কখনোই আমার ঠাকুরদার এই আত্মত্যাগকে মন থেকে মুছতে পারতাম না। বিজয়ের আনন্দ উৎসব অন্যরকম বেদনায় মোড়া থাকতো।
বঙ্গবন্ধুর বজ্র কন্ঠ, ঠাকুরদার রক্ত আর ঠাকুরদিদির চোখের জল আমাকে বন্দি করে রাখে। দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী একটি শব্দও আজ সহ্য করতে পারি না। কিন্তু শুনতাম স্বাধীনতা বিরোধী কিছু মানুষ তখনো বাংলাদেশের জল হাওয়ায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের রাজনীতি অনেক অন্ধকার গলি ধরে হেঁটে আজকের এই দিনে এসেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জন নেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা বিরোধী সেসব মানুষদের বিচারের আওতায় এনে মৃত্যু দ- কার্যকর করেছেন। কলঙ্ক মুক্ত করেছেন জাতিকে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাই আগামীর বাংলাদেশে। সেই চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাবার মধ্যেই নিহিত আছো লাখো শহীদের আত্মার শান্তি। যাঁর এই বাংলাদেশ নামের ভূখ-ের জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন করেছিলেন। তাঁদের বিসর্জনের ফল স্বরূপ আজকের মাতৃভূমি। সেই মাতৃভূমির জন্য আমরা জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত থাকবো এই প্রতিজ্ঞা করা উচিত সকল কিশোর ও যুবকদের। কারণ তাদের হাতেই রইলো ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে শহীদের রক্তস্নাত এই মাটি বা দেশের ভার। বিজয় দিবস অনেক আনন্দের উদযাপন, অনেক ত্যাগের উদযাপন। আমাদের এই আনন্দ ও ত্যাগের মহিমা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে যাবো ভবিষ্যত উন্নত বাংলাদেশের দিকে, যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন থাকবে না, সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা থাকবে সবার, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে সব ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হতে উন্নত দেশের দিকে যাত্রা করেছি। সেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার হাতে। দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগও আমরা নষ্ট করবো না এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা উচিত আজকের বিজয় উৎসবে।শহীদদের রক্তের ঋণ হয়তো রক্ত দিয়ে শোধ করতে পারবো না। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে শ্রমে-ঘামে দেশের জন্য কাজ করে গেলেই শহীদদের এ মহৎ আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে পারবো।