http://www.thereport24.com/article/87027/index.html
অনুপম চৌধুরী
কবি ও পাঠকের চোখ সম্পূর্ণ আলাদা। কবির ধ্যানের অন্তর্দৃষ্টি ও পাঠকের দৃষ্টিতে রয়েছে বিশাল ফারাক, আর কবির বিনির্মাণ বরাবরের মতো সুনিপুণ হাতের সুচারু শিল্প; আবার মাঝে মাঝে হালকা কিংবা নিজের কাছে মনে হয় কিচ্ছু হয়নি। তারপরও কখনো-সখনো হয়ে ওঠে কালোর্ত্তীণ কবিতা। কিন্তু কোন কবিতা কখন পাঠক হৃদয় ছুঁবে তা সময়ই বলে দিবে। কবি লিখে যান যখন-তখন; প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্ব বসবাসের জায়গা। নিজস্ব মানস রেখায় কবি লিখেন কবিতা আর চিরায়ত সেই চেনা জায়গা থেকেই কবিকে তুলে আনা যায় অবলীলায়। এবং কবির দেখানো পথে হেঁটেই পাওয়া যায় কবিকে। পাঠক চোখ ও কবির চোখে ভিন্নতা থাকলেও সেরা মূল্যায়নটি হয় পাঠক চোখে। পাঠকই বলে দিবে কোন কবিতা কতদূর হাঁটবে বা হাঁটার পরিধিটা কিরূপ? কবি বলে যান নিজস্ব ঘোরের কিছু অমিয় বাণী আর পাঠক তার কাছাকাছি বা আবছা আলোয় ঘুরে আসে সেই দেখানো পথে।
কবি শেখর দেব চট্টগ্রাম তরুণ কবিদের এক উজ্জ্বল নাম, তরুণ কবি মহলের প্রথম শ্রেণীর কাব্য প্রতিনিধি। দীর্ঘ এক যুগের লেখনীর ফসল হিসেবে ‘পাঠসূত্র প্রকাশন’ প্রকাশ করেছে কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘প্রত্মচর্চার পাঠশালা’। নামের সাথে কবিতার বিষয় আঙ্গিকে রয়েছে বেশ মিল। পুরনো ঐতিহ্যের ঘ্রাণ নিয়ে কবি এবং আমাদের পথচলা; তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ছুটছি লালিত স্বপ্নের অমোঘ বীজে। কবির কবিতা নিয়ে উত্তর আধুনিকতার পুরোধা কবি ও সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী বলেছেন- ‘শেখর দেব নতুন শতক শুরুর কাব্য-প্রতিনিধি। বর্জ্য আধুনিক বাংলা কবিতার বিপরীতে নতুন স্বরায়ন ও কথন-ভাষ্য বিনির্মাণের কালে তার আবির্ভাব। অধুনা উত্তর সময়ে পরিবর্তন প্রবণতার সন্দর্ভ যখন চলমান তখন ভিন্ন এক নান্দনিক কাব্য-প্রয়াস নিয়ে হাজির হয়েছেন কবি শেখর দেব, তাই তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায় লোকায়ত-ভাষ্য তৈরির নিরীক্ষা-প্রবণতা। আধুনিকোত্তর সময়ের পর্বান্তরের সবগুলো পরিভাষা সে রপ্ত করেছে অন্তরে।’ তিনি আরও বলেন, “এ দেশের জল-হাওয়া ও মাটি-মানুষের দেশাত্মবোধের পজিটিভ ধারণাটিও কবি বুঝতে পেরেছেন। পুরাণ কিংবা প্রত্মস্মৃতিও জাগরূক হয়। ‘শ্মশান রাতে চণ্ডালের হাতে নিথর শরীর সঁপে শিশির সিক্ত ঘাসে’ শুয়ে কবি আবিষ্কার করেন উন্নাসিক কোলাহলে নিউরনের নিগূঢ় মরীচিকা। এই সব জীবনের নানা রসায়নে জারিত হয় তার কাব্যশরীর।”
কবি আমাদের ঐতিহ্যের সেই বুননকে তুলে আনতে সদা তৎপর। কবির বানানো ক্যানভাস এতোটাই মসৃণ যে, সেই মসৃণতার শিশির সিক্ত ঘাসে অনায়াসেই হাঁটা যাবে বহুক্রোশ পথ। যা আমাদের চিরচেনা পেলবতার এক অসীম রাস্তা। কবির প্রথম কবিতা ‘লাখবাতি’; কবি লিখেছেন-
কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল
ডাকে ধানের গোলায়। পরিপাটি ধুতির ভাঁজ; জ্বলে হাসি
সুখের বাতি। রঙিন আঁচলে দেখা দীঘির দীঘল ঘাট সব জানে।
তৎকালীন সমাজের এক লাখের বেশি টাকা থাকলে, সেই টাকার পাহারাদার হিসেবে একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বোলিত রাখা হতো। আর সেই প্রদীপকেই বলা হতো লাখবাতি। এই চিরায়ত সুক্ষ্ম বিষয়কে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর চাহনীর বদৌলতে, আর এখানে উঠে এসেছে অন্নপূর্ণার কথা এবং চিরচেনা ধানের গোলার কথা। পরিহিত পোশাকে ধুতির বর্ণনা যা এখন নেই বললেই চলে। এখানেই কবি খুব সার্থক। তখনকার সমাজের যে সুন্দর কথন তা কিন্তু সত্যি মনোমুগ্ধকর। হয়ত কোন এক সময় তা কালের স্মৃতি স্মারক হিসেবে থেকে যাবে অনন্তকাল। কবি ‘ফুল-পুরাণ’ কবিতায় বলেছেন-
তেমাথার মোড়ে
অপদেবতার পুজো দিয়েছি কলাপাতাভাতে
দেখা হয়নি তেমন
আবেগে
জমে ওঠা আনাড়ি ঘ্রাণে।
এই কবিতায় আরেকটি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে, গ্রামে এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায় এই দৃশ্যের। তিন রাস্তার মোড়ে কলাপাতায় ফুল সমেত রেখে আসা হয় অপদেবতার ভাত। যদি ভাতে কারো অরুচি ধরে তখন সেই সমস্যা উত্তরণের জন্য এখনো প্রচলিত এই প্রথা। আবহমান বাংলার যে দৃশ্যপট তা কবির লেন্সে ধরা পড়েছে নিগুঢ় ভাবে। আরও যদি বলি ‘রাহুশনিময়’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন গ্রহ আর নক্ষত্ররা কিভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। মানুষের সাথে গ্রহের যে সংমিশ্রণ তারই বর্ণনায় এসেছে এই কবিতায়। সাথে পরিবার পরিজন ও মায়ের যে আকুতি তাও বেশ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবং জোড়া কবুতর দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা তাও ফুটেছে এই কবিতায়; কবি আরও দেখিয়েছেন প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ ভিক্ষার সুন্দর ক্যানভাস যা কবি বলেই সম্ভব। কবি বলেছেন-
সেদিন মশার পিঠে চড়ে এলো রাহু
শনিসমেত শুরু হলো তাণ্ডব
মা কালি তার লকলকে জিবে চেটে নিবে সব...
সেদিন জোড়া কবুতরের বিনিময়ে
মা ভিক্ষে নিয়ে এলো নতুন জীবন।
কবি এখানে জীবনের এক কঠিন সত্য উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনকে খুঁজেছেন জটিল সমীকরণে। সে কারণেই কবি বলেছেন-
অদৃশ্য শূন্যতায় চলে রাহুশনিময় সংসার
এসব বুঝি না আমি সাংসারিক কারবার।
কবির পড়ালেখা শহরে হলেও বেড়ে ওঠা কিন্তু গ্রামে; সে কারণে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতিপাঠ শিখেছে নিগুঢ়ভাবে, ছোট বেলার ডানপিটে বালকদের ভূমিকায় মাছরাঙার পুকুর আলিঙ্গন, উঁকি যুঁকি দিয়ে বাড়ন্ত কিশোরীর সৌন্দর্য উপভোগ এবং স্কুলের ভালটি সাজা, সবই তুলে এনেছেন- ‘অনন্ত অংশিদার’ কবিতায়। কবি বলেছেন-
প্রকৃতি-পাঠের শান বাঁধানো ঘাট
মাছরাঙার সুচতুর চোখে সুদৃশ্য পুকুরের ভালোবাসা
মৃদু হাওয়ায় নাচে গহীন প্রাণের জল
স্নানরত সদ্য বাড়ন্ত বালিকার
শিরার শিহরণ দেখতে দেখতে ইস্কুলে হতো দেরি।
গ্রামীণ যে অবয়বের চিত্র এবং ডানপিটে বালকের হাতে ছুটোছুটির যে রুটিন তাও কিন্তু দারুণ ভাবে ওঠে এসেছে। এবং সাতচাড়া খেলার বর্ণনাও পাওয়া যায় এই কবিতায় যা শহুরে জীবনের কিশোর-কিশোরীর স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। কবি জীবনকে অনেক গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনের তত্ত্বও খুঁজেছেন গভীর চিত্তে, তাইতো কবি পৃথিবীকে এক টুকরো কাঁচা আমের সাথে তুলনা করেছেন; তিনি বলেছেন— ‘পৃথিবীটা এক টুকরো বোশেখের কাঁচা আম।’
‘মা-মাটির দলিল’ কবিতায় কবি, কবির বেড়ে ওঠার গান গেয়েছেন; সাথে নিজের ভিটেমাটির গল্প এবং বংশ পরম্পরার দারুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। গোশালার গরু, টুনটুনির লেজ নাড়া, গো-বাছুরের গলায় গলা জড়ানো, পুকুরের মাছ এবং নিজেদের আপনজনকে তুলনা করেছেন বেঙমা-বেঙমীর সাথে। এবং নিজের জন্মের ইতিহাসও তুলে এনেছেন কলমের জাদুকরি মুগ্ধতায়। মোটকথা দুরন্ত শৈশবের দারুণ চিত্র এনেছেন এই কবিতায়। বাবা-মা ও ঠাকুরদিদিকে নিয়েও লিখেছেন আলাদা কবিতা। ‘শাঁখের শাঁখা’ কবিতায় কবি বলেছেন-
শাঁখের নিনাদে ঘুম ভাঙা রাতের আছে অসমাপ্ত স্বপ্ন
ললাটের বলিরেখায় যা হারিয়ে গেছে নীরবে
তার কোন কিছুই পাবে না প্রত্মচর্চার পাঠশালায়।
শাঁখা হলো হিন্দু রমণীদের বিয়ের চিহ্ন, যা তৈরি হয় শাঁখ থেকে; শাঁখ আবার হিন্দুধর্মীয় পুজোতেও বাজানো হয়। ওই শাঁখ থেকেই তৈরি হয় শাঁখা। শামুকের মৃত রূপ হলো শাঁখ। কবি বারে বারে ফিরে গেছেন আমাদের অতীতের চিরচেনা ক্যানভাসে যার শৈল্পিক আঁচড়ে ফুটেছে নিদারুণ চিত্রপট। কবির এই ঐশী শক্তিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। মায়ের আঁচলে বাঁধা যেই টান সেই স্নেহের পরশের মতোই কবির শব্দবুনন। এবং মা-ছেলের স্নেহের যে ধারা তাও তুলে এনেছেন অত্যন্ত সুচারু রূপে। দেশমাতৃকার জন্য লিখেছেন সার্চলাইট ও গণজাগরণের প্রতীক হিসেবে লিখেছেন ‘প্রজন্মবোধ’ কবিতা।
যে আলো মৃত্যু খোঁজে
যে আলো পথ দেখায়
সে আলোয় বাংলা আধাঁর
বীভৎস মুখোশ পুড়িয়ে
সুন্দর সবুজ উপহার এনেছো
চলো পা ছুঁয়ে সোঁদা গন্ধে
বিভোর কোন স্বপ্ন সোপানে।
কতোটা মৃত্যুর পরিবর্তে দেখা মেলবে আলোর পথের। সময়ের সাহসী বুননের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তারই চিরায়ত গাঁথার অবিরল ফসল আজকের স্বাধীনতা। যার পদতলে সদা জ্বলজ্বলে আমাদের অহংকার ও আমাদের ঐতিহ্য। প্রেমের কবিতার কথা না বললেই নয়, প্রিয়ার চোখে যে প্রেমের ভাষা, গোলাপ, রজনীর প্রেম মাল্য গলায় না পরালে লিখাটা সর্ম্পূণ হবে না আর শিরি-ফাহাদকেও হার মানাবে এই অমর প্রেম। এ প্রেমের কবিতায়- ম্যাসেজ, ত্রিভুজ, সখাহীন সুখ, নূপুর ও বৃষ্টি, মোহনদেবী, বাঁশিওয়ালা, জলপরী, চুমুগন্ধীহাওয়া, ফুলেশ্বরী, ছুঁড়ে দেয়া সুখ, কামচন্দ্রিমা অন্যতম। কবি ‘নূপুর ও বৃষ্টি’ কবিতায় বলেছেন-
নূপুর-ছন্দের বৃষ্টিতে ভিজে যেতে যেতে
নূপুর ফিরিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলেছিলঃ
রিনিঝিনি রিনিঝিনি শব্দে ঝরে যাবো
যদি বুকের নদী করে রাখো ছলছল।
একজন প্রিয়াকে কতটুকু ভালোবাসলে এমন পঙতি বের হয়, নূপুর এর সাথে বৃষ্টির যে মিশ্রণ তারই কথন ফুটেছে এই কবিতায়। নূপুর আর বৃষ্টির আওয়াজ প্রায় একই তার পরেরটা কবিই ভালো জানে। ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি বলেছেন- ‘জয়ানন্দ বোঝেনি চন্দ্রাবতীর অমায়িক ফুল। ফুলের স্নিগ্ধতার ভেতর বয়ে গেছে ফুলেশ্বরী’। প্রেমের ক্ষেত্রের এমন কানামাছি খেলা প্রায় থাকে, সামান্য খুনসুটি না থাকলে প্রেমের যে মজা তাও মেলে না কপালে; তাই ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি প্রিয়ার কাছে আসলে চারপাশ যে স্নিগ্ধতায় ভরে যায় তারই গান গেয়েছেন। কবি আরও বলেছেন, নিয়ত ‘এক চঞ্চল পাখি ওড়ে সমস্ত আবেগের ভেতর। কাছে এলে ফুল ফোটে চারপাশ, গন্ধে গন্ধে লাগে মৌতাত।’ কবির এই সুনিপুণ হাতের বর্ণনা সত্যি চমকপ্রদ। ‘মেধসমুনি’ ও ‘সীতাকুণ্ড বিহার’ হলো সমগ্র উপমহাদেশের পবিত্র স্থান, যার আশ্রয়ে ছুটে আসে দূর-দূরান্তের অনেক তীর্থযাত্রী।
কবি সেই দু’স্থানকে শিরোনাম করে লিখেছেন দুটি কবিতা। প্রেমের মহীমায় সীতাকুণ্ডকে রাঙিয়ে দিয়েছেন রঙধনু আবিরে।
‘কন্ট্রাডিকশান’ কবিতায় কবি পাঠককে একটা ঘোরের আবহে রাখতে চেয়েছেন, যার দৃশ্যাবলীর রমরমা চিন্তনে খানিক চেতন হারাবেন পাঠককূল। কবি বলেছেন-
আমি থ্রি-পিচ মোড়ানো কবিতাটির প্রতি
কলেবরের শব্দ-বিন্যাসে ওড়নার ভাঁজে
গোপন ঘোরে নাচায় পঙক্তিতে পঙক্তিতে।
কবি পাঠককে ধাঁধার মধ্যে রেখে একটা আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন আর কবি তাতেও সফল। বর্তমান সমাজের কর্পোরেট বাণিজ্যের কথা না বললেই নয়। এই আজব নগরের প্রতিটি ইট মানুষ খেকো, আর এই ইটের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে কতো স্বপ্নের বলি হচ্ছে তা আমাদের অজানা। কবির রিক্তরথ কবিতাটি কর্পোরেট বাণিজ্যের করাল ছাঁচের চিত্র। যেখানে গ্রামের সবুজ আঁচল ফেলে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে এ সব সুন্দরের বলি হচ্ছে নগর ইটে; কিন্তু এই বলি হওয়া স্বপ্নের উদ্ধারের কোন পথ আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই এ সব স্বপ্নরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় আর যা দেখে তাও ভুল চোখে দেখে। একদিন এ সব স্বপ্ন কালের স্রোতে হারিয়ে যায়, তাই কবি বলেছেন-
সময়ের তুমুল-তাগিদ
স্বপ্নাদের দৌড়ায় নগর করাল ছাঁচে
ঝিল-বিকেল ভুলে
কংসের আসর জমে ওঠে বেশ, রমরমা
মথুরা পথে আসে না কোন কৃষ্ণ রথ!
‘মুগ্ধ মৌনতা’ কবিতায় কবি কবির ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার যে চিত্র তাই তুলে ধরেছেন। এই কবিতাটি হলো দীর্ঘ কবিতা ও শেষ কবিতা। প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় শীত নামে শহরে, সবুজের সুরভী, ঘুম ভাঙ্গে কমলাপুরে, বেশ লিখেছেন। কবির চিন্তনের সীমারেখা বেশ সুন্দর ও সাবলীল যার রেশে হেঁটে পার করা যায় অনেক সময়। এবং আমাদের গ্রামীণ আবহের সুন্দর সুন্দর সব চিত্র কলমের ছোঁয়ায় ফুটেছে দারুণভাবে। তাই একটা ফেলে একটা আলাদা করা বেশ দুরুহ ও জটিল। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন- মোবাশ্বির আলম মজুমদার।
মেদহীন ঝুরঝুরে কবিতা শরীরে যে কোন পোশাকেই মানায়, কবি শেখর দেব অনেক যত্নে গড়েছেন এমন সব কবিতার শরীর। তাই সময়ে অসময়ে কবিতার গায়ে পরানো যাচ্ছে সুন্দর সুন্দর সব পোশাক আর অলংকার। যাতে লোভ সামলানো অনেকটাই কঠিন। কবির দীর্ঘজীবন কামনা করে কবির জন্য রইল অফুরান ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।
প্রত্মচর্চার পাঠশালা। শেখর দেব। প্রকাশক : পাঠসূত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৪। প্রচ্ছদ : মোবাশ্বির আলম মজুমদার।
২০১৫ ফেব্রুয়ারি ০৯ ১৬:০২:৫৩
কবি ও পাঠকের চোখ সম্পূর্ণ আলাদা। কবির ধ্যানের অন্তর্দৃষ্টি ও পাঠকের দৃষ্টিতে রয়েছে বিশাল ফারাক, আর কবির বিনির্মাণ বরাবরের মতো সুনিপুণ হাতের সুচারু শিল্প; আবার মাঝে মাঝে হালকা কিংবা নিজের কাছে মনে হয় কিচ্ছু হয়নি। তারপরও কখনো-সখনো হয়ে ওঠে কালোর্ত্তীণ কবিতা। কিন্তু কোন কবিতা কখন পাঠক হৃদয় ছুঁবে তা সময়ই বলে দিবে। কবি লিখে যান যখন-তখন; প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্ব বসবাসের জায়গা। নিজস্ব মানস রেখায় কবি লিখেন কবিতা আর চিরায়ত সেই চেনা জায়গা থেকেই কবিকে তুলে আনা যায় অবলীলায়। এবং কবির দেখানো পথে হেঁটেই পাওয়া যায় কবিকে। পাঠক চোখ ও কবির চোখে ভিন্নতা থাকলেও সেরা মূল্যায়নটি হয় পাঠক চোখে। পাঠকই বলে দিবে কোন কবিতা কতদূর হাঁটবে বা হাঁটার পরিধিটা কিরূপ? কবি বলে যান নিজস্ব ঘোরের কিছু অমিয় বাণী আর পাঠক তার কাছাকাছি বা আবছা আলোয় ঘুরে আসে সেই দেখানো পথে।
কবি শেখর দেব চট্টগ্রাম তরুণ কবিদের এক উজ্জ্বল নাম, তরুণ কবি মহলের প্রথম শ্রেণীর কাব্য প্রতিনিধি। দীর্ঘ এক যুগের লেখনীর ফসল হিসেবে ‘পাঠসূত্র প্রকাশন’ প্রকাশ করেছে কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘প্রত্মচর্চার পাঠশালা’। নামের সাথে কবিতার বিষয় আঙ্গিকে রয়েছে বেশ মিল। পুরনো ঐতিহ্যের ঘ্রাণ নিয়ে কবি এবং আমাদের পথচলা; তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ছুটছি লালিত স্বপ্নের অমোঘ বীজে। কবির কবিতা নিয়ে উত্তর আধুনিকতার পুরোধা কবি ও সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী বলেছেন- ‘শেখর দেব নতুন শতক শুরুর কাব্য-প্রতিনিধি। বর্জ্য আধুনিক বাংলা কবিতার বিপরীতে নতুন স্বরায়ন ও কথন-ভাষ্য বিনির্মাণের কালে তার আবির্ভাব। অধুনা উত্তর সময়ে পরিবর্তন প্রবণতার সন্দর্ভ যখন চলমান তখন ভিন্ন এক নান্দনিক কাব্য-প্রয়াস নিয়ে হাজির হয়েছেন কবি শেখর দেব, তাই তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায় লোকায়ত-ভাষ্য তৈরির নিরীক্ষা-প্রবণতা। আধুনিকোত্তর সময়ের পর্বান্তরের সবগুলো পরিভাষা সে রপ্ত করেছে অন্তরে।’ তিনি আরও বলেন, “এ দেশের জল-হাওয়া ও মাটি-মানুষের দেশাত্মবোধের পজিটিভ ধারণাটিও কবি বুঝতে পেরেছেন। পুরাণ কিংবা প্রত্মস্মৃতিও জাগরূক হয়। ‘শ্মশান রাতে চণ্ডালের হাতে নিথর শরীর সঁপে শিশির সিক্ত ঘাসে’ শুয়ে কবি আবিষ্কার করেন উন্নাসিক কোলাহলে নিউরনের নিগূঢ় মরীচিকা। এই সব জীবনের নানা রসায়নে জারিত হয় তার কাব্যশরীর।”
কবি আমাদের ঐতিহ্যের সেই বুননকে তুলে আনতে সদা তৎপর। কবির বানানো ক্যানভাস এতোটাই মসৃণ যে, সেই মসৃণতার শিশির সিক্ত ঘাসে অনায়াসেই হাঁটা যাবে বহুক্রোশ পথ। যা আমাদের চিরচেনা পেলবতার এক অসীম রাস্তা। কবির প্রথম কবিতা ‘লাখবাতি’; কবি লিখেছেন-
কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল
ডাকে ধানের গোলায়। পরিপাটি ধুতির ভাঁজ; জ্বলে হাসি
সুখের বাতি। রঙিন আঁচলে দেখা দীঘির দীঘল ঘাট সব জানে।
তৎকালীন সমাজের এক লাখের বেশি টাকা থাকলে, সেই টাকার পাহারাদার হিসেবে একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বোলিত রাখা হতো। আর সেই প্রদীপকেই বলা হতো লাখবাতি। এই চিরায়ত সুক্ষ্ম বিষয়কে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর চাহনীর বদৌলতে, আর এখানে উঠে এসেছে অন্নপূর্ণার কথা এবং চিরচেনা ধানের গোলার কথা। পরিহিত পোশাকে ধুতির বর্ণনা যা এখন নেই বললেই চলে। এখানেই কবি খুব সার্থক। তখনকার সমাজের যে সুন্দর কথন তা কিন্তু সত্যি মনোমুগ্ধকর। হয়ত কোন এক সময় তা কালের স্মৃতি স্মারক হিসেবে থেকে যাবে অনন্তকাল। কবি ‘ফুল-পুরাণ’ কবিতায় বলেছেন-
তেমাথার মোড়ে
অপদেবতার পুজো দিয়েছি কলাপাতাভাতে
দেখা হয়নি তেমন
আবেগে
জমে ওঠা আনাড়ি ঘ্রাণে।
এই কবিতায় আরেকটি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে, গ্রামে এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায় এই দৃশ্যের। তিন রাস্তার মোড়ে কলাপাতায় ফুল সমেত রেখে আসা হয় অপদেবতার ভাত। যদি ভাতে কারো অরুচি ধরে তখন সেই সমস্যা উত্তরণের জন্য এখনো প্রচলিত এই প্রথা। আবহমান বাংলার যে দৃশ্যপট তা কবির লেন্সে ধরা পড়েছে নিগুঢ় ভাবে। আরও যদি বলি ‘রাহুশনিময়’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন গ্রহ আর নক্ষত্ররা কিভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। মানুষের সাথে গ্রহের যে সংমিশ্রণ তারই বর্ণনায় এসেছে এই কবিতায়। সাথে পরিবার পরিজন ও মায়ের যে আকুতি তাও বেশ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবং জোড়া কবুতর দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা তাও ফুটেছে এই কবিতায়; কবি আরও দেখিয়েছেন প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ ভিক্ষার সুন্দর ক্যানভাস যা কবি বলেই সম্ভব। কবি বলেছেন-
সেদিন মশার পিঠে চড়ে এলো রাহু
শনিসমেত শুরু হলো তাণ্ডব
মা কালি তার লকলকে জিবে চেটে নিবে সব...
সেদিন জোড়া কবুতরের বিনিময়ে
মা ভিক্ষে নিয়ে এলো নতুন জীবন।
কবি এখানে জীবনের এক কঠিন সত্য উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনকে খুঁজেছেন জটিল সমীকরণে। সে কারণেই কবি বলেছেন-
অদৃশ্য শূন্যতায় চলে রাহুশনিময় সংসার
এসব বুঝি না আমি সাংসারিক কারবার।
কবির পড়ালেখা শহরে হলেও বেড়ে ওঠা কিন্তু গ্রামে; সে কারণে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতিপাঠ শিখেছে নিগুঢ়ভাবে, ছোট বেলার ডানপিটে বালকদের ভূমিকায় মাছরাঙার পুকুর আলিঙ্গন, উঁকি যুঁকি দিয়ে বাড়ন্ত কিশোরীর সৌন্দর্য উপভোগ এবং স্কুলের ভালটি সাজা, সবই তুলে এনেছেন- ‘অনন্ত অংশিদার’ কবিতায়। কবি বলেছেন-
প্রকৃতি-পাঠের শান বাঁধানো ঘাট
মাছরাঙার সুচতুর চোখে সুদৃশ্য পুকুরের ভালোবাসা
মৃদু হাওয়ায় নাচে গহীন প্রাণের জল
স্নানরত সদ্য বাড়ন্ত বালিকার
শিরার শিহরণ দেখতে দেখতে ইস্কুলে হতো দেরি।
গ্রামীণ যে অবয়বের চিত্র এবং ডানপিটে বালকের হাতে ছুটোছুটির যে রুটিন তাও কিন্তু দারুণ ভাবে ওঠে এসেছে। এবং সাতচাড়া খেলার বর্ণনাও পাওয়া যায় এই কবিতায় যা শহুরে জীবনের কিশোর-কিশোরীর স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। কবি জীবনকে অনেক গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনের তত্ত্বও খুঁজেছেন গভীর চিত্তে, তাইতো কবি পৃথিবীকে এক টুকরো কাঁচা আমের সাথে তুলনা করেছেন; তিনি বলেছেন— ‘পৃথিবীটা এক টুকরো বোশেখের কাঁচা আম।’
‘মা-মাটির দলিল’ কবিতায় কবি, কবির বেড়ে ওঠার গান গেয়েছেন; সাথে নিজের ভিটেমাটির গল্প এবং বংশ পরম্পরার দারুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। গোশালার গরু, টুনটুনির লেজ নাড়া, গো-বাছুরের গলায় গলা জড়ানো, পুকুরের মাছ এবং নিজেদের আপনজনকে তুলনা করেছেন বেঙমা-বেঙমীর সাথে। এবং নিজের জন্মের ইতিহাসও তুলে এনেছেন কলমের জাদুকরি মুগ্ধতায়। মোটকথা দুরন্ত শৈশবের দারুণ চিত্র এনেছেন এই কবিতায়। বাবা-মা ও ঠাকুরদিদিকে নিয়েও লিখেছেন আলাদা কবিতা। ‘শাঁখের শাঁখা’ কবিতায় কবি বলেছেন-
শাঁখের নিনাদে ঘুম ভাঙা রাতের আছে অসমাপ্ত স্বপ্ন
ললাটের বলিরেখায় যা হারিয়ে গেছে নীরবে
তার কোন কিছুই পাবে না প্রত্মচর্চার পাঠশালায়।
শাঁখা হলো হিন্দু রমণীদের বিয়ের চিহ্ন, যা তৈরি হয় শাঁখ থেকে; শাঁখ আবার হিন্দুধর্মীয় পুজোতেও বাজানো হয়। ওই শাঁখ থেকেই তৈরি হয় শাঁখা। শামুকের মৃত রূপ হলো শাঁখ। কবি বারে বারে ফিরে গেছেন আমাদের অতীতের চিরচেনা ক্যানভাসে যার শৈল্পিক আঁচড়ে ফুটেছে নিদারুণ চিত্রপট। কবির এই ঐশী শক্তিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। মায়ের আঁচলে বাঁধা যেই টান সেই স্নেহের পরশের মতোই কবির শব্দবুনন। এবং মা-ছেলের স্নেহের যে ধারা তাও তুলে এনেছেন অত্যন্ত সুচারু রূপে। দেশমাতৃকার জন্য লিখেছেন সার্চলাইট ও গণজাগরণের প্রতীক হিসেবে লিখেছেন ‘প্রজন্মবোধ’ কবিতা।
যে আলো মৃত্যু খোঁজে
যে আলো পথ দেখায়
সে আলোয় বাংলা আধাঁর
বীভৎস মুখোশ পুড়িয়ে
সুন্দর সবুজ উপহার এনেছো
চলো পা ছুঁয়ে সোঁদা গন্ধে
বিভোর কোন স্বপ্ন সোপানে।
কতোটা মৃত্যুর পরিবর্তে দেখা মেলবে আলোর পথের। সময়ের সাহসী বুননের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তারই চিরায়ত গাঁথার অবিরল ফসল আজকের স্বাধীনতা। যার পদতলে সদা জ্বলজ্বলে আমাদের অহংকার ও আমাদের ঐতিহ্য। প্রেমের কবিতার কথা না বললেই নয়, প্রিয়ার চোখে যে প্রেমের ভাষা, গোলাপ, রজনীর প্রেম মাল্য গলায় না পরালে লিখাটা সর্ম্পূণ হবে না আর শিরি-ফাহাদকেও হার মানাবে এই অমর প্রেম। এ প্রেমের কবিতায়- ম্যাসেজ, ত্রিভুজ, সখাহীন সুখ, নূপুর ও বৃষ্টি, মোহনদেবী, বাঁশিওয়ালা, জলপরী, চুমুগন্ধীহাওয়া, ফুলেশ্বরী, ছুঁড়ে দেয়া সুখ, কামচন্দ্রিমা অন্যতম। কবি ‘নূপুর ও বৃষ্টি’ কবিতায় বলেছেন-
নূপুর-ছন্দের বৃষ্টিতে ভিজে যেতে যেতে
নূপুর ফিরিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলেছিলঃ
রিনিঝিনি রিনিঝিনি শব্দে ঝরে যাবো
যদি বুকের নদী করে রাখো ছলছল।
একজন প্রিয়াকে কতটুকু ভালোবাসলে এমন পঙতি বের হয়, নূপুর এর সাথে বৃষ্টির যে মিশ্রণ তারই কথন ফুটেছে এই কবিতায়। নূপুর আর বৃষ্টির আওয়াজ প্রায় একই তার পরেরটা কবিই ভালো জানে। ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি বলেছেন- ‘জয়ানন্দ বোঝেনি চন্দ্রাবতীর অমায়িক ফুল। ফুলের স্নিগ্ধতার ভেতর বয়ে গেছে ফুলেশ্বরী’। প্রেমের ক্ষেত্রের এমন কানামাছি খেলা প্রায় থাকে, সামান্য খুনসুটি না থাকলে প্রেমের যে মজা তাও মেলে না কপালে; তাই ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি প্রিয়ার কাছে আসলে চারপাশ যে স্নিগ্ধতায় ভরে যায় তারই গান গেয়েছেন। কবি আরও বলেছেন, নিয়ত ‘এক চঞ্চল পাখি ওড়ে সমস্ত আবেগের ভেতর। কাছে এলে ফুল ফোটে চারপাশ, গন্ধে গন্ধে লাগে মৌতাত।’ কবির এই সুনিপুণ হাতের বর্ণনা সত্যি চমকপ্রদ। ‘মেধসমুনি’ ও ‘সীতাকুণ্ড বিহার’ হলো সমগ্র উপমহাদেশের পবিত্র স্থান, যার আশ্রয়ে ছুটে আসে দূর-দূরান্তের অনেক তীর্থযাত্রী।
কবি সেই দু’স্থানকে শিরোনাম করে লিখেছেন দুটি কবিতা। প্রেমের মহীমায় সীতাকুণ্ডকে রাঙিয়ে দিয়েছেন রঙধনু আবিরে।
‘কন্ট্রাডিকশান’ কবিতায় কবি পাঠককে একটা ঘোরের আবহে রাখতে চেয়েছেন, যার দৃশ্যাবলীর রমরমা চিন্তনে খানিক চেতন হারাবেন পাঠককূল। কবি বলেছেন-
আমি থ্রি-পিচ মোড়ানো কবিতাটির প্রতি
কলেবরের শব্দ-বিন্যাসে ওড়নার ভাঁজে
গোপন ঘোরে নাচায় পঙক্তিতে পঙক্তিতে।
কবি পাঠককে ধাঁধার মধ্যে রেখে একটা আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন আর কবি তাতেও সফল। বর্তমান সমাজের কর্পোরেট বাণিজ্যের কথা না বললেই নয়। এই আজব নগরের প্রতিটি ইট মানুষ খেকো, আর এই ইটের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে কতো স্বপ্নের বলি হচ্ছে তা আমাদের অজানা। কবির রিক্তরথ কবিতাটি কর্পোরেট বাণিজ্যের করাল ছাঁচের চিত্র। যেখানে গ্রামের সবুজ আঁচল ফেলে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে এ সব সুন্দরের বলি হচ্ছে নগর ইটে; কিন্তু এই বলি হওয়া স্বপ্নের উদ্ধারের কোন পথ আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই এ সব স্বপ্নরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় আর যা দেখে তাও ভুল চোখে দেখে। একদিন এ সব স্বপ্ন কালের স্রোতে হারিয়ে যায়, তাই কবি বলেছেন-
সময়ের তুমুল-তাগিদ
স্বপ্নাদের দৌড়ায় নগর করাল ছাঁচে
ঝিল-বিকেল ভুলে
কংসের আসর জমে ওঠে বেশ, রমরমা
মথুরা পথে আসে না কোন কৃষ্ণ রথ!
‘মুগ্ধ মৌনতা’ কবিতায় কবি কবির ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার যে চিত্র তাই তুলে ধরেছেন। এই কবিতাটি হলো দীর্ঘ কবিতা ও শেষ কবিতা। প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় শীত নামে শহরে, সবুজের সুরভী, ঘুম ভাঙ্গে কমলাপুরে, বেশ লিখেছেন। কবির চিন্তনের সীমারেখা বেশ সুন্দর ও সাবলীল যার রেশে হেঁটে পার করা যায় অনেক সময়। এবং আমাদের গ্রামীণ আবহের সুন্দর সুন্দর সব চিত্র কলমের ছোঁয়ায় ফুটেছে দারুণভাবে। তাই একটা ফেলে একটা আলাদা করা বেশ দুরুহ ও জটিল। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন- মোবাশ্বির আলম মজুমদার।
মেদহীন ঝুরঝুরে কবিতা শরীরে যে কোন পোশাকেই মানায়, কবি শেখর দেব অনেক যত্নে গড়েছেন এমন সব কবিতার শরীর। তাই সময়ে অসময়ে কবিতার গায়ে পরানো যাচ্ছে সুন্দর সুন্দর সব পোশাক আর অলংকার। যাতে লোভ সামলানো অনেকটাই কঠিন। কবির দীর্ঘজীবন কামনা করে কবির জন্য রইল অফুরান ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।
প্রত্মচর্চার পাঠশালা। শেখর দেব। প্রকাশক : পাঠসূত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৪। প্রচ্ছদ : মোবাশ্বির আলম মজুমদার।