রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫

‘নিষিদ্ধ চন্দ্রমল্লিকা’র কবি কানিজ মাহমুদ/শেখর দেব

দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত (১৮.১২.২০১৫ইং)
------------------------------------------------------


যাপনের উৎসারিত পঙ্ক্তিমালাই কবিতা। খুব সাধরণভাবে কবিতাকে এভাবে বলা যায়। অন্যভাবে বল্লে কবিতা মন ও মননের দ্বৈত মিথস্ক্রিয়ার একক প্রকাশ। কবিতা কখন কবিতা হয়? কবিতা কি সত্য ভাষণ? কবিতা কি জীবনের অনুবাদ? তিনটি প্রশ্ন পাঠকের কাছে ছুঁড়ে দিলে বা কবির কাছে, কে কি বলবেন? পাঠক ভাবুন। প্রথম প্রশ্নটির উত্তর হতে পারে বহুরকমের। আমার উত্তরের আগে আরো কিছু কথা যোগ করতে হয়। কবিতা মূলত শিল্প। শিল্প শব্দটার সাথে উচ্চ মার্গীয় একটা ব্যাপার জড়িত রয়েছে। যেহেতু কবিতা শিল্প এবং সাহিত্যের প্রধানতম শিল্প মাধ্যম সেহেতু কবিতা কখন কবিতা হয় সেটা বিস্তর আলোচনার দাবী রাখে। আমি কবিতার ব্যাকরণে যাবো না। কবিতার স্বাভাবিক একটি গুণ হলো মোহিত করা। মোহন জাদুতে আবিষ্ট করার মতো কবিতার অন্যরকম এক ক্ষমতা আছে। আছে মন ছুঁয়ে যাবার মত বৈশিষ্ট। অতএব কবিতা সেটাই যেটা আমাদের বহুরৈখিক আবেশে আবদ্ধ করে আর মনকে দোলা দিয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরেও মতভেদ হতে পারে। আমার কাছে কবিতা সত্য ভাষণ নয়। তার মানে কবিতা কি মিথ্যা? অবশ্যই না। কবিতা মিথ্যে নয় তবে তা সত্যের কাছাকাছি বা তার চেয়ে কিছু অধিক। তৃত্বীয় প্রশ্নটির উত্তরে বলতে হয় কবিতা অবিকল জীবনের অনুবাদ নয়। তবে জীবন কেমন হতে পারে বা কেমন হতে পারতো তারই অনিবার্য প্রতিফল। কবিতা এমনই। উপরোক্ত তিনটি প্রশ্ন আমার মনে এসেছে আলোচ্য কবির ‘নিষিদ্ধ চন্দ্রমল্লিকা’ কবিতাগ্রন্থটি পড়ে। কাব্য জগতে কবি কানিজ মাহমুদের আগমন এই কবিতগ্রন্থটির মাধ্যমে। মলাটে আবদ্ধ হবার তীব্র বাসনা হতেই গ্রন্থটির জন্ম। কবি শাহিদ হাসান গ্রন্থটির ফ্ল্যাপে লিখেছেনÑ ‘তারুণ্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কানিজ মাহমুদ। তার লেখাগুলো পাঠ করে অন্তত তাই মনে হলো।’ কবি শাহিদ হাসান ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থটি পড়ে আমার মনে হয়েছে একজন প্রচ- সম্ভাবনাময় কবি-মন কানিজ মাহমুদের মধ্যে লুকিয়ে আছে। অনুকূল পরিবেশ পেলেই যেন সে মেলে দেবে তার কবিত্বের ডানা। এটা মনে হবার পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথমত আমার কাছে কবি তাকেই মনে হয়ে যিনি মানুষ হিসেবে সাধু। অর্থাৎ সাধু মানুষই প্রকৃত কবি। সাধু বলতে আমি তাঁকেই বোঝাচ্ছি যিনি বাক্যে কর্মে ও চিন্তায় মনুষ্যত্বকে লালন করেন। আর কোন কবি সাধু মানুষ কি না সেটা বোঝার জন্য তার কবিতাই যথেষ্ট ব্যক্তিগত জানাশোনার প্রয়োজন পড়ে না। ‘নিষিদ্ধ চন্দ্রমল্লিকা’র কবিতাগুলোর মধ্যে এক ধরনের সাধু মানুষকে প্রতিনিয়ত সমাজের, রাষ্ট্রের অসংগতি ও ব্যক্তি মানুষের অমানবিক আচরণকে চিহ্নিত করতে দেখি। যার ক্ষোভগুলো যেন সংযমের সাধনায় ঋজু পঙ্ক্তি হয়ে বের হয়ে এসেছে কবির বোধের গভীর হতে। আবার কখনো মহান মানুষের চোখে পথ দেখায় ব্রতী হন কবি। তাই হয়তো ‘প্রত্যাশা’ করেন অনেক কিছু। কখনো ‘কাস্ত্রোর বাণী বা চেগুয়েভারার ডাইরি হাতে’ উড়াতে চান শান্তির পায়রা। কবি বিপ্লবের পক্ষেই মাথা তুলে দাঁড়াতে চান অনায়াসে। কবি পৃথিবীর পাপ পুণ্যের হিসাব কষতে বসেন। পাপ-পুণ্যের বিশ্লেষণ করে কবি দেখেন ‘জন্ম নিলেই পাপী হয়/মৃত্যুই পুণ্য।’ মাঝে মাঝে কবি বহুদূর হেঁটে যান ‘পথের দৈর্ঘ্য’ মাপার জন্য। জীবন নামক পথের পরিমাপ করে যান কবিতার পরতে পরতে। ‘ভালোবাসা’র রহস্য ভেদ করতে গিয়ে কবি আবিষ্কার করেন ‘পৃথিবীর আদিম কষ্টের নাম ভালোবাসা’। কবি কোন তরুণীর বৈশাখ যাপন তুলে এনেছেন সুন্দরভাবে। বলেন ‘পাখিদের জবানবন্দিতে বৈশাখ এসেছে।’ প্রেম-ভালোবসার বহুরৈখিক স্ফূরণ কাব্যটিকে আবেগঘন করেছে। কিশোরীবেলা হতে যুবতীবেলার অনুভূতিমালার সমন্বয় প্রতিটি কবিতার অঙ্গে আলো ফেলেছে প্রখরভাবে। নারীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য ও পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে নারীদের খেলনাসম তুলনার বিরুদ্ধে কবির কাব্য স্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে কিছু কবিতায়। কিছু কবিতা নিতান্তই সাময়িক অনুভূতির চিত্রমালা যা কবি হয়তো নিজেই অস্বীকার করে বসতে পারে এখন। আবার কিছু কবিতায় বয়ঃসন্ধির তীব্র মাদকতাও দৃশ্যমান হয়। রমণের অনুষঙ্গকে রূপায়িত করে বলেন ‘ভালোবেসে তারার নক্ষত্র হয়/ তিল তিল করে মেয়েরা হয় রমণী’। ‘নিষিদ্ধ চন্দ্রমল্লিকা’ নিয়ে লেখাটা যখন লিখছি তখন বইটি প্রকাশের এক বছর হয়ে গেছে। অর্থাৎ বইটি প্রকাশের এক বছর পরে এসে কবি কানিজ মাহমুদ ভিন্ন স্বর নতুন কাব্য দ্যোতনা নিয়ে আমাদের সামনে তাঁর দৃপ্ত পদচ্ছাপ রেখে চলেছেন। ভবিষ্যতে কবি নিজেকে ছাড়িয়ে কবিতার জগতে অন্য এক অবস্থানে নিজেকে পৌঁছে দিবেন বলে আমার ধারণা।


নিষিদ্ধ চন্দ্রমল্লিকা
কানিজ মাহমুদ
প্রকাশক # শাঁখ
মূল্য ১০০ টাকা
প্রকাশকাল # ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদঃ জাকির হোসেন

শেখর দেবের কবিতা


ব্যক্তিগত পুকুর অথবা পাখির কথা

চড়ুইভাতি পুকুরে ভাসে পদ্মের দল। পুকুরে বাড়ন্ত মীনের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমাদের অপার আমোদ। কী সুন্দর দুলেছে পৃথিবী। চারপাশে শৈশবের বন্ধুরা যে যার মতো গড়েছে সংসার। অথচ আমার কোন ব্যক্তিগত পুকুর ছিল না। সেই থেকে চড়ুইভাতির দিন এলে পুকুর পাড়ে মালিকানার আশায় কেটেছে সময়। পাশে ঘনকালো ছায়ারা খেলেছে বাহারি মুগ্ধতায়। মনে হলো কী হবে পুকুর দিয়ে বরং ব্যক্তিগত কোন পাখি দরকার। যার ডানায় বাতাসের সুগন্ধ আর ঠোঁটে বিবিধ ফলের সুবাস। একদিন পাখির আধখাওয়া ফলে কামড় দিয়ে জেনেছি পাখিদের কোন মালিকানা হয় না। এসব ইচ্ছের মাঝে একদিন সংসারে হানা দিল জন্মগোত্রহীন শারমেয় দল। পুকুরের মাছ আর আকাশের পাখির কথা ভুলে সারারাত ঘুরেছি বনে বাদাড়ে। জঠরের অন্ধকার ভেদ করে যেদিন আলোর মুখ দেখলাম ততোদিনে কেটেছে বীভৎস নয় মাস।

পাখির ডানায় পোড়া মানচিত্র

আমাকে বেদনাহত পাখির কাছে নিয়ে চলো
যার ডানায় ঝুলে আছে পোড়া মানচিত্র
আর রাক্ষুসীর বীভৎসা বাসনা।
রক্তাক্ত বুলেট থেকে কুড়ানো স্বপ্নগুলো
চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে।

পেট্রোল বোমার আগুন-থাবায় পুড়ে
মানুষের বিবেক আর ট্রাক ড্রাইবার শহীদুল
অথচ কারো তরুণ তর্জনী দোলে না!
নতুন বইয়ের ঘ্রাণে বিমুগ্ধ কিশোরীকে
কী কৈফিয়ত দেবো?

ড্রাগন নাগিনীর মুখের আগুনে
জ্বলে চুলের ফিতা আর চঞ্চল চিবুক
পাঠশালার স্নিগ্ধ সময় যার কাটে
হাসপাতালের ব্যান্ডেজেÑ কালের কাতরাতায়।

ফাগুনের ফুল কতোটা সুবাস ছড়ালো
কতোটা পোড়ার ঘ্রাণ আকাশে বাতাসে?

রাক্ষুসীর বাতাস লাগা বিমর্ষ বাংলায়
ভেঙে যায় নিবিড় সুখের ঘুম।
চোখে ডিজিটাল স্বপ্নের ভেতর
দেখি দগ্ধ দামাল আর পিতার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন।

সংবিধান কি বোঝে না মায়ের বেদনা?
আত্মঘাতী বাঙালির স্বপ্নের ভেতর
পিঠে আগুন নিয়ে কতদূর উড়ে যাবে পাখি!

কৃষ্ণপক্ষ
তোমার ইশারায় কাঁপে ঋতুজ মনন। চারপাশে কৃষ্ণপক্ষের ধাঁধা। আমাকে দেখেই চঞ্চল চড়ুই স্বভাবে লাফিয়ে উঠতো হৃদয়ের বহুমুখী মেধারা। এসব অপরিমেয় মেধার ভেতর ক্রমশ হারিয়ে সংযত শান্ত মনে কী যেন বলতে গিয়ে চুপসে গিয়েছি লজ্জাবতীর আদলে। অথচ আমার ভেতর আছে নিশ্বাসের নিষিদ্ধ ঝংকার আর চলিষ্ণু ঝরনার খরবেগ। এসব মন ও মেধার পাঠ হারিয়ে গেছে নাপোড়ার ছড়ায়।

আজ যারা নিজের ওজনের চেয়ে ভারী স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাঁটে আর লজ্জানত চোখে চারপাশে তাকায়, তাদের কাছে তুলে দিয়েছি সম্ভাবনার প্রতিটি ফুল। কৃষ্ণপক্ষ পেরিয়ে এসে অন্তর্গত বিস্ময়ে দেখি তোমার সিঁথির বিদ্যুৎ রেখায় রক্তাক্ত একাত্তর। সমগ্র জীবন বাজি রেখে ভেবেছি যে পথ সত্য সে পথ আমার। অথচ সে পথেই কালো পিচাশের আঁধার। কোন অজানা কারণে অকালপক্ক ভাঁড়ের হাতে দিয়েছি মননের জামানত!

তিলোত্তমা জাদু

আকাশ জুড়ে কদম ঘ্রাণে বৃষ্টি অনাবিল
নিবিড় প্রাণে মনরে টানে মিষ্টি জাদুর তিল।
তিলেক সময় চোখ ফেরে না নিবিড় অনামিষা
বৃষ্টি বুঝি তুমুল মাতাল মিটিয়ে দেবে তৃষা।
চুলের নেশায় আঁধার নামে গোপন চোখে মুখে
আকাশ নীলে লীন হয়ে যাই মদির বায়ুর সুখে।
তিল দেখেছি চিলের ঢঙে দেহের মেঘে ঘুরে
ঠা-া বায়ুর স্রোত নেমেছে বৃষ্টি অচিনপুরে?
চোখের পানে চোখ রেখেছি বুঝি মনের ভাষা
মেঘ কাটে না নীল দেখি না তবে কি দূর আশা?
ভাষার জাদু আশার মধু নিয়ে বৃষ্টি নামে
ছলছলিয়ে জল গড়িয়ে যায় যে ডানে বামে।
ওগো জাদু এমন দিনে কেমন আছো একটু বল না
‘এসব তেমন বুঝি না বাবু জানি না জানি না!’
চোখের তারায় ঠোঁটের মায়ায় গরম বাতাস মৃদু
তিলের ম্যাজিক মন্ত্রে তুমি তিলোত্তমা জাদু।

সুগন্ধী বাগান

কখনো পাইনি কোন রোমাঞ্চকর কান্নার রাত
ভাসায় তবু দীর্ঘ কুহকের অনুভূতি
সেসব অতৃপ্তির আঁধারে হাসে প্রগাঢ় প্রমাদ
চুমুর বিনিময়ে দিয়েছি মনের দামে কেনা সমূহ সঞ্চয়!
হৃদয়ঘন কালে চোখ বন্ধ হয়ে এলে
চারপাশের আলোকে চুষে করেছি রাত
অতঃপর আঁধারের আরাধ্য আরতি!
উন্মোচিত শরীরে ফুটে সুগন্ধী ফুল
ক্রমশ রমণীয় ফুলের বাগানে হয়েছি বিভোর।
পৃথিবীতে পরম কোন অধ্যায় নেই
পরমার চোখে বেড়েছে দিন
যার মতো কোন সুগন্ধী বাগান দেখিনি আর।
প্রকাশিত প্রথম কাব্য ‘প্রত্নচর্চার পাঠশালা’। জড়িত আছেন ছোট কাগজ ‘শাঁখ’ সম্পাদনার কাজে। শেখর দেব চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার শেখেরখীল গ্রামে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিশুদ্ধ গণিতে স্নাতকোত্তর শেষে একটি কমার্শিয়াল ব্যাংকে কর্মরত ।
http://dhakareview.org/%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE/

বাঞ্ছাকল্পতরু | শেখর দেব

১.
তোমাদের নিঝুম প্রেম থেকে দূরে
যেখানে নিবিড় আরাম ডাকে প্রাণের মায়ায়
ক্ষণকাল আকাল পেরিয়ে গড়েছি নিয়মের সংসার
তরুণ তীর্থের পথে ধ্যানের সুরভি মেখে হাঁটি
খুঁজি পঞ্চবটির বিস্তৃত শাখা প্রশাখা—বিবেকানন্দ প্রেম।

আমি ব্রহ্মচারী নই—শুধু বিবিধ বেদনায় হয়েছি আকুল নরম
আশ্রমের প্রতিটি দেয়ালে লিখে যাই জীবনের নিবিষ্ট সূত্রমালা
জপমালায় ভরসা নেই—শুধু বিধানের নিয়ম ভেঙে গড়ি বিপুল পৃথিবী।

মানসিক সূত্রের বিন্যাসে লাগে অসীমের ঢেউ
দুলে ওঠে পাল হয়ে বেসামাল নমিত নৌকায় লাগে দোলা
মানে-অপমানে, শত্রু-মিত্রে, শোকে আর সুখের ব্যবধান যায় গুছে।

২.
পাহাড়ের আনত বাধা পেরিয়ে মেঘের কাছাকাছি
ওখানে কোনো যোগী নেই—মানুষ বড়বেশি গৃহস্থ মায়ায়
লুকিয়ে রেখেছে সমূহ সন্ন্যাস আর নিয়মের উপাচার

দেখা হলো এক জোড়া কাঠবিড়ালির সাথে
যারা গত জন্মে সাধুর ভান ধরে নিয়েছিল গৃহস্থ কামনা
এখানে মেঘের ভাসমান জল ছাড়া কিছু নেই
যারা এসেছে পৌরাণিক প্রতীকের কাছে চন্দ্রনাথ চূড়ায়
তারাও পুণ্যের জলে ডুবে যাবার আগে ভাবে
কোনো রত্নাকরের দস্যুপনার কথিত গল্পের ছবি।

পাপ আর পুণ্য কোনোটাই টানেনি তেমন
শুধু ডুবে গেছি বিবিধ বৃক্ষের ছোঁয়ায়
অবিন্যস্ত সিঁড়ি-পথের প্রতিটি পাথরের কাছে
রেখে আসি কিছু অব্যক্ত ঘাম আর সুতীব্র নিশ্বাস।

শিউলি বিছানো পথের মায়ায় পেয়েছি স্বর্গীয় আমেজ
এসবের মাঝে গড়েছি কামে প্রেমে বাঞ্ছাকল্পতরু।

৩.
মানুষ জানে ভালো
জীবনে কতটা আলো ছড়াতে হয়
কথার মায়ায় বেঁধেছিল যে বোষ্টমী
তাকে আজ আর কোথাও দেখি না
পথিক শুধু পথের ইশারায় হেঁটেছে সুদূর।

৪.
হাতে বিষণ্ণ বিকেল তুলে দিয়ে কোথায় গেলে?
সব সুর মুছে নিয়ে এ কোন পথে ছুঁড়ে দিলে মোহের বেলুন
অথচ তোমার চোখের স্বপ্নে বানিয়েছি সুরম্য ভুবন।

শীতের রোদ বুকে মেখে তোমাকে করেছি নমিত রমণী
চঞ্চল পাখি ওড়ে
ঘুরে ঘুরে বাড়ে নতুন সকাল।

গন্ধরাজের মাতাল সাহসে বিভোর দিন দোলে নীরবে
ঝরা পাতার সাথে উড়ে গেছি দূরে
শুধু ভুল করে কী রেখে গেছি জানা নেই!

এখনো এক হাতে বিষণ্ণ বিকেল
অন্য হাতে অচেনা জীবন!

৫.
এসেছো আবার ফিরে
মানুষের ভিড়ে!
সূর্যখোলার মেলায়
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হলে
বটের ছায়ায় এসো
দুমুঠো সুখ নিয়ে খেলি
বিষণ্ণ পাখিদের মাঝে!
http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/450680.html

মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বর্ণিল আলোয় উদ্ভাসিত শেখর দেবের ‘প্রত্মচর্চার পাঠশালা’

http://www.thereport24.com/article/87027/index.html


২০১৫ ফেব্রুয়ারি ০৯ ১৬:০২:৫৩
অনুপম চৌধুরী

কবি ও পাঠকের চোখ সম্পূর্ণ আলাদা। কবির ধ্যানের অন্তর্দৃষ্টি ও পাঠকের দৃষ্টিতে রয়েছে বিশাল ফারাক, আর কবির বিনির্মাণ বরাবরের মতো সুনিপুণ হাতের সুচারু শিল্প; আবার মাঝে মাঝে হালকা কিংবা নিজের কাছে মনে হয় কিচ্ছু হয়নি। তারপরও কখনো-সখনো হয়ে ওঠে কালোর্ত্তীণ কবিতা। কিন্তু কোন কবিতা কখন পাঠক হৃদয় ছুঁবে তা সময়ই বলে দিবে। কবি লিখে যান যখন-তখন; প্রত্যেক কবির রয়েছে নিজস্ব বসবাসের জায়গা। নিজস্ব মানস রেখায় কবি লিখেন কবিতা আর চিরায়ত সেই চেনা জায়গা থেকেই কবিকে তুলে আনা যায় অবলীলায়। এবং কবির দেখানো পথে হেঁটেই পাওয়া যায় কবিকে। পাঠক চোখ ও কবির চোখে ভিন্নতা থাকলেও সেরা মূল্যায়নটি হয় পাঠক চোখে। পাঠকই বলে দিবে কোন কবিতা কতদূর হাঁটবে বা হাঁটার পরিধিটা কিরূপ? কবি বলে যান নিজস্ব ঘোরের কিছু অমিয় বাণী আর পাঠক তার কাছাকাছি বা আবছা আলোয় ঘুরে আসে সেই দেখানো পথে।

কবি শেখর দেব চট্টগ্রাম তরুণ কবিদের এক উজ্জ্বল নাম, তরুণ কবি মহলের প্রথম শ্রেণীর কাব্য প্রতিনিধি। দীর্ঘ এক যুগের লেখনীর ফসল হিসেবে ‘পাঠসূত্র প্রকাশন’ প্রকাশ করেছে কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘প্রত্মচর্চার পাঠশালা’। নামের সাথে কবিতার বিষয় আঙ্গিকে রয়েছে বেশ মিল। পুরনো ঐতিহ্যের ঘ্রাণ নিয়ে কবি এবং আমাদের পথচলা; তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ছুটছি লালিত স্বপ্নের অমোঘ বীজে। কবির কবিতা নিয়ে উত্তর আধুনিকতার পুরোধা কবি ও সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী বলেছেন- ‘শেখর দেব নতুন শতক শুরুর কাব্য-প্রতিনিধি। বর্জ্য আধুনিক বাংলা কবিতার বিপরীতে নতুন স্বরায়ন ও কথন-ভাষ্য বিনির্মাণের কালে তার আবির্ভাব। অধুনা উত্তর সময়ে পরিবর্তন প্রবণতার সন্দর্ভ যখন চলমান তখন ভিন্ন এক নান্দনিক কাব্য-প্রয়াস নিয়ে হাজির হয়েছেন কবি শেখর দেব, তাই তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায় লোকায়ত-ভাষ্য তৈরির নিরীক্ষা-প্রবণতা। আধুনিকোত্তর সময়ের পর্বান্তরের সবগুলো পরিভাষা সে রপ্ত করেছে অন্তরে।’ তিনি আরও বলেন, “এ দেশের জল-হাওয়া ও মাটি-মানুষের দেশাত্মবোধের পজিটিভ ধারণাটিও কবি বুঝতে পেরেছেন। পুরাণ কিংবা প্রত্মস্মৃতিও জাগরূক হয়। ‘শ্মশান রাতে চণ্ডালের হাতে নিথর শরীর সঁপে শিশির সিক্ত ঘাসে’ শুয়ে কবি আবিষ্কার করেন উন্নাসিক কোলাহলে নিউরনের নিগূঢ় মরীচিকা। এই সব জীবনের নানা রসায়নে জারিত হয় তার কাব্যশরীর।”
কবি আমাদের ঐতিহ্যের সেই বুননকে তুলে আনতে সদা তৎপর। কবির বানানো ক্যানভাস এতোটাই মসৃণ যে, সেই মসৃণতার শিশির সিক্ত ঘাসে অনায়াসেই হাঁটা যাবে বহুক্রোশ পথ। যা আমাদের চিরচেনা পেলবতার এক অসীম রাস্তা। কবির প্রথম কবিতা ‘লাখবাতি’; কবি লিখেছেন-

কাঠের সিন্দুকে জ্বলে লাখবাতি। অন্নপূর্ণার হাসিতে কোকিল
ডাকে ধানের গোলায়। পরিপাটি ধুতির ভাঁজ; জ্বলে হাসি
সুখের বাতি। রঙিন আঁচলে দেখা দীঘির দীঘল ঘাট সব জানে।

তৎকালীন সমাজের এক লাখের বেশি টাকা থাকলে, সেই টাকার পাহারাদার হিসেবে একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বোলিত রাখা হতো। আর সেই প্রদীপকেই বলা হতো লাখবাতি। এই চিরায়ত সুক্ষ্ম বিষয়কে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর চাহনীর বদৌলতে, আর এখানে উঠে এসেছে অন্নপূর্ণার কথা এবং চিরচেনা ধানের গোলার কথা। পরিহিত পোশাকে ধুতির বর্ণনা যা এখন নেই বললেই চলে। এখানেই কবি খুব সার্থক। তখনকার সমাজের যে সুন্দর কথন তা কিন্তু সত্যি মনোমুগ্ধকর। হয়ত কোন এক সময় তা কালের স্মৃতি স্মারক হিসেবে থেকে যাবে অনন্তকাল। কবি ‘ফুল-পুরাণ’ কবিতায় বলেছেন-

তেমাথার মোড়ে
অপদেবতার পুজো দিয়েছি কলাপাতাভাতে
দেখা হয়নি তেমন
আবেগে
জমে ওঠা আনাড়ি ঘ্রাণে।

এই কবিতায় আরেকটি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে, গ্রামে এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায় এই দৃশ্যের। তিন রাস্তার মোড়ে কলাপাতায় ফুল সমেত রেখে আসা হয় অপদেবতার ভাত। যদি ভাতে কারো অরুচি ধরে তখন সেই সমস্যা উত্তরণের জন্য এখনো প্রচলিত এই প্রথা। আবহমান বাংলার যে দৃশ্যপট তা কবির লেন্সে ধরা পড়েছে নিগুঢ় ভাবে। আরও যদি বলি ‘রাহুশনিময়’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন গ্রহ আর নক্ষত্ররা কিভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। মানুষের সাথে গ্রহের যে সংমিশ্রণ তারই বর্ণনায় এসেছে এই কবিতায়। সাথে পরিবার পরিজন ও মায়ের যে আকুতি তাও বেশ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবং জোড়া কবুতর দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা তাও ফুটেছে এই কবিতায়; কবি আরও দেখিয়েছেন প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ ভিক্ষার সুন্দর ক্যানভাস যা কবি বলেই সম্ভব। কবি বলেছেন-

সেদিন মশার পিঠে চড়ে এলো রাহু
শনিসমেত শুরু হলো তাণ্ডব
মা কালি তার লকলকে জিবে চেটে নিবে সব...
সেদিন জোড়া কবুতরের বিনিময়ে
মা ভিক্ষে নিয়ে এলো নতুন জীবন।

কবি এখানে জীবনের এক কঠিন সত্য উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনকে খুঁজেছেন জটিল সমীকরণে। সে কারণেই কবি বলেছেন-

অদৃশ্য শূন্যতায় চলে রাহুশনিময় সংসার
এসব বুঝি না আমি সাংসারিক কারবার।

কবির পড়ালেখা শহরে হলেও বেড়ে ওঠা কিন্তু গ্রামে; সে কারণে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতিপাঠ শিখেছে নিগুঢ়ভাবে, ছোট বেলার ডানপিটে বালকদের ভূমিকায় মাছরাঙার পুকুর আলিঙ্গন, উঁকি যুঁকি দিয়ে বাড়ন্ত কিশোরীর সৌন্দর্য উপভোগ এবং স্কুলের ভালটি সাজা, সবই তুলে এনেছেন- ‘অনন্ত অংশিদার’ কবিতায়। কবি বলেছেন-

প্রকৃতি-পাঠের শান বাঁধানো ঘাট
মাছরাঙার সুচতুর চোখে সুদৃশ্য পুকুরের ভালোবাসা
মৃদু হাওয়ায় নাচে গহীন প্রাণের জল
স্নানরত সদ্য বাড়ন্ত বালিকার
শিরার শিহরণ দেখতে দেখতে ইস্কুলে হতো দেরি।

গ্রামীণ যে অবয়বের চিত্র এবং ডানপিটে বালকের হাতে ছুটোছুটির যে রুটিন তাও কিন্তু দারুণ ভাবে ওঠে এসেছে। এবং সাতচাড়া খেলার বর্ণনাও পাওয়া যায় এই কবিতায় যা শহুরে জীবনের কিশোর-কিশোরীর স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। কবি জীবনকে অনেক গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনের তত্ত্বও খুঁজেছেন গভীর চিত্তে, তাইতো কবি পৃথিবীকে এক টুকরো কাঁচা আমের সাথে তুলনা করেছেন; তিনি বলেছেন— ‘পৃথিবীটা এক টুকরো বোশেখের কাঁচা আম।’

‘মা-মাটির দলিল’ কবিতায় কবি, কবির বেড়ে ওঠার গান গেয়েছেন; সাথে নিজের ভিটেমাটির গল্প এবং বংশ পরম্পরার দারুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। গোশালার গরু, টুনটুনির লেজ নাড়া, গো-বাছুরের গলায় গলা জড়ানো, পুকুরের মাছ এবং নিজেদের আপনজনকে তুলনা করেছেন বেঙমা-বেঙমীর সাথে। এবং নিজের জন্মের ইতিহাসও তুলে এনেছেন কলমের জাদুকরি মুগ্ধতায়। মোটকথা দুরন্ত শৈশবের দারুণ চিত্র এনেছেন এই কবিতায়। বাবা-মা ও ঠাকুরদিদিকে নিয়েও লিখেছেন আলাদা কবিতা। ‘শাঁখের শাঁখা’ কবিতায় কবি বলেছেন-

শাঁখের নিনাদে ঘুম ভাঙা রাতের আছে অসমাপ্ত স্বপ্ন
ললাটের বলিরেখায় যা হারিয়ে গেছে নীরবে
তার কোন কিছুই পাবে না প্রত্মচর্চার পাঠশালায়।

শাঁখা হলো হিন্দু রমণীদের বিয়ের চিহ্ন, যা তৈরি হয় শাঁখ থেকে; শাঁখ আবার হিন্দুধর্মীয় পুজোতেও বাজানো হয়। ওই শাঁখ থেকেই তৈরি হয় শাঁখা। শামুকের মৃত রূপ হলো শাঁখ। কবি বারে বারে ফিরে গেছেন আমাদের অতীতের চিরচেনা ক্যানভাসে যার শৈল্পিক আঁচড়ে ফুটেছে নিদারুণ চিত্রপট। কবির এই ঐশী শক্তিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। মায়ের আঁচলে বাঁধা যেই টান সেই স্নেহের পরশের মতোই কবির শব্দবুনন। এবং মা-ছেলের স্নেহের যে ধারা তাও তুলে এনেছেন অত্যন্ত সুচারু রূপে। দেশমাতৃকার জন্য লিখেছেন সার্চলাইট ও গণজাগরণের প্রতীক হিসেবে লিখেছেন ‘প্রজন্মবোধ’ কবিতা।

যে আলো মৃত্যু খোঁজে
যে আলো পথ দেখায়
সে আলোয় বাংলা আধাঁর
বীভৎস মুখোশ পুড়িয়ে
সুন্দর সবুজ উপহার এনেছো
চলো পা ছুঁয়ে সোঁদা গন্ধে
বিভোর কোন স্বপ্ন সোপানে।

কতোটা মৃত্যুর পরিবর্তে দেখা মেলবে আলোর পথের। সময়ের সাহসী বুননের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তারই চিরায়ত গাঁথার অবিরল ফসল আজকের স্বাধীনতা। যার পদতলে সদা জ্বলজ্বলে আমাদের অহংকার ও আমাদের ঐতিহ্য। প্রেমের কবিতার কথা না বললেই নয়, প্রিয়ার চোখে যে প্রেমের ভাষা, গোলাপ, রজনীর প্রেম মাল্য গলায় না পরালে লিখাটা সর্ম্পূণ হবে না আর শিরি-ফাহাদকেও হার মানাবে এই অমর প্রেম। এ প্রেমের কবিতায়- ম্যাসেজ, ত্রিভুজ, সখাহীন সুখ, নূপুর ও বৃষ্টি, মোহনদেবী, বাঁশিওয়ালা, জলপরী, চুমুগন্ধীহাওয়া, ফুলেশ্বরী, ছুঁড়ে দেয়া সুখ, কামচন্দ্রিমা অন্যতম। কবি ‘নূপুর ও বৃষ্টি’ কবিতায় বলেছেন-

নূপুর-ছন্দের বৃষ্টিতে ভিজে যেতে যেতে
নূপুর ফিরিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলেছিলঃ
রিনিঝিনি রিনিঝিনি শব্দে ঝরে যাবো
যদি বুকের নদী করে রাখো ছলছল।

একজন প্রিয়াকে কতটুকু ভালোবাসলে এমন পঙতি বের হয়, নূপুর এর সাথে বৃষ্টির যে মিশ্রণ তারই কথন ফুটেছে এই কবিতায়। নূপুর আর বৃষ্টির আওয়াজ প্রায় একই তার পরেরটা কবিই ভালো জানে। ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি বলেছেন- ‘জয়ানন্দ বোঝেনি চন্দ্রাবতীর অমায়িক ফুল। ফুলের স্নিগ্ধতার ভেতর বয়ে গেছে ফুলেশ্বরী’। প্রেমের ক্ষেত্রের এমন কানামাছি খেলা প্রায় থাকে, সামান্য খুনসুটি না থাকলে প্রেমের যে মজা তাও মেলে না কপালে; তাই ফুলেশ্বরী কবিতায় কবি প্রিয়ার কাছে আসলে চারপাশ যে স্নিগ্ধতায় ভরে যায় তারই গান গেয়েছেন। কবি আরও বলেছেন, নিয়ত ‘এক চঞ্চল পাখি ওড়ে সমস্ত আবেগের ভেতর। কাছে এলে ফুল ফোটে চারপাশ, গন্ধে গন্ধে লাগে মৌতাত।’ কবির এই সুনিপুণ হাতের বর্ণনা সত্যি চমকপ্রদ। ‘মেধসমুনি’ ও ‘সীতাকুণ্ড বিহার’ হলো সমগ্র উপমহাদেশের পবিত্র স্থান, যার আশ্রয়ে ছুটে আসে দূর-দূরান্তের অনেক তীর্থযাত্রী।
কবি সেই দু’স্থানকে শিরোনাম করে লিখেছেন দুটি কবিতা। প্রেমের মহীমায় সীতাকুণ্ডকে রাঙিয়ে দিয়েছেন রঙধনু আবিরে।

‘কন্ট্রাডিকশান’ কবিতায় কবি পাঠককে একটা ঘোরের আবহে রাখতে চেয়েছেন, যার দৃশ্যাবলীর রমরমা চিন্তনে খানিক চেতন হারাবেন পাঠককূল। কবি বলেছেন-

আমি থ্রি-পিচ মোড়ানো কবিতাটির প্রতি
কলেবরের শব্দ-বিন্যাসে ওড়নার ভাঁজে
গোপন ঘোরে নাচায় পঙক্তিতে পঙক্তিতে।

কবি পাঠককে ধাঁধার মধ্যে রেখে একটা আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন আর কবি তাতেও সফল। বর্তমান সমাজের কর্পোরেট বাণিজ্যের কথা না বললেই নয়। এই আজব নগরের প্রতিটি ইট মানুষ খেকো, আর এই ইটের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে কতো স্বপ্নের বলি হচ্ছে তা আমাদের অজানা। কবির রিক্তরথ কবিতাটি কর্পোরেট বাণিজ্যের করাল ছাঁচের চিত্র। যেখানে গ্রামের সবুজ আঁচল ফেলে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে এ সব সুন্দরের বলি হচ্ছে নগর ইটে; কিন্তু এই বলি হওয়া স্বপ্নের উদ্ধারের কোন পথ আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই এ সব স্বপ্নরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় আর যা দেখে তাও ভুল চোখে দেখে। একদিন এ সব স্বপ্ন কালের স্রোতে হারিয়ে যায়, তাই কবি বলেছেন-

সময়ের তুমুল-তাগিদ
স্বপ্নাদের দৌড়ায় নগর করাল ছাঁচে
ঝিল-বিকেল ভুলে
কংসের আসর জমে ওঠে বেশ, রমরমা
মথুরা পথে আসে না কোন কৃষ্ণ রথ!

‘মুগ্ধ মৌনতা’ কবিতায় কবি কবির ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার যে চিত্র তাই তুলে ধরেছেন। এই কবিতাটি হলো দীর্ঘ কবিতা ও শেষ কবিতা। প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় শীত নামে শহরে, সবুজের সুরভী, ঘুম ভাঙ্গে কমলাপুরে, বেশ লিখেছেন। কবির চিন্তনের সীমারেখা বেশ সুন্দর ও সাবলীল যার রেশে হেঁটে পার করা যায় অনেক সময়। এবং আমাদের গ্রামীণ আবহের সুন্দর সুন্দর সব চিত্র কলমের ছোঁয়ায় ফুটেছে দারুণভাবে। তাই একটা ফেলে একটা আলাদা করা বেশ দুরুহ ও জটিল। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন- মোবাশ্বির আলম মজুমদার।

মেদহীন ঝুরঝুরে কবিতা শরীরে যে কোন পোশাকেই মানায়, কবি শেখর দেব অনেক যত্নে গড়েছেন এমন সব কবিতার শরীর। তাই সময়ে অসময়ে কবিতার গায়ে পরানো যাচ্ছে সুন্দর সুন্দর সব পোশাক আর অলংকার। যাতে লোভ সামলানো অনেকটাই কঠিন। কবির দীর্ঘজীবন কামনা করে কবির জন্য রইল অফুরান ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।

প্রত্মচর্চার পাঠশালা। শেখর দেব। প্রকাশক : পাঠসূত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৪। প্রচ্ছদ : মোবাশ্বির আলম মজুমদার।