এলিস মুনরোর সাক্ষাৎকারএটা এক টুকরা কাহিনী
ডিকলার আওয়ানো
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আওয়ানো: আপনার লেখার রসায়ন সম্পর্কে বলবেন?
মুনরো: আমি ধীরে ধীরে কাজ করি, এ কাজটা কঠিন বা সর্বদাই কঠিনের কাছাকাছি। বিশ বছর বয়স হতেই নিয়মিত লিখছি, সত্যিকার অর্থেই লিখছি, এখন আমার বয়স ৮১। এখন নিত্যদিনের রুটিন হলো সকালো ওঠা, এক কাপ কফি খাওয়া আর লিখতে শুরু করা। অল্প কিছুক্ষণ পর একটু বিরতি নিয়ে কিছু খাই আবার লেখা চালিয়ে যাই। সকালেই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি লিখিত হয়। সকালের শুরুতেই বেশি সময় কাজে লাগাবো এরকম ভাবি না। হয়তো সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা কাজে লাগাই। অনেক লেখা পুনর্বার লিখি, এরপর ভাবি এইতো হলো লেখাটি, এরপরও এটা নিয়ে ভাবি, পুনর্বার নতুন কিছু সংযুক্ত করি। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় কিছু শব্দগুচ্ছ হয়তো সংযোজন করা উচিত, আবার তা লেখাটিতে অর্ন্তভুক্ত করি। উপন্যাস লেখার চিন্তা নিয়ে লেখা শুরু করি কিন্তু লিখেছি ছোটগল্পগুলোই কারণ এভাবে আমি আমার সময়গুলো কাজে লাগাতে পারি। এতে গৃহের এবং সন্তান দেখাশোনার কাজগুলো করতে পারতাম, উপন্যাস লিখলে সে সময়গুলো পেতাম না। লিখতে লিখতে অল্প কিছু পরে আমি গল্পের ফর্ম পেয়ে যেতাম, গল্পের গতানুগতিক ফর্ম নয়, একটু দীর্ঘ গল্পের ফর্ম দিতাম, মূলত যা আমি করতে চেয়েছিলাম। গল্পের এ আয়তনে বলতে পারতাম ঠিক যা আমি বলতে চেয়েছিলাম। প্র্রথমে এটা কঠিন ছিল কারণ গল্প বলতে মানুষ একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের ফর্মকে বুঝতো। তার চায় ছোটগল্প। আমার গল্প তারা যা চায় ঠিক তেমন নয় একটু ভিন্ন এবং তোমাকে তারা ভিন্ন কিছু বলবে। অন্ততপক্ষে এটা আমি কখনো জানিনি গল্প শুধু একটি নির্দিষ্ট আয়তনের হবে। আমি অবাক হইনি গল্পটি কতো বড়ো দেখে, কারণ গল্প যে আয়তন চেয়েছে আমি সেটাই দিয়েছি। যাই হউক, আমি এখন কি লিখছি- এটা কি গল্প বা এটাকে কেউ গল্প বলছে কিনা এটা নিয়ে ভাবি না। এটা এক টুকরা কাহিনী- এটা যা ঠিক তাই।
আওয়ানো: আপনি একজন গীতধর্মী লেখক। আপনি কি এখনো কবিতা লেখেন?
মুনরো: ওহ, হ্যাঁ, কখনো সখনো লিখি। কবিতার ধারণাগুলো আমার ভালো লাগে কিন্তু তুমি জানো যখন তুমি গদ্য লিখ, আমি মনে করি তুমি সচেতনভাবেই কাব্যিকতাকে পরিহার করো। গদ্য চায় কিছু সোজাসাপ্টা তীব্রতা, এবং এখন এভাবেই লিখি। এমনভাবে লিখতে চাই যে পদ্ধতিটি আমি জানি না। এ কথায় পাঠককে আতঙ্কিত করা হবে?
আওয়ানো: আমার এটা মনে হয়েছে যে আপনি লোকাচার বিষয়ে খুব আগ্রহী।
মুনরো: হুম, তবে এটা তুমি কখনো জানবে না যে তুমি কিসে আগ্রহী হতে যাচ্ছো, যা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পার না। হঠাৎ করেই তুমি বুঝতে পারবে এটাই সেটা যেটা তুমি লিখতে চাচ্ছো। তাই নিজে নিজে এরকমটি চিন্তা করতাম না কিন্তু মানুষের বলা অনেক গল্প আমি শুনি এবং তার মধ্যে একটি রিদম খুঁজে পাই এবং লিখতে চেষ্টা করি। আমি চিন্তা করি কেন এ ধরনের গল্পগুলো মানুষের কাছে প্রয়োজনীয়? আমি মনে করি, তুমি এখনো মানুষের মুখ হতে অনেক গল্প শুনে থাকবে যা মানুষের জীবনের অবাক করা কিছু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হওয়ার কথা। আমি ঐ গল্পগুলোকে তুলে আনতে চাই এবং দেখি তারা কিভাবে গল্পগুলো বলছে অথবা আমি গল্পগুলোকে কিভাবে পরিচালনা করছি।
আওয়ানো : আমি কোথায় পড়েছি যে, লোকাচার নিয়ে গল্প বলাটা নারীদের ফর্ম বলে চিন্তা করা হতো।
মুনরো: আমি মনে করি এটা সেই নারীদের জন্য সত্য যাদের গুরুত্বের সহিত নেয়া হয়নি, এমনকি নারীরা লিখতে শিখার পরেও, তারা লিখতও, সম্ভবত তারা তখনো গল্পগুলোই বলছিল। তুমি জানো নারীরা অনেক সময় একসাথে অপচয় করেছে অথবা তারা ব্যবহারও করেছে। আমি মনে করতে পারি সেসব কাজগুলো, যেগুলো তোমরা একসাথে করেছিলে, যখন পুরুষ মানুষগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কতটা ভুগেছিলে। তারা হয়তো মাঠে কাজ করতো এবং তারা যখন ঘরে আসতো- যেটা আমার শিশুকালে দেখেছি- তোমরা তাদের প্রচুর খাবার পরিবেশন করতে। খাবারের প্রাচুর্যতা ও রান্নার গুণগতমান কতোটা ভালো হলো এটা নিয়েই ছিল নারীদের মধ্যে গর্বের বিষয় এবং পরক্ষণেই একগাদা থালা-বাসন পরিষ্কার করতে। এবং সবসময় একে অপরের সাথে কথা বলতে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্যই এসব কিছু এখন নাই। এটা পুরনো প্রক্রিয়া- গ্রামীণ প্রক্রিয়া এবং আমি জানি না নারীরা এখনো এভাবে কথা বলে কিনা। নারীরা কি একে অপরের সাথে কথা বলে? একে অপরকে উৎসাহিত করে, নাকি করে না? কিন্তু নারীরা যেখানে মিলিত হউক, তাদেরকে গল্প বলার উৎসাহ থাকা দরকার, এবং তা বলতে একে অপরকে উৎসাহিত করা দরকার যে, ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে তুমি কি ভাবছো? এটা বলা ভয়ানক ব্যাপার নয়? অথবা গল্পটি কি বুঝায়? সম্ভবত মহিলাদের একটা ঝোঁক আছে জীবনকে মুখে প্রকাশ করার। অনেক পুরুষ মানুষ এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতে নারাজ এটা আমি জানি বা জেনেছিলাম। তারা ভাবতো এগিয়ে যাওয়াই ভালো, যেভাবে মোকাবিলা করেছি সেভাবেই মোকাবিলা করা উচিত জীবনকে এবং এটা নিয়ে বেশি বিস্মিত হতে নেই।
আওয়ানো: আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে এটাই যদি আপনার অন্তর্গত বিষয় হয় আপনি কেন ছোট গল্পের ফর্মটি বেছে নিয়েছেন- নাকি এটিই আপনাকে বেছে নিয়েছে?
মুনরো: এটাও হতে পারে। আমি ভালোবাসি মানুষের সাথে কাজ করতে, মানুষের কথোপকথন নিয়েও এবং মানুষ থেকে আসা বিস্ময় নিয়ে। আমার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তা গ্রহণ করোনি তাতে কি হয়েছে। আমার একটি গল্পে (পলায়ন) একজন মহিলা তার বিয়ের ব্যাপারে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে তার স্বামীকে ছেড়ে যাবে এবং এ ব্যাপারে বয়স্ক বিচক্ষণ মহিলারা উৎসাহ দিয়েছে এবং সে সেটা করে। অতঃপর যখন সে ছেড়ে যায় সে বুঝতে পারে তার এটা করা উচিত নয়। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। হয়তো এটা করার পেছনে তার কাছে অনেক কারণ থাকতে পারে কিন্তু সে এটা করতে পারে না। কিভাবে আসে? এই ধরনের বিষয়গুলো আমি লিখি। কারণ আমি জানি না এই ‘কিভাবে আসাটা’। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই এটার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখানে এমন কিছু আছে যেটা মনোযোগ আশা করে।
আওয়ানো: আপনার গল্প সংগ্রহে দেখেছি গল্পগুলোর মাঝে একটি বন্ধন আছে এবং থিমেরও রিপিটেশান দেখি। আমি মনে করি ‘পলায়ন’ গল্পের পর্যায়ক্রমিক ঘটনা আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্প সংগ্রহের কিছু গল্পের সাথে মিলে যায় যেমন ‘ট্রেইন’ গল্পটি।
মুনরো: ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ গল্পটি আমাকে খুব আকর্ষণ করে কারণ আমি মনে করি মাঝে মাঝে মানুষ বুঝতে পারে না তাকে কি করতে হবে। আমি এটা বলতে চাচ্ছি যে, লোকটি (জ্যাকসন, মূল চরিত্র) জীবনের ব্যক্তিগত ঝামেলা হতে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। সে জানে না কেন। যখন তারা কাছে এলো, এটাই ওটা। সেখানে ছিল কিছু যৌন উপাদান কিন্তু এটাই একমাত্র বিষয় নয়। আমি মনে করি এখানের মানুষগুলোও সে রকম।
আওয়ানো: আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্পে আপনার মা-বাবার সাথে আপনার সম্পর্কের বিষয়ে স্ববিরোধী বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
মুনরো: এটা ভালোবাসা, ভীতি ও অপছন্দের ব্যাপার। এ সব কিছু মিলেই এটা।
আওয়ানো: আপনি শুধু পেছনেই ফিরছেন, আপনার বিগত কাজগুলোতে, আপনার সাথে আপনার বাবার সম্পর্ক, যে একজন সম্পূর্ণ লেখক, খুব বেশি স্পর্শকাতর মানুষ, তার নিজের পুরো জীবনের একজন পাঠক।
মুনরো: হয়তোবা সে এরকম ছিল।
আওয়ানো: আপনার মায়ের সাথেও আপনার স্ববিরোধী সম্পর্ক ছিল।
মুনরো: এ ক্ষেত্রে সম্পর্কটি খুব জটিল কারণ আমি মূলত আমার বাবাকে বেশি পছন্দ করতাম। আমি আমার মাকে পছন্দ করতাম না এটা তার জন্য খুব দুঃখজনক ছিল।
আওয়ানো: তার অসুস্থতার কারণে কি?
মুনরো: না, আসলে তার অসুস্থতার জন্য নয়। সম্পর্কটি খারাপ হয় সম্ভবত তার অসুস্থতার আগে হতে। কিন্তু সত্যিকারভাবে সে একজন সুন্দর কন্যা সন্তান চেয়েছিল যে মান্য করে চলবে, যে কিনা চালাক ছিল কিন্তু সবকিছু মেনে চলতে পারলো না, সবকিছুর ফিরিস্তি গেয়েছে, প্রশ্ন করেনি।
আওয়ানো: এবং তখনো সে তার সময়কে নিয়ে চলছিল বিভিন্ন পথ ধরে।
মুনরো: হ্যাঁ, বিভিন্ন পথে সে ছিল। সে নারী অধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার ছিল এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও। সে খুব বেশি শুদ্ধিবাদী ছিল অর্থ্যাৎ গোঁড়ামি পছন্দ করত না যা তার সময়ের অনেক মহিলার মধ্যেই ছিল না।
আওয়ানো: আমার মনে হয় আপনার মাকে নিয়ে হতাশার জায়গা হল সেক্স নিয়ে তার ধারণাটি।
মুনরো: হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু তখন, অবশ্যই এটা কোথা থেকে আসছে ঈশ্বর জানে। বেশির ভাগ নারীরা, আমি মনে করি যারা ছিল খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তারা অনুভব করতো সেক্স হচ্ছে শত্রু। বিয়ের মাধ্যমে সব কিছুর ইতি ঘটে। আমি বলতে চাচ্ছি- সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটি একজন মহিলার জীবনে ঘটে, তাদের বলতে শুনতাম, অবশ্যই বিয়ে করতে হবে এবং অবশ্যই তাতে যৌন মিলন থাকবে, এবং যৌন মিলন হলো এমন একটি ব্যাপার যা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা হলো এটাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
আওয়ানো: আপনার ‘প্রিয় জীবন’ গল্পে স্মৃতির গৃহের নবায়নের ধারণা ব্যবহার করেছেন। আপনি কি বলবেন কিভাবে আপনি ভাবেন স্মৃতির প্রকৃতি নিয়ে।
মুনরো: কি ঘটছে এটা খুব মজার, আপনি বুড়ো হচ্ছেন কারণ আপনার স্মৃতি প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল হচ্ছে, বিশেষত দূরের স্মৃতিগুলো। কিন্তু আমি স্মৃতি দিয়ে সবকিছু চেষ্টা করি না, কিন্তু এটা সবসময় ওখানেই থাকে। আমি জানি না আমি এটা নিয়ে যা ভাবি তার চেয়ে বেশি লিখছি কিনা। নিঃসন্দেহে শেষের গল্পগুলোতে স্মৃতির চেতনা কাজ করেছে, এবং আমি সবসময় এ রকমটি করি না কারণ আমি মনে করি তুমি যদি সত্যিকারভাবে খুব মনোযোগের সাথে তোমার পিতা-মাতা ও শিশুকাল নিয়ে লিখতে যাও তোমাকে যতোটা সম্ভব সৎ হতে হবে। তোমাকে অবশ্যই ভাবতে হবে সত্যিকারভাবেই কি ঘটেছিল, না হয় তোমার গল্পগুলো তোমার স্মৃতিকে খেয়ে ফেলবে। অবশ্যই তুমি এটা করতে পারো না। তাই অবশ্যই তোমাকে বলতে হবে- ভালো, এটাই আমার জীবনের গল্প- যেটা আমি স্মরণ করতে পারি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৩
এমজেএফ/জেসিকে